সরকার ব্যবস্থার সংস্কার ও প্রস্তাবিত নির্বাচনী ব্যবস্থা:

শুধু ভোট দিতে পারা আর প্রকৃত একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে পারার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জনমত সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হতে হবে। যার যতটুক জনসমর্থন সে রাজনৈতিক ভাবে ঠিক ততটুক গনপ্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে। আর কোনো নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে যদি সেই জনমতের প্রতিফলন না হয় তাহলে সেই নির্বাচনকে আমরা এক ধরনের গননির্বাচন তো বলতেই পারি, কিন্তু গণতান্ত্রিক নির্বাচন কোনো ভাবেই বলতে পারি না।

একটা উদাহরন দেই। ২০০১ এর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি পায় ৪১.৪ শতাংশ ভোট আর আওয়ামীলীগ পায় ৪০.২ শতাংশ ভোট। কিন্তু সংসদে আসন পায় বিএনপি ১৯৩ টি আর আওয়ামীলীগ পায় ৬২ টি। |নির্বাচন তো মোটামোটি অবাধ ও সুষ্ঠই হয়েছিল, কিন্তু আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাটাই এমন যে জনমতের প্রতিফলন সংসদে হয়নি।

প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্যে দরকার সরকার ব্যবস্থার সংকৃতি ও একি সাথে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কৃতি।

বিভিন্ন নির্বাচনী ব্যবস্থার যে সকল সমস্যা তার খুব সৃজনশীল সমাধান দেয় একক হস্তান্তর যোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা অথবা এসভিটি এবং সরকার ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দায়বদ্ধতার সৃষ্টি করে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা। সংসদে হাউস থাকবে একটির বদলে দুটি। আপার হাউস ও লোয়ার হাউস। আপার হাউসে সদস্য ৩০০ জন, লোয়ার হাউসে সদস্য ২০০ জন। এইরকম দুই হাউস সমৃদ্ধ সংসদকে ইংরেজিতে বলা হয় বিক্যামেরাল সংসদ। আর যেই সরকার এইরকম সরকার ব্যবস্থার অনুসারী সেই সরকারকেই বলা হয় ফেডারেল সরকার। বিশ্বের অনেক দেশেই এই ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও জার্মানি। লোয়ার হাউসের সংসদ সদস্যরা জাতীয় পর্যায়ে জনগনের প্রতিনিধিত্ব করবে। পুরো দেশব্যাপী একটি নিবাচনের মাধ্যেমে এই ২০০ প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। যেই দল জাতীয় পর্যায়ে যেই শতাংশ ভোট পেয়েছে সেই দল সংসদে ঠিক সেই শতাংশ আসন পাবে। এটা অবশ্য এসভিটি না। এই নির্বাচনী ব্যবাস্থাকে ইংরেজিতে বলে প্রপোর্শনাল রিপ্রেসেন্টেশন। বাকি ৩০০ সদস্য নির্বাচিত হবে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যেমে। এই স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্থানীয় জনগনের প্রতিনিধিত্ব করবে। স্থানীয় সিদ্ধান্তের মূল কর্তৃত্ব থাকবে তাদের হাতে। এতে করে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন ও ভারসাম্যের সৃষ্টি হবে। এই ৩০০ সাংসদ নির্বাচিত হবে এসভিটির মাধ্যেমে।

বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার সমস্যা ও এসভিটি:

