মোস্তফা সরোয়ার ফারুকির ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ফিল্মটাকে আমার বেশ ওভার গ্লোরিফাইড মনে হয়। মানে হ্যাঁ, ফিল্মের প্লট ভালো। সুন্দর “মেসেজ” দিয়েছে। কিন্তু দিন শেষে ফিল্ম বিচার করার সময় “মেসেজ” দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মার্কার না। এমনকি ফিল্মের কাজ মেসেজ দেওয়া কিনা সেই নিয়েও প্রচুর বিতর্ক আছে।
তো যাই হোক ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ফিল্মটার দুইটা অংশ। প্রথম অংশে জাহিদ হাসান গ্রাম থেকে ঢাকা আসে চাকরির জন্য। এসে ধামরাই এ যায় মামার বাসায়। মামা জায়গা না দেওয়ায় আবার বেশ দূরে ঢাকায় সংসদ ভবন, শহীদ মিনারে ঘুরে আবার মামার কাছে ফেরত যায় ধামড়াই এ৷ এইবারে মামা তার পকেটের সব টাকা নিয়ে তাকে থাকতে দেয়। মামার চরিত্র খিটখিটে, এই নিয়ে সবচেয়ে ভালো শব্দটা আছে হিন্দি ভাষায় “খাড়ুস”। এইটাকে বাংলায় খাচ্চর বলা যাইতো। কিন্তু খাচ্চর শব্দটা আসলে হাইজিনের সাথে বেশি কানেক্টেড। তো খাড়ুসই বললাম। এই খাড়ুস মামার বাসায় সে থাকতে শুরু করে। চাকরি খুজতে আসলেও তার চাকরি খোঁজা বা এমন কিছু খুব একটা দেখা যায় না। বরং প্রথম এক্টে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে পাশের বাড়ির মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীর বউয়ের সাথে একটা প্রেম/পরকিয়া ধরণের টেনশন বিল্ডিং ই দেখানো হয়েছে।
এর পর দ্বিতীয় অংক, সেখানে মামাকে একটা চাকরি হয়েছে বলে ট্রেন ধরে জাহিদ হাসান অন্য শহরে এসে সেখানকার জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ে পিস্তল বোমার ভয় দেখিয়ে বেশ কিছু মানুষকে জিম্মি করে রাষ্ট্রের কাছে বেশ কিছু অত্যন্ত প্রো পিপল (জনহিতকর) দাবি জানায়। এর প্রসেসে বেশ কিছু লুপহোল থাকলেও ফিকশনের খাতিরে সেইগুলো ধরতেছি না। ধরা জরুরি কিছুও না। এই এক্টে সোশ্যাল মেসেজের সাথে বেশ কিছু দুর্দান্ত কমিক টাইমিংও রয়েছে।
কিন্তু এই ফিল্মে নির্মানে ত্রুটির জায়গাটা অন্য জায়গায়। এবং খুবই ক্রুশিয়াল (গুরুত্বপূর্ণ) জায়গায়। প্রথম এক্ট এবং দ্বিতীয় এক্টের মধ্যে কোন যোগাযোগ নাই। পাশের বাড়ির বৌদির সাথে প্রেমের টেনশন থেকে হঠাৎ করেই জাহিদ হাসান ডিসি অফিসে হোস্টেজ নেগোসিয়েশন এ চলে যায়৷ হোস্টেজ সিচুয়েশনে যাবার আগে কোন টেনশন বিল্ডিং নেই। বলা ভালো তার কোন প্রেক্ষাপট নির্মানও নেই। একদম হঠাৎ করেই ওই এক্টটা শুরু হয়ে যাচ্ছে৷ এটা তাও চালিয়ে নেওয়া যেতো যদি প্রথম এক্টে প্রোটাগনিস্ট (জাহিদ হাসান) এর প্রেমের সাথে সাথে ইকোনমিকাল ফ্রাস্ট্রেশন, বেকারত্বের ফ্রাস্ট্রেশন নিয়েও খানিকটা বিল্ডআপ থাকতো। কিন্তু সেসব একদমই ছিলো না। এই ছিলো না কথাটা নিশ্চিত ভাবে বলার জন্য পুরো ফিল্মটা আবারো নতুন করে দেখলাম। দেখলাম বলে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি- ছিলো না৷ এই না থাকার ফলে যা হয়েছে ফিল্মের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় এক্টটাকে মনে হয়েছে আরোপিত জোড়াতালি দেওয়া। ফিল্মটা যদি সেকেন্ড এক্ট থেকেই শুরু হতো তাহলে হয়তো ব্যাপারটা