সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ওপর পরিচালিত অত্যাচারের বিশদ বিবরন তুলে ধরেছে তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় রিপোর্টটি
প্রকাশের সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকারতুর্ক বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব দেন। এসকল জবারেরই ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ফারজানা জামান স্বাতী
কর্মকর্তাবৃন্দ কঠোর পরিশ্রম করেছেন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দর্শনের গতিপথ গড়ে তুলতে যার মূলে থাকবে মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এই রিপোর্টের প্রস্তাবনা সমূহ এই দর্শন বাস্তবায়নের চেতনাকে ধারণ করে এবং আমার কার্যালয় বাংলাদেশের প্রতি সহযোগিতা বজায় রাখতে ও বর্ধিত করতে উন্মুক্ত; দেশটিতে আমাদের জোরালো উপস্থিতিও এর অন্তর্ভুক্ত। গত কয়েক দশকে, বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রায়শই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিক্ত প্রতিহিংসা, পৃষ্ঠপোষকতা এবং পরিচয়ের রাজনীতির দ্বারা। আজ এই বদল সুযোগ করে দিয়েছে প্রতিশোধের চক্র হতে সরে আসার ও নতুন পন্থার দিকে যাত্রা করার, যা সমগ্ৰ জাতিকে বিশ্বাস স্থাপন, নিরাময় ও উন্নত জবাবদিহিতার চেতনার মূলভিত্তিতে এক করে দেবে।
আমরা এখন প্রশ্ন গ্রহণ করবো। আমি অনলাইনে থাকা বাংলাদেশি সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানাই। আপনারা যদি হাত তোলেন, তাহলে আমরা আপনাদের প্রশ্ন গ্রহণ করতে পারবো। আমি এই মুহূর্তে কোন হাত উঠতে দেখছি না…ওহ আসলে দেখছি। আমরা একজনের হাত উঠতে দেখছি।আমরা একসঙ্গে তিনটি প্রশ্ন নেব। প্রথম প্রশ্নটি অনলাইনে যমুনা টিভির পক্ষ থেকে এসেছে। দয়া করে নিজের পরিচয় দিন। আমি দ্বিতীয় প্রশ্নটি পেয়েছি মেহেদি হাসানের কাছ থেকে। আমরা এই দু’টো দিয়ে শুরু করি।
মাহফুজ মিশু (যমুনা টিভি):
ধন্যবাদ এক্সেলেন্সি। আমি মাহফুজ মিশু, যমুনা টিভির জন্য কাজ করি, যা ঢাকাভিত্তিক ২৪ ঘন্টার একটি নিউজ চ্যানেল। আমার প্রশ্ন হাইকমিশনারের কাছে। আমার প্রশ্ন হল—আপনারা যদি দেখেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তদকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ১৪০০ জনকে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা এখন দেশের বাইরে রয়েছেন, তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করতে আপনারা কি সাহায্য করতে পারবেন?
মেহেদি হাসান মারুফ (নেত্র নিউজ):
হ্যালো, আমি মেহেদি হাসান মারুফ, নেত্র নিউজের সঙ্গে আছি। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নাহিদ ইসলাম, যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা, তাকে গত ১৯ জুলাই সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর আয়নাঘর ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। দয়া করে এই অপহরণের বিস্তারিত ঘটনার উপর আলোকপাত করুন।
কামরুজ্জামান (টিআরটি ওয়ার্ল্ড, বাংলাদেশ প্রতিনিধি, তুর্কি টেলিভিশন চ্যানেল):
শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য মন্ত্রিসভার উচ্চপদস্থ সদস্যরা এখন ভারতে অবস্থান করছেন এবং বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর জন্য। তবে, গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলেন এবং ভারত এখন তাকে ফেরত দিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আপনি কি মনে করেন, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে?
হাইকমিশনারের উত্তর:
আপনাদের প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। প্রথমত, এই প্রতিবেদন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি সামনে এনেছে। যখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হয়, তখন দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজন, যা বর্তমানে চলমান রয়েছে। আমি বাংলাদেশে থাকার সময় এই বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছি। নিশ্চিত করতে হবে যেন ন্যায়বিচারের মানদণ্ড বজায় থাকে এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।
যারা দেশের বাইরে রয়েছেন এবং গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের বিচার সম্ভব করতে আন্তর্জাতিক আইনের সুযোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। কতোগুলো দেশের ‘সার্বজনীন এখতিয়ার’নীতি রয়েছে, যার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অন্য দেশে বিচার করা সম্ভব। এছাড়াও বাংলাদেশ চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) এই বিষয়টি উত্থাপন করতে পারে, কারণ বাংলাদেশ এই আদালতের সদস্য রাষ্ট্র।
সত্য প্রকাশ করা ও ইতিহাস সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, যা নিরাময়ের পথ তৈরি করবে। আমি আশা করি যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়া বাংলাদেশে মানবাধিকারকেন্দ্রিক একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
প্রতিবেদনটি সত্য উদ্ঘাটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এটি নিরপেক্ষভাবে তথ্য যাচাই করে প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। সত্য প্রকাশ করা ও ইতিহাস সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, যা নিরাময়ের পথ তৈরি করবে। আমি আশা করি যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়া বাংলাদেশে মানবাধিকারকেন্দ্রিক একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
নাহিদ ইসলামের অপহরণ সম্পর্কে:
আমাদের প্রতিবেদন নাহিদ ইসলামের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এটি বাংলাদেশে নির্বিচার আটকাদেশের অন্যতম প্রতীকী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আমরা এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিস্তারিত প্রমাণ সংগ্রহ করেছি।
বিচার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সংস্কার করা জরুরি, যাতে অপরাধীরা বিচার থেকে রেহাই না পায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় এই বিচার নিশ্চিত করা যেতে পারে।
এএফপি ও সুইস নিউজ এজেন্সির প্রশ্ন:
আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ১৩০০ জনের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা প্রতিহিংসার চক্রের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। নতুন সরকার কি সত্য উদ্ঘাটনের জন্য কোন ট্রুথ কমিশন গঠনের পরিকল্পনা করছে?
হাইকমিশনারের উত্তর:
সংস্কার চলমান থাকলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশের পরও ১২ জন কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছে, যা উদ্বেগজনক। বিচার ব্যবস্থায় পুনর্গঠন প্রয়োজন, যাতে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পায় এবং প্রতিহিংসার চক্র বন্ধ হয়।
শাহিদুল ইসলাম চৌধুরীর প্রশ্ন:
বাংলাদেশ কি প্রথমে নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা (আইসিটি) দ্বারা বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করবে, নাকি আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিসি) বিচার চাইবে?
হাইকমিশনারের উত্তর:
দেশীয় বিচার ব্যবস্থা আগে শেষ করা উচিত, তবে আন্তর্জাতিক আদালতেও বিচার সম্ভব। আইসিসি তখনই কার্যকর হবে, যদি জাতীয় বিচার ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত বা অনিচ্ছুক হয়। বিচার নিশ্চিতে উভয় পথই খোলা রয়েছে।
ফারজানা জামান স্বাতী একজন অনুবাদক
Leave A Reply