নূরদের মার খাওয়ার সংবাদ পাওয়ার একদল দেখলাম বেশ কৌতুক করে লিখছেন, নূর নাকি আবার মাইর খাইছে! কিছুক্ষণ পর আরেকদলকে দেখলাম, হেথায় সেথায় কমেন্ট করা শুরু করছে, নূর এর সাথে বহিরাগত পোলাপান কেনো? মানে তাদের কথা হইতাছে, বহিরাগত থাকলে মাইর দেয়া জায়েজ। এই দুইপক্ষ হয় একেবারে লীগের পোস্টেড বা পেইড মেম্বার, আর নাইলে দেহ মন লীগের কাছে বর্গা দিয়া তারপর নামছেন বুদ্ধিজীবীতা করতে।
আবার, নূরের মার খাওয়া দেখে কষ্ট পাওয়নেওয়ালাদের কয়েকজনের মূল দূঃখ হইতাছে, ছাত্রলীগ কেনো নূরের মতো ‘ছ্যাচড়া’কে মাইরা জনপ্রিয় করতাছে। অর্থাৎ, তাদের খায়েশ হচ্ছে, নূরদের ক্রমাগত মার খাওয়া বড়ো কোনো ঘটনা নয়, ঘটনা হইতেছে ছাত্রলীগের মতো ‘নামীধামী’ সংগঠন কেনো হাত ময়লা করতে গেলো! নূররা ক্রমাগত মার খাচ্ছে, এটা তদের কাছে ছাত্ররাজনীতির খারাপ লক্ষণ না, বরঞ্চ খারাপ লক্ষণ হইতেছে ছাত্রলীগের নূরের মতো ‘ছ্যাচড়া’কে মারাটা!
আবার কারো কারো দুঃখ হচ্ছে, কেনো ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নাম ধারণকারী কেউ মারামারি করতে গেলো। তাদের কাছে, নূরের মার খাওয়াটা এখানে যতটা না ক্ষোভের তার চেয়ে বেশি কষ্টের হইতেছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামটার অপব্যবহার। তাদের বিষ্ময়, মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে কীভাবে এটা করছে?
এই খানে ভয়ংকর দোটানাও চলছে। ‘মুক্তিযুদ্ধ’মঞ্চ যখন সংগ্রামে হামলা করে তখন সেই হামলা বৈধ, আবার এই হামলা অবৈধ। এটার ফায়সালা কীভাবে হবে? তারা বোধহয় বিশ্বাস করেন, মুক্তিযুদ্ধমঞ্চ ভেকধারী ও নামধারীরা একেবারে খাটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘সংগ্রামে’র অফিসে হামলা করেছিল! সন্ত্রাসী যে তার রাজনৈতিক কারণেই সন্ত্রাস করতে গিয়েছিল, এটা তারা কেনো জানি মানতে চান না! (আমি মোটেও বলছিনা যে, দেশপ্রেম নিয়া হামলা করলে এইটা বৈধ। দয়া করে ভুল বুঝবেন না)। তাদের আগের সন্ত্রাসে আপনার পুরো সম্মতি ছিল বইলাই এইবার আরো বড়ো আকারে সন্ত্রাস করছে। সপ্তাখানেক আগের হামলা যদি ‘দেশপ্রেমে’র বহিঃপ্রকাশ হইয়া থাকে, এইটাও তাদের ‘দেশপ্রেমে’র বহিঃপ্রকাশ।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়া যারা চিন্তা করেন ও ভাবেন, বা আমরা ভাবি বা চিন্তা করি বলে দাবি করি, তারা বারেবারে বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ যেনো ‘ক্ষমতা’য় আসে। তাহলে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি। এইখানে অদ্ভুত হলেও সত্য যে, খোদ ‘ক্ষমতা’কে প্রশ্ন করি নাই, বা করা হয় নাই। আমাদের হোমড়াচোমরা বুদ্ধিজীবীদের মাথায় একবারও কি প্রশ্ন আসে নাই যে, লংকায় যেই যাবে সেই রাবন হবে? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বলতে তো কোনো ইউটোপিয়ান পক্ষ না।
যারা ‘ক্ষমতা’য় আসার জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে ব্যবহার করেছিল, এবং আমি আপনি এর বুদ্ধিবৃত্তিক সাপোর্টও যুগিয়েছি, তারা ক্ষমতার যখন একচেটিয়া দখললাভ করবে তখন তাদের কাছে এই ‘মুক্তিযুদ্ধে’র উপযোগিতা হচ্ছে শুধু রাষ্ট্রীয় বা দলীয় ভায়োলেন্স এর বৈধতা হাসিল। এটা শুধু ‘মুক্তিযুদ্ধ’এর বেলায় সত্য নয়, ধর্ম বা দুনিয়ার যেকোনো ধরণের ‘ইজমে’র বেলাতেই সত্য। এইটা যত তাড়াতাড়ি বুঝব তত তাড়াতাড়ি রহমত নাজিল হবে।
যে আমলে মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদ কায়েম হতে পারে, সেই আমলে মুক্তিযুদ্ধের উপযোগিতা কি? উত্তর কি জানি না, তবে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হইতেই হবে। এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তির নিরিখে যে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ হয়েছিল, সেই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কে যদি ‘ক্ষমতা’র হাত থেকে না বাচানো যায়, মুক্তিযুদ্ধকে যদি রিক্লেইম না করা যায়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের এমনতর ব্যবহার হতেই থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের নামে আরো ভয়াবহ কাণ্ড ঘটবে। আল্লা না করুক, শব্দের অর্থ যেমন আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির সাথে বদলায়, মুক্তিযুদ্ধ শব্দটাও বদলাবে তখন।
লেখক: সহুল আহমদ, মুক্তিফোরাম ও রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য