২০১৮ সালের মার্চ, হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটির এডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং।
এখানে আমাদের ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ছিলো (দেশে যারে ভিসি বলা হয়), রেজিস্ট্রার অফিস ছিলো, ক্যাশিয়ার অফিস ছিলো। এই বিল্ডিং থেকে সবাইকে বের করে দেয়া হয়েছিলো। তহবিল নিয়ে দুর্নীতি হবার কারণে নয় দিনের জন্য এ বিল্ডিং দখল করে রেখেছিলো ছাত্ররা।
এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে সারি সারি বিছানা। ওই যে সবুজ রঙের একটা স্লিপিং ব্যাগ, যার সামনে ল্যাপটপ আর হেডফোন–ওইটা আমার বিছানা। ওইখানে বসে আমি নট অল স্প্রিংস এন্ড উইন্টার (কালকের আন্দোলন, আজকের আন্দোলন) এর থিওরেটিকাল ফ্রেমওয়ার্ক লিখছিলাম। আন্দোলনের থিওরি লিখছিলাম আন্দোলনের মাঝে বসে।
এই অসাধারণ সুযোগটি আমি পেয়েছি আমার আলমা মাটারের জন্য। হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি।
আমি সেখানে গিয়েছিলামই লড়াই করবার উপায়-পদ্ধতি শিখতে। তবে আমি জানতাম না যে হাওয়ার্ড স্পেসিফিকালি লড়াই শেখবার জন্য এতো ভালো একটা জায়গা হবে। কেনো এতো ভালো একটা জায়গা ছিলো? কারণ হাওয়ার্ড হলো হিস্টরিকালি ব্ল্যাক ইউনিভার্সিটি। আর আমেরিকায় হিস্টরিকালি ব্ল্যাক ইউনিভার্সিটি হওয়া মানেই হলো হিস্টরিকালি সংগ্রামীদের ইউনিভার্সিটি হওয়া। ব্ল্যাক হয়ে আমেরিকায় টিকে থাকাটাই একটা নিয়ত সংগ্রাম, আর রাজনৈতিক লড়াইয়ে জড়ানোটা সেখানে আর কোন চয়েস না, একটা নেসেসিটি।
হাওয়ার্ডে গিয়ে আমি প্রথম সেমেস্টারেই যে ক্লাসটা করেছিলাম সেটার নাম ছিলো “দ্য ম্যাটারিং অফ ব্ল্যাক লাইভস।” তখনও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার মুভমেন্ট চলছে। আন্দোলনের নেতারা এসে ক্লাসে স্পিচ দিয়ে যায়। র্যাপাররা এসে র্যাপ করে যায়। আমরা ব্ল্যাক পাওয়ার মুভমেন্টের ইতিহাস পড়ি, পদ্ধতি শিখি। ক্লাসের মাঝে প্রফেসর এনডাব্লিউএর গান বাজায়–“ফাক দ্য পোলিস কামিং স্ট্রেট ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড।”
এটা শুনলেই মানুষের মনে হবার কথা, বলে কি! ফাক দ্য পোলিস–ক্লাসের মাঝখানে? এতো বাজে একটা শব্দ! আবার পুলিশকে নিয়ে গালিগালাজ! ব্ল্যাকরা তো আসলেই বর্বর, অসভ্য ইত্যাদি।
একই ঘটনা ঘটেছিলো আমাদের কিশোর বিদ্রোহের সময়ে। মানুষ বাচ্চাদের ভাষা নিয়ে শালীনতার প্রশ্ন করেছিলো ঠিক, কিন্তু এর পিছনের রাগের কন্টেক্সটটা আর দেখেনাই। কোটা সংস্কার আন্দোলনের “আমি রাজাকার” দেখেছে, কিন্তু তার পেছনের কনস্টান্ট লেবেল মারার রাজনীতি আর তার দোহাইয়ে পেটানোর, জেলে পোরার কালচারটা আর দেখেনাই।
এবং ঠিক এইটাই করে আসতো অল্ট রাইটরা। তারা ফাক দ্য পোলিসকে লিটারালি নিয়ে নিতো। বলতো ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বলা যাবেনা, বলতে হবে অল লাইভস ম্যাটার। কিন্তু মুভমেন্টের মূল পয়েন্টটাই ফান্ডামেন্টালি মিস করে গেছিলো।
ব্ল্যাক পুলিশরাও ফাক দ্য পোলিস গাইতো ক্যাম্পাসে। এটা কখনই আসলে ব্যক্তিগতভাবে কোন পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান ছিলো না। এটা ছিলো সেই রেসিস্ট পুলিসিং মেন্টালিটির বিরুদ্ধে একটা কথা যেটাকে শিখানোই হইসে ব্ল্যাক বডিকে দমন করানো কথা। এটা আসলে এক ধরণের রাজমানসিকতার (গভর্নমেন্টালিটির) কথা বলে।