১.) আমাদের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে আমরা প্রায়ই বাধ্য হই আমাদের সব চেয়ে পছন্দের দলকে সমর্থন না দিয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দের দলকে সমর্থন দিতে। শুধুমাত্র উধাহরণ হিসাবে বলছি: ধরুন কোনো এক আসনে বিএনপির একজন প্রার্থী, জাতীয় পার্টির একজন প্রার্থী ও আওয়ামীলীগের একজন প্রার্থী মনোনীত হয়েছে। এখন আপনি ধরুন প্রকৃত পক্ষে জাতীয় পার্টির সমর্থক তার মানে আপনি হয়তো বিএনপির চেয়ে আয়ামীলীগকেই বেশি সমর্থন করেন। এখন আপনি জানেন যে এই আসনে আসলে জাতীয় পার্টির পক্ষে জয়যুক্ত হওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব না। জাতীয় পার্টিকে ভোট দিলে আওয়ামীলীগের ভোট নষ্ট হবে ও বিনপি জয়যুক্ত হবে। এই কারনে আপনি বাধ্য হলেন আপনার পছন্দের দলকে ভোট না দিয়ে আপনার সব চেয়ে অপছন্দের দলকে জয়যুক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে আওয়ামীলীগকে ভোট দিতে। এই ভাবেই প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে বহুদলীয় রাজনীতি পরিনত হয় দ্বিদলীয় রাজনীতিতে। এসভিটি নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে আপনি আপনার পছন্দ অনুসারে দলগুলোর অথবা প্রার্থীদের একটি তালিকা করে দিবেন। আপনার সব চেয়ে পছন্দের প্রার্থী এক নম্বর অবস্থানে, দ্বিতীয় প্রার্থী দুই নম্বর অবস্থানে ইত্যাদি। আপনার পছন্দের প্রার্থী জয়যুক্ত না হলে আপনার ভোট চলে যাবে আপনার দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থীর কাছে। এই নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে আপনি নির্দ্বিধায় আপনার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। আপনার ভোটের কারনে আপনার অপছন্দের প্রার্থীর জিতে যাওয়ার কোনো সম্ভবনা থাকবে না। তাছাড়া বহুদলীয় রাজনীতিও বহাল থাকবে এই নির্বাচন ব্যবস্থার অধীনে।

২.) বিভিন্ন দেশেই দেখা যায় নির্বাচিনী আসনের ম্যাপ প্রায়ই পরিবর্তন করা হয় যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দল চায় পরিবর্তনটা এই ভাবে করতে যেন ওই আসনে নির্বাচনে তারাই জয়ী হয়। এই কাজটাকে ইংরেজিতে বলা হয় জেরিম্যান্ডারিং। স্থানীয় নির্বাচনে জেরিম্যান্ডারিং সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা কখনোই সম্ভব না। কিন্তু এসভিটির অধীনে জেরিম্যান্ডারিংয়ের মাধ্যমে অসাধু কোনো ধরনের সুবিধা লাভ করা আরো কঠিন। প্রত্যেক আসনে পৃথক নির্বাচনের প্রথা বাদ দিয়ে প্রত্যেক তিনটি আসনে একটি নির্বাচন হবে। এই তিন আসনের জনগন এসভিটি ভোটের মাধ্যমে যেই তিন প্রার্থীকে এগিয়ে রাখবে সেই তিনজন জয়ী ঘোষিত হবে। যে কোনো দল তিন আসনে তিন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে পারবে।

