Site icon মুক্তিপত্র

বাংলায় সফল রাষ্ট্র কেন্দ্রিক গবেষণা, আলোচনা কেন কম?

সম্প্রতি পড়ছি বদরুল আলম খান এর বই “সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন?” এটা পড়তে পড়তে কয়েকটি ভাবনার বিষয় মাথায় আসলো।

বাংলায় গত তিন-চার দশকে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির ঘরানায়  সোভিয়েতকেন্দ্রিক যত স্মৃতিচারণ, গবেষণা ও আলোচনা হয়েছে, তার সিকিভাগও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস, বিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে হয়নি!

যারা এই বিষয়ে নেতৃত্ব দেন, তারা মূলত বাম বলয়ের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। তবে এখন, আমরা, তাদের কৈশোর, যৌবনের সোভিয়েত প্রেমের ও বর্তমানের বিরহের স্মৃতির পুনঃপুনঃ উৎপাদন দেখি। এদের কেউ কেউ আবার সোভিয়েত রাশিয়ায় পড়েছেন বা থেকেছেন, অথবা উভয় কাজই করেছেন। তবে পরবর্তীতে, অধিকাংশই অন্যান্য দেশে চলে গিয়েছেন।

পুরনো প্রেমের স্মৃতিচারণে কিংবা ব্যর্থতার গবেষণায় ক্ষতি নেই।

তবে মজার বিষয় হল, সোভিয়েত কিংবা ১৯৯১ পরবর্তী সময়ের রাশিয়ায় যতজন বাংলাদেশি একাডেমিক কিংবা বুদ্ধিজীবী থেকে গিয়েছেন, তারচেয়ে এখনও অনেক বেশি শিক্ষিত গবেষক, শিক্ষক ও নানা ক্ষেত্রের পেশাজীবি লোকজন আমেরিকায়  বসবাস করছেন।

তবে কিন্ত একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, গড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগানের আওয়াজের বাইরে, আর হুমায়ূন আহমেদ কিংবা জাফর ইকবালের আমেরিকা জীবনের স্মৃতির বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা কতটা শক্তিশালী, তাদের গণতন্ত্রের কাঠামোগুলোর দিক বা তাদের উদ্ভাবন, এমনকি বাজারের সাফল্যের দিক নিয়ে বাংলা ভাষায় তেমন কোন বিশ্লেষণধর্মী নন- ফিকশন লেখালেখি দেখা যায় না, প্রায় বিরল।

তাছাড়া, অক্টোবর বিপ্লবের চুলচেরা ব্যবচ্ছেদ নিয়ে বাংলায় হাজার কোটি শব্দ লেখা হয়েছে, আর এখনও নানান পত্রিকার সুবাদে বিভিন্ন দিবস বা বার্ষিকীতে নানা প্রকার ক্রোড়পত্র ছাপানো হয় । গর্বাচেভ এইভাবে এটা না করে ঐভাবে করলে এই হইত-জাতীয় নিবন্ধগুলো সর্বনিম্ন হলেও হাজারখানেক পাওয়া যাবে গুগলে একটু সার্চ করলেই।

কিন্ত বাস্তবে দেখা যায়, আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধ, কিংবা তাদের ফাউন্ডিং ফাদারদের ভিশন বা আমেরিকান সংবিধানের ইউনিক দিকগুলো অথবা ১৯২০ থেকে গত শতকের শেষ পর্যন্ত এই পরাশক্তির অর্থনীতির রূপান্তর ও বিকাশ ইত্যাদি নিয়ে তার সিকিভাগ আলোচনাও হয় না!

লেনিনের জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে এখনও অনেক ক্রোড়পত্র পাবেন, কিন্তু আব্রাহাম লিংকনের ক্ষেত্রে তেমন বিশেষ পাবেন না!

একটি ব্যর্থ বিপ্লবী প্রচেষ্টার ব্যাপারে আমাদের যে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবালুতা ও শ্রম, সেই তুলনায় দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র, যার গণতন্ত্র দীর্ঘমেয়াদে সফল একটি মডেল (এবং সোভিয়েত-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের বাইনারি ধরলেও যারা সফল ও বিজয়ী), সেই ব্যাপারে লেখালেখিতে আমাদের নেই কোন বিশেষ আগ্রহ! হ্যাঁ, আশ্চর্যের ব্যাপার বটে!

মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, এমনকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদেরও এই ব্যাপারে বিশেষ কলম খুলতে দেখা যায় না (শাফকাত রাব্বী অনিক বোধহয় একজন ব্যতিক্রম)।

হাস্যকর বিষয় হলো, জরিপ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ লোক আমেরিকা চলে যেতে চায়!

তবে এটা শুধু আমেরিকার ব্যাপারে না, আমাদের কাছাকাছি সময়ে এগিয়ে যাওয়া দেশগুলোর ব্যাপারেও বাংলায় আমাদের বিশ্লেষণমূলক তীক্ষ্ণ লেখালেখি ও পর্যবেক্ষণ নেই। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, ইত্যাদির কাছে আমাদের কী শেখার আছে, সেই ব্যাপারে তেমন কোন কাজ নেই।

যেমন নেই নর্ডিক মডেলগুলোর ক্ষেত্রেও, কিংবা বাজার অর্থনীতিতে চীন কীভাবে প্যারাডাইম শিফট ঘটালো, তার ব্যাপারেও।

বোধহয় সফল সুখী সংসারের গল্পের চেয়ে হারানো প্রেমের ট্রাজেডির গল্প বেশি আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের বুদ্ধিজীবিদের একাংশের কাছে!

এটা মূলত আমাদের অগ্রজ প্রজন্মের প্রবণতা। তবে আমাদের প্রজন্মে সোভিয়েত হা-হুতাশ বিলুপ্ত হবে।

তাই এখন প্রশ্ন হল, আমরা‌ (বিশেষ করে ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী) কি নির্মোহ বিশ্লেষণের আগ্রহ নিয়ে দুনিয়ার সফল রাষ্ট্রগুলোর শক্তি ও ব্যর্থতার দিকে তাকানোর ক্ষেত্রে বাংলায় লেখালেখিতে বৈচিত্র্য আনতে পারবো?

লেখক: গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজিম

ছবি: ড্রীমসটাইম
Exit mobile version