সেই রাজমানসিকতার কথা বলে যেটা একজন মানুষকে আরেকজন মানুষের গলা চেপে ধরে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু সেই হত্যায় হত্যাকারী পুলিশ অফিসার ছাড়া পেয়ে যায়। এগারো বার এরিক গার্নারকে বলতে হয় “আই কান্ট ব্রিদ” “আই কান্ট ব্রিদ।”
এরপরে আমরা ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টির কথা পড়তে শুরু করলাম। তাদের ভেতর থেকে ভেঙ্গে দেবার, সশস্ত্র করে দেবার জন্য এফবিআইয়ের ডিজাইন করা কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স প্রোগ্রামের কথা পড়লাম। কেমন করে ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টির অন্যতম উদ্যোক্তা কোয়ামে টুরেকে ব্যক্তিগতভাবে ধ্বংস করে দেবার প্রক্রিয়া একটা ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন হাতে নিলো সেটা পড়লাম। আমাদের ফিলসফি ডিপার্টমেন্টের বড়ভাই কেনো অস্ত্র হাতে নিসিলেন, কেমনে তাকে “সন্ত্রাসী” বানানো হইসিলো সেই ইতিহাস পড়লাম।
মার্টিন লুথার কিংকে সম্মান করতাম আমরা, ম্যালকম এক্স তবু হিরোই ছিলেন। ক্লাসে কবিতা লিখতে হতো। ঘুরেফিরে সবার কবিতায় এই লাইনগুলা চলেই আসতো। “বাই এনি মিনস নেসেসারি।”
এর মাঝে আরেকটা ব্ল্যাক কিশোরকে মেরে ফেললো পুলিশ। আনআর্মড। ক্লাসে থাকা অবস্থায় খবর পাওয়া গেলো। লাইট অফ করে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। পরের দিন সবাই ব্ল্যাক হুডি পরে আসলো। সতের বছরের কিশোর ট্রেভন মার্টিনের কালো হুডি, পুলিশের হাতে যার মরার জন্য সেই হুডি ছাড়া আর কোন দোষ তার ছিলোনা।
কালো হুডির সামনে লেখা “আই কান্ট ব্রিদ।” পেছনে পুলিশের হাতে মারা যাওয়া আনআর্মড ব্ল্যাক ছেলেদের নাম।
ট্রেভন মার্টিন, মাইকেল ব্রাউন, এরিক গার্নার, এলেন ব্লুফোর্ড, জন ফেরেল, কিমানে গ্রে, কেন্ড্রিক ম্যাকডেড, এরিক গার্নার–হুডির পিঠের জায়গা ফুরায়ে যায়, নাম আর ফুরায় না। শেষ নামের শেষে তিনটা ডট দেয়া।
কতবার আর হুডি ছাপানো যায়?
আমরা যে বিল্ডিঙয়ে ক্লাস করতাম–আন্দোলনেরটা, সেই বিল্ডিংইয়ের নাম ছিলো এলেন লক বিল্ডিং। ফিলসফি ডিপার্টমেন্ট এই বিল্ডিঙয়ে। এই বিল্ডিং লেগাসি বহন করতো হার্লেম রেনেসাঁর। এলেন লক, যোরা নিল হার্স্টন, টা-নাহাসি কোটস, টনি মরিসনরা উঠে আসছেন এখান থেকে, একের পরে এক। ফিলসফি, লিটারেচার, জার্নালিজম দিয়ে যে একটা শোষণ মুক্তির কাজ করা যায়, এটা তাদের কাছে থেকে শেখা। ইন্টেলেকচুয়াল এক্সেলেক্স দিয়ে যে রেসিজমকে ট্যাকেল করা যায়, এই অসাধারণ ব্যাপারটা এখান থেকে শেখা। ভালো আইডিয়া দিয়ে খারাপ আইডিয়াকে হারানোর উপায় এখান থেকে শেখা।
মানুষ হয়তো মরে যায়, কিন্তু তাদের লেগাসি রয়ে যায়। যোরা নিল হার্স্টনের প্রতিষ্ঠা করা হিলটপ পত্রিকা রয়ে গিয়েছিলো, যেখানে আমি রিপোর্টিং করা শিখি, এলেইন লকের কাজ রয়ে গিয়েছিলো ডিপার্টমেন্টের শেলফে। নোবেল লরিয়েট টনি মরিসনের সাথে কথা বলতে পেরেছি একবার, উনি চলে যাবার আগেই। আর কোটস তো সময় পেলেই আমাদের ক্লাসরুমে চলে আসতেন ঘুরতে ঘুরতে। নিজেই নিজের লেখা পড়িয়েছেন “দ্য কেইস ফর রেপারেশনস”–কেন স্লেভারির জন্য ব্ল্যাকদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত। আমার জীবনে পড়া সবচেয়ে ভালো এসেগুলার মাঝে একটা। ভয়াবহ ভালো একটা এসে, সবার পড়া উচিত–শুধু রাজনৈতিক লেখনি শেখার জন্য।
