সবক্ষেত্রেই বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে মূল কাহিনীর ভূমিকা লিখতে হয়। নয়তো লেখনীর কার্যকারণ এবং ভাবার্থ উদঘাটনে অনেক সময়ই বাঙালি পাঠক সমাজ আলস্য প্রদর্শন করে।
পাকিস্তান – বাংলাদেশ, এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমাদের রাজনীতি ও সামাজিক চিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই প্রজন্মের কাছে যেমন মুক্তিযুদ্ধ অনেকটা রুপকথার মতো তেমনই আমাদের রাজনীতির সুবর্ণ সময়ও যে একটা সময় ছিলো, তাও রুপকথারই মতো। সামাজিক অবস্থার এখনকার এই ধ্বংসস্তুপের সাথে এই প্রজন্ম এতোটাই অভিযোজিত যে, বাবা-মায়ের কাছে শোনা তাদের কৈশোরের সময়কার সমাজব্যাবস্থার কথা গল্পকথা ছাড়া কিছুই মনে হয় না। সঠিক ইতিহাস এবং পরিসংখ্যানের সম্পর্কে জানা থাকলে হয়তো এই সামাজিক অবস্থার মোকাবিলা করা যেতো।
কিন্তু আফসোস, আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে যা জানি তার অবস্থা এমন, যেমন ১০টা সত্য কথার সাথে একটা মিথ্যা কথা মিলিয়ে দিলে মিথ্যা কথাটাও সত্য বলে ভ্রম হয়। এবার পরিসংখ্যানের সম্পর্কে দু’একটা কথা বলা যাক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসেব অনুসারে, দারিদ্র্যতার হার ২৩.২% ( Poverty rate for April – June 2016 is 23.2% & Extreme Poverty rate for April – June is 12.9% ; as per Bangladesh Statistics 2018 )। এর থেকে একটা কথা খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে এই হিসেবে কিছুটা হলেও গরমিল আছে। চোখ কপালে তুলার আগে গরমিল মনে হবার কারণটা বলি, দারিদ্রতার হার যদি এতোই কম হবে, তাহলে খোদ রাজধানী শহরে দুই এক রাস্তা পরেই না খেতে পাওয়া মানুষগুলোকে দেখা যায় কোন কারণে? বিধাতা যে বিবেক দিয়েছেন যার কারণে আপনি আমি পশু না মানুষ হয়ে জন্মেছি,সেই বিবেক-বুদ্ধি একটু খাটালে বুঝতে পারার কথাটা।
অবশ্য উন্নয়নের জোয়ারে এই মানুষগুলো ভেসে গেছে। আজকাল তারাও অদৃশ্য(না হলে, উন্নয়ন হয়েছে কিভাবে বুঝবো!) এই এক উদাহরণ দেখে মনে হলো ইতিহাস, পরিসংখ্যান চুলোয় যাক, সাধারণ মানুষ হিসেবে একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। যেই এক প্রশ্নের উত্তরে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
প্রশ্নটা হলো, রাজনীতি কি? রাজনীতি শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে – রাজ্য বা রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল। সাধারণ অর্থে রাজনীতি হল রাজশাসন বা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। গ্রিক শব্দ,‘পলিটিকোস’ থেকে আসা ‘পলিটিক্স’ যার বাংলা ‘রাজনীতি’ শব্দের আদি অর্থ ছিল প্রজাদের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে রাজপরিবার কোন নীতি গ্রহন করলে সেটা রাজনীতি। অন্য মতে, রাজনীতি শব্দের অর্থ হল শহর বা রাজ্য। রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে নীতির আলোকে জনগণকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল নগররাষ্ট্র ও সভ্যদের সম্পর্কে Politics নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
Politics-এর শাব্দিক অর্থ হল`The science or art of government or governing, specially the governing of a Political entity, such as a nation, and the administration and control of its internal and external affairs.
কিন্তু, তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংক্ষেপে রাজনীতির সংজ্ঞা দিতে গেলে বলা যায়, “ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বের সঙ্গে জড়িত অর্থাৎ যে সকল কাজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে করা হয় তাই রাজনীতি।” এই সংজ্ঞাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সবথেকে কার্যকর ও সঠিক সংজ্ঞা। যে রাজনৈতিক – সামাজিক অসন্তোষের কল্লোল একদা ছিলোনা তার সূত্রপাত এই ক্ষমতা ও কর্তৃত্ত্বের দ্বন্দের কারণে। আর এখন রাজনীতি সমাজের অন্যতম নিয়ন্ত্রণ শক্তি। বর্তমান সামাজিক জীবন রাজনীতি নির্ভর। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের-এ-বাংলা, মাওলানা ভাসানী সাহেব এর মতো রাজনীতিবিদ রাজনীতি করাতেন সাধারণ মানুষের জন্য,খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের জন্য। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মাওলানা ভাসানী সাহেব আঙুল তুলেছিলেন শাসন ব্যবস্থার দিকে। আর আজকাল, মানুষ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে রুদ্ধশ্বাস জীবনযাপন করছে, বেকারত্বের হার বাড়ছে, মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ আজ, শিক্ষাক্ষেত্রে অবক্ষয় ইত্যাদি ইত্যাদি । আর বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল।
সামাজিক বিবর্তনের বা বর্তমান ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থার সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের সুস্থ ও সুন্দর রাজনৈতিক চর্চা না হওয়া। ১৯৪৭ এর দেশভাগ,পাকিস্তান ও ভারত নামক দুই রাষ্ট্রের জন্ম। ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে পূর্ববঙ্গ হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তানের একটা প্রদেশ। এই সময়ে দুই রাজনৈতিক দল দুই দেশের ক্ষমতায় আসীন হয়। ভারতে কংগ্রেস আর পাকিস্তানে মুসলিম লীগ। পাকিস্তানে ১৪ই আগস্ট,১৯৪৭ সাল থেকে ৭ই অক্টোবর, ১৯৫৮ পর্যন্ত (মার্শাল ল’ জারির পূর্ব পর্যন্ত) মুসলিম লীগের প্রাধান্য ছিলো মন্ত্রণালয়গুলোতে।(১৯৫৪ এর নির্বাচনে গঠিত সরকার এর সমাধি হয় ১৯৫৬ সালে, মুসলিম লীগের চক্রান্তে)। এই ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ অব্দি ২৩ বছর পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজমান ছিলো, তার-ই ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে অনেকটা পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
অর্থাৎ, সহজ কথায় তৎকালীন পাকিস্তান – বর্তমান বাংলাদেশ এই পরিক্রমায় সামাজিক বিবর্তন হলেও রাজনৈতিক বিবর্তন খুব একটা হয়নি।
লেখকঃ ইরাবতী চৌধুরী