আরোপিত মনে হতো না৷ সেক্ষেত্রে এটা একটা ভালো ড্রামা হতে পারতো বা একটু এফোর্ট দিলে ফিল্মও হতে পারতো। তবে এফর্ট দিলে হয়তো দু’টো এক্টের মধ্যে এই অদ্ভুত বিচ্ছিন্নতাই তৈরি হতো না৷ যাই হোক, এই যোগাযোগ হীনতা ফিল্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটাকেই খাপছাড়া করে দিয়েছে। যার ফলে ফিল্মের প্রথম ও দ্বিতীয় এক্টকে দু’টো আলাদা ফিকশন বলে মনে হয়। ভালো সেকেন্ড এক্ট এবং এভারেজ ফার্স্ট এক্ট মিলে একটা ভালো ফিল্মই হতে পারতো যদি এই দুইটা এক্টের মধ্যে যোগাযোগ নির্মান করতেন নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। সেকেন্ড এক্টের বিল্ডআপ হতে হতো ফার্স্ট এক্টে৷ যা ছিলো একদমই মিসিং (অনুপস্থিত)।
রায়হান রাফি- শাকিব খান জুটির বাণিজ্যিক সিনেমা ‘তাণ্ডব’ এ একটা বড় সময় জুড়ে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়েই ছিলো এই হোস্টেজ সিচুয়েশন। যদিও এই সিনেমায় ব্যাংক হেইস্ট ইত্যাদির ইংগিত রাখা হয়েছে সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের পরবর্তী সিনেমার ইংগিত হিসেবে৷ কিন্তু সিনেমার মূল বিল্ডআপ হোস্টেজ সিচুয়েশন ও নেগোসিয়েশনেই। একটা টিভি স্টেশন দখলে নিয়ে এই ফিল্মেও রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে ডেকে এনে জিম্মি করে রাষ্ট্রের সাথে নেগোসিয়েশন করা হয়। কিছু সোশ্যাল মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা, কিছু কমিক টাইমিং (মিম টাইমিং) ইত্যাদি এইখানেও ছিলো। তবে এই ধাঁচের কাজ মেইড ইন বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক আগেই দেখানোতে ‘তান্ডব’ সিনেমার এই অংশটাকে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ সিনেমা ইনফ্লুয়েন্সড বলছেন অনেকেই। বলাটা ভুলও নয়।
কিন্তু দু’টো সিনেমায় তফাৎ হলো রায়হান রাফির ‘তাণ্ডব’ সিনেমায় স্বাধীন নামের ছদ্ম পরিচয়ে প্রটাগনিস্ট মিখাইল অর্থাৎ শাকিব খান যখন হোস্টেজ এর ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে স্বাধীন চরিত্রটার গল্প বলতে শুরু করে, তখন সেই গল্পে গানের প্লেসমেন্ট, বাণিজ্যিক চটুলতা ইত্যাদি নিয়ে ত্রুটি থাকলেও ত্রুটি ছিলো না একটা প্রচন্ড কিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়৷ স্বাধীনের গল্পে ওই ইলিমেন্ট গুলো ছিলো যেটায় জিম্মিকারীর ফ্রাস্ট্রেশন, স্ট্রাগল ইত্যাদি উঠে আসে। যাতে করে হোস্টেজের ব্যাকগ্রাউন্ড বিল্ডআপটা হয়েছে বেশ ভালো ভাবেই। এই ব্যাপারটাই ছিলো না ফারুকির সিনেমা ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এ৷
প্রোটাগনিস্ট জাহিদ হাসানের জিম্মি করার ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ডে তার ফ্রাস্ট্রেটেড হওয়া অথবা মানসিক বিকৃতি হওয়া কোনটারই কোন প্রকার বিল্ড আপ হয় নি। এই না হওয়ার কারণে এই ফিল্মটা প্লট অনুযায়ী সম্ভাবনাময় হলেও শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে দু’টো খাপছাড়া এক্ট। যাদের মধ্যে কোন আন্তসম্পর্ক বিদ্যমান নেই। এই জায়গাতেই ফিল্ম হিসেবে এগিয়ে যায় ‘তাণ্ডব’।
কায়েস মাহমুদ স্নিগ্ধ