আর যে বিল্ডিঙয়ে ছিলো পলিটিকাল সায়েন্সের ক্লাস, সেটার নাম ছিলো ফ্রেডেরিক ডাগলাস হল। দাসত্ব থেকে পালিয়ে লোকটা কেবল বক্তৃতার জোরে জাতীয় নেতা হয়ে ওঠেন। স্লেভারির বিরুদ্ধে লিখে, কথা বলে, বিতর্ক করে রেসিস্ট সাদাদের ভুল প্রমাণ করে দেন–প্রমাণ করে দেন যে কালোরা বাকিদের ইন্টেলেকচুয়াল সমান না, বরং বেশিও হতে পারে। পলিটিকাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রালফ বাঞ্চ। ইসরায়েল আর প্যালেস্টাইনের মধ্যে ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তিসাক্ষর করান। আর ল স্কুলে ছিলো থারগুড মার্শালের লেগাসি। প্রথম ব্ল্যাক সুপ্রিম কোর্ট জাস্টিস, ব্রাউন ভার্সেস দ্য বোর্ড কেইসের লইয়ার, যার কারণে আমেরিকার পাবলিক স্কুল ডিসেগ্রেগেটেড হয়।
এদের লেগাসির থেকে শিখে আমি লড়াই করবার বেশ কয়েকটি দিক সম্বন্ধে জানি। সাংবাদিকতা করে, লিখে, বক্তৃতা দিয়ে, রাজনীতি করে, আইনজীবি হয়ে–আর আমি আস্তে আস্তে সবগুলাই শিখলাম। কোনটাই ছাড়লাম না একেবারে। সব ডিপার্টমেন্টে দৌড়ে দৌড়ে ক্লাস করতে করতে আমার শেষ পর্যন্ত কোন একটাতেই ঠিকঠাক মেজর করা হলোনা। মেজর হয়ে দাড়ালো ইল্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিস–যার মাঝে রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, ইতিহাস সব মিশে গেলো। কিন্তু ফোকাস ছিলো আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, কারণ আমি সবসময় হাওয়ার্ডের শিক্ষা কিভাবে দেশে কাজে লাগাবো সেই চিন্তায় থাকতাম।
কাজেই, আমি বারবার ব্ল্যাকদের লড়াইয়ের সাথে আমার লড়াইয়ের প্যারালাল বের করবার চেষ্টা করতাম। আমি মিলও পেলাম একসময়। ব্ল্যাকরা যেমন নিগৃহীত, তেমনি দলিতরাও নিগৃহীত। মিলটা সেখানে। ব্ল্যাকদের যেমন ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি গড়তে হয়েছে, তেমনি সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই উপমহাদেশে দলিত প্যান্থারস গড়ে উঠেছে। ওদের যেমন থারগুড মার্শাল আছে, দলিতদের বাবাসাহেব ভিমরাও আম্বেদকার রয়েছেন। ওদের যেমন নিগার ডাকে, আমারেও মালাউন ডাকে। কষ্টটা সিমিলার।
এই কথা আমার এক ব্ল্যাক ফ্রেন্ডকে বলতেসিলাম। সে তখন বেশ প্রশস্ত একটা হাসি দিলো, “কষ্টটা সিমিলার রয়, কিন্তু এক না।”
“কেনো?”
“তুমি এমেরিকায় রয়ে যাও, কেউ খেয়ালও হয়তো করবে না তোমার ধর্ম কি। তোমার যে সাদা একসেন্ট বানাইসো ঘষেপিটে, কেউ টেরও পাবেনা তুমি ইমিগ্র্যান্ট। আর ধর্ম তো চাইলে বদলায়েও ফেলতে পারবা। তোমার যাবার অনেক দেশ আছে, কোথাও গিয়ে মিশে যাইতে পারবা। কিন্তু আমি কই মিশবো? আমি যেখানেই যাই ব্ল্যাকই থাকবো। এমনকি আফ্রিকাতে গেলেও ডার্কস্কিন লাইটস্কিল হিসেবে আমি ডার্কস্কিনই থাকবো। তাই আমার চামড়ার ভেতরেই আমার বাঁচতে হবে। আমার পালানোর কোন জায়গা নাই।”
এরপর একটু থামলো আমা বোয়াটেং। চোয়ালটা একটু শক্ত করে বললো, “আর আমি পালাইতে চাইও না।”
যে ছেলেমেয়েরা পুলিশের গুলি ভয় পায়না, এফবিআইয়ের কোইন্টেলপ্রো ভয় পায়না, প্রতিমুহুর্তের উপহাস, করুণা, বিদ্রুপ ভয় পায়না–তাদের সাথে বড় হয়ে আমি একটু বড় আওয়াজে কথা বলতে পারবোনা? এতোটুকু তো আমার পারা উচিত।
এতোটুকু যাতে আমি পারি। আমি যাতে কখনও পালিয়ে না যাই।
নিজেকে সেটা মনে করিয়ে দেবার জন্যেই বারবার এই কথাগুলো লিখে রাখি।
“আর আমি পালাইতে চাইও না।”
অনুপম দেবাশীষ রায়, সংগঠক মুক্তিফোরাম