চলতি বছরের অক্টোবরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক ছাত্রকে ছাত্রাবাসে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যার ঘটনায় ২১ জনকে আটক করেছে পুলিশ, এবং আটকৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্য। ভারতের সাথে সরকার যে পানি-ভাগাভাগি সংক্রান্ত চুক্তি করেছে তা নিয়ে নিহত ছাত্রটি ফেসবুকে সমালোচনা করেছিলেন, যে কারণে ছাত্রলীগ নেতারা তার প্রতি ক্ষুব্ধ হন |
একুশ বছর বয়সী ফাহাদের মৃত্যুর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন । এরকম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে আগেও হয়েছে, কারণ হিংস্র দলীয় রাজনীতি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দৃঢ়ভাবে শিকড় গেঁথে নিয়েছে, এবং প্রায়ই ভয়াবহ রূপ ধারণ করে | ওসলো ইউনিভার্সিটি-র মুবাশার হাসান জানান যে দলীয় রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচলিত এক ধরণের অপসংস্কৃতি, যেখানে সাধারণ ডরমিটরি রুমগুলোকে টর্চার সেলে পরিণত করে অত্যাচার চালানো হয় সরকার বিরোধী মতবাদধারী ছাত্রদের ওপর |
এক একুশ বছর বয়সী ছাত্র ঢাকা থেকে জানান যে ছাত্রলীগ মূলত সরকারি দলের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে | যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আশী এবং নব্বই এর দশকে রাজনৈতিক মতবিরোধের কেন্দ্রস্থল ছিল, ছাত্র সমাজকে আয়ত্তে রাখা সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ | তাই স্বৈরাচারী বেশ কিছু নীতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জুড়ে দেখা যায়, যেমন ছাত্রাবাসে একটি কক্ষ পেতে হলেও সরকারী দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হয় ছাত্রদের | এধরণের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রকাশ্যেই করে থাকে সরকারী দল |
বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের পৃথক পৃথক কক্ষ বরাদ্দ পাওয়ার কথা থাকলেও কখনো কখনো প্রায় একশো জনকে একটি পাবলিক রুমে রেখে ৱ্যাগিং করা হয় | ৱ্যাগিং, যার অর্থ বয়স্ক শিক্ষার্থীদের দ্বারা লাঞ্ছিত করা, সাধারণত ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সম্পাদিত হয় | পুরো প্রক্রিয়াটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ছাত্রদেরকে ভয় দেখিয়ে সরকারী দলের নিয়ন্ত্রণে রাখা |
“আবরার ভয় পেয়ে থেমে যায়নি,” ঢাকার একজন শিক্ষার্থী আমাদের জানান। লীগের সদস্যরা আবরারকে ইসলামপন্থী বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন। “যে কেউ সরকারের বিরোধিতা করলেই তাকে আজকাল শিবির আখ্যা পেতে হয়” বলে তিনি জানান। “কাউকে মারধর করতে চাইলে লীগ এই সহজ অজুহাতটি ব্যবহার করে, এবং তাদের কিছু বলার কেউ নেই।”
ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাহিরেও প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী । এই বছরের শুরুর দিকে, সরকার যখন একটি প্রকল্পের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে তহবিল দেয়, তখন ছাত্রলীগের স্থানীয় শাখা তার কিছু অংশ দাবি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অর্থ প্রদান করেছেন, এবং পরে লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আরও বেশি অর্থ দিয়েছেন। কোনো ব্যবসা শুরু করতে অথবা পরিচালনা করতে হলেও লীগের স্থানীয় শাখাকে একটি মোটা অঙ্ক নিয়মিত ভাবে পরিশোধ করতে হয় | গত বছর নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোর প্রচারণা, এবং যথাযথ ভাবে ভোট সংগ্রহ প্রবল ভাবে বিঘ্ন করে, যার ফলে তারা নির্বাচনে আবার জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে | পনুরায় নির্বাচিত হয়ে ফেরার পরে ছাত্রলীগ আরো বেপরোয়া একটি শক্তিতে রূপ নিয়েছে |
মিঃ হাসান বলেছেন যে আমলা, এমপি এবং পুলিশ – এই ব্যবস্থায় সবাই একত্রিত। তবে এগুলোর কোনওটিই নতুন নয়, ছাত্রলীগের আগে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলও ছিল বেপরোয়া। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক একনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সমর্থনকারী ছাত্র সমাজও পরিচালিত হতো একই ভাবে। ডেইলি স্টার নামে একটি পত্রিকাতে রিপোর্ট করা হয় যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালে থেকে এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসগুলোতে ১৫১-টি হত্যাকান্ড হয় যার জন্যে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি |
এসব কিছু সত্বেও আবরারের হত্যাকাণ্ড চারিদিকে নিন্দিত। তাঁর ফেসবুক পোস্টে ব্যাপকভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ছাত্রলীগের সাথে জড়িত থাকা সত্বেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। তিনি জনগণকে ছাত্রলীগের ভালো দিকগুলোও জনগণকে বিবেচনা করতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ইতিপূর্বে ছাত্রলীগকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেছেন। আবরারের মৃত্যুর আগে তিনি তার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় কমিটি পরিবর্তন করেছিলেন।
বুয়েট-এর উপাচার্য ৱ্যাগিং এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে ক্যাম্পাস থেকে নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা মনে করেন ব্যাপারটি এতটা সহজ হবে না | ঢাকার ছাত্রটি আমাদের জানান যে হয়তো ছাত্রলীগ কিছুদিনের জন্য থেমে থাকবে | সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য সেটা একটি সুখবর|
মূল রচনা থেকে মুক্তিফোরামের পক্ষে লেখাটিকে অনুবাদ করেছেন তনিমা
1 Comment
//১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক একনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সমর্থনকারী ছাত্র ফ্রন্টও পরিচালিত হতো একই ভাবে।//
ছাত্র ফ্রন্ট নয়, ছাত্র সমাজ হবে। এরশাদের সমর্থনকারী হল জাতীয় ছাত্র সমাজ।