৩.) প্রতিটি প্রার্থির জয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে ১০০ শতাংশের ৩ ভাগের ১ ভাগ, অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ ভোট। কেউ যদি ৩৩ শতাংশ ভোটারের প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে নির্বাচিত হতে পারে তাহলে সে একবারেই জিতে যাবে। কিন্তু তার ভোট ধরা হবে ৩৩ শতাংশই| ৩৩ শতাংশের উর্ধে যেই ভোট উনি পেয়েছেন তা চলে যাবে তার ভোটারদের দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থীর কাছে। এই প্রথা যদি আমরা অনুসরন না করি তাহলে কিন্তু আমরা জনগণকে জনপ্রিয় প্রতিনিধিকে সমর্থন দেওয়ার জন্যে এক ধরনের শাস্তি দিচ্ছি। ৩৩ শতাংশের উর্ধের ভোটটা কিন্তু নষ্ট হচ্ছে। একটা উদাহরন দেখি। ধরুন কোনো এক আসনে ৬৬ ভাগ ভোটারই আওয়ামীলীগ আর জাতীয় পার্টির সমর্থক। কিন্তু এদের মধ্যে সবার প্রথম অগ্রাধিকার আওয়ামীলীগ আর দ্বিতীয় অগ্রাধিকার জাতীয় পার্টি। ১৬ শতাংশ বিএনপির এক প্রার্থীকে সমর্থন করে আর ১৮ শতাংশ বিএনপির অন্য প্রার্থীকে। আমাদের প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে এই তিন আসনে আওয়ামীলীগ+জাতীয় পার্টি মিলে দুই তৃতীয়াংশ সমর্থন নিয়ে পাবে এক তৃতীয়াংশ আসন আর এক তৃতীয়াংশ সমর্থন নিয়ে বিএনপি পাবে দুই তৃতীয়াংশ আসন। প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন এই নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে হলো না। কিন্তু এসভিটির অধীনে, ৬৬ শতাংশ ভোটার জাতীয় পার্টিকে দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে রেখে আওয়ামীলীগকে ভোট দেবে। আওয়ামীলীগের ৩৩ শতাংশ হয়ে যাওয়ার পর বাকি ৩৩ শতাংশ ভোট দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে পাবে জাতীয় পার্টি। হয়ে গেলো দুই প্রার্থী। বিএনপির ৩ প্রার্থীর মধ্যে ধরুন এক প্রার্থী কোনোই ভোট পায়নি এবং বাকি দুই প্রার্থীর একজন পেয়েছে ১৬ শতাংশ (যাদের ভোটারদের সবার দ্বিতীয় অগ্রাধিকার বিনপির অন্য আর এক প্রার্থী যে ১৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে), আর একজন পেয়েছে ১৮ শতাংশ (যার ভোটারদের সবার দ্বিতীয় অগ্রাধিকার বিএনপির অন্য প্রার্থী যিনি পেয়েছেন ১৬ শতাংশ ভোট)। প্রথমে কোনো ভোট না পাওয়া বিএনপি প্রার্থী বাদ পরবেন, তারপর বাদ পড়বেন ১৬ শতাংশ ভোট পাওয়া প্রার্থী যার ভোটগুলি চলে যাবে তার ভোটারদের দ্বিতীয় অগ্রাধিকারের কাছে এবং ওই প্রার্থীর মোট ভোট সংখ্যা গিয়ে দাড়াবে ৩৪ শতাংশে। প্রতিফলিত হবে প্রকৃত জনসমর্থন।

৪.) প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থার আর একটা গুরুতর সমস্যার ইংরেজি নাম হচ্ছে স্পয়লার ইফেক্ট। কোনো আসনে যদি আপনার জাতীয় পার্টি সব চেয়ে পছন্দের প্রার্থী হয় এবং বিএনপি সব চেয়ে অপছন্দের হয়, কিন্তু ওই আসনে যদি বিএনপি আর আওয়ামীলীগই সব চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয় তাহলে আপনার পছন্দের প্রার্থী যতই ভালো করবে, আপনার সব চেয়ে অপছন্দের প্রার্থীর, অর্থাৎ বিএনপির প্রার্থীর জিতে যাওয়ার সম্ভবনা ততই বেড়ে যাবে। এসভিটির অধীনে এই সমস্যারও সমাধান মিলে।

অবশ্য শুধুমাত্র ভোট দেওয়ার প্রথার সংস্কার করলেই চলবে না। এর পাশাপাশি দরকার ভোট গ্রহন ও গণন প্রথার সংস্কার। তাই দরকার ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোট গ্রহন ও গণন। তা নিয়ে না হয় পরবর্তী এক পোস্টে আলোচনা হবে।

বিঃদ্রঃ- বিএনপি, আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির নামগুলো এখানে শুধুমাত্র বোঝানোর জন্য উদাহরণ স্বরুপ দেওয়া হয়েছে।

শামস্ ইশতিয়াক রহমান, সম্পাদক মুক্তিফোরাম।

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply