রিচার্ডের ওপর মামলা নিয়ে মির্জা ফখরুলের নিন্দা কি রাজনীতির নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দেয়?
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষণবিরোধী মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান খান রিচার্ডের (তার সাথে আরও কিছু বাম ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত নেতৃবৃন্দের) বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কর্তৃক মামলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বিশেষত, এই ইস্যুতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিন্দা জানানোর বিষয়টি একটি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত বহন করতে পারে। যদিও বিষয়টি তেমন বড় কোনো রাজনৈতিক ঘটনা নয়, তবে এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের পথ দেখাতে পারে। এর থেকে আমরা একটি আভাস পেতে পারি যে বিএনপি হয়তো আসন্ন নির্বাচন বা তদসংশ্লিষ্ট রাজনীতির জন্য বামদিকে কিছুটা হলেও ঝুঁকতে পারে। আর তা করলে এটি তাদের জন্য একটি বুদ্ধিমান রাজনৈতিক প্রকল্প হতে পারে, বিশেষত যদি তারা এটি করতে গিয়ে তাদের বান্ধা ভোট না হারান।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তার অবস্থান পুনর্নির্ধারণের চেষ্টা করছে। গত কয়েক বছরে বিএনপির রাজনীতি ছিল মূলত প্রতিরোধ ও আন্দোলনভিত্তিক। সেই স্বার্থে তারা ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল দলের সাথে একসাথে নানান সময়ে কাজ করবার চেষ্টা করেছে। সেই তালিকায় যেমন ডানপন্থী দল ছিলো, তেমনি ছিলো বামপন্থী দলগুলো। তবে, তারা যদি দীর্ঘমেয়াদে নতুন বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে ভোটের রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায়, তবে তাদের কৌশলগত অবস্থান পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। এই প্রসঙ্গে, বামপন্থী বা মধ্য-বাম শক্তিগুলোর প্রতি বিএনপির সদয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার সম্ভাবনা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে দুটি প্রধান শক্তি—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, তৃতীয় রাজনৈতিক বিকল্পের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এনসিপির মতো দলগুলো মধ্যপন্থী রাজনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও বাস্তবে তারা মূলধারার ভোটের রাজনীতিতে কতখানি প্রভাব ফেলতে পারবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলি বরাবরই ডানপন্থী রাজনীতি করে যাচ্ছে। ফলে, মধ্য-বাম চিন্তাধারার একটি ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভোটার গোষ্ঠী এমন একটি শক্তির খোঁজ করছে যা একদিকে গণতন্ত্রের পক্ষে থাকবে, আবার অন্যদিকে সরাসরি আওয়ামী লীগের সমর্থক বা ‘দালাল’ হবে না।
এই প্রেক্ষাপটে, বিএনপি যদি বামধারার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে, তাহলে এটি তাদের জন্য একটি কৌশলগত বিজয় হতে পারে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী বলয়ের বাইরের মধ্য-বাম চিন্তাধারার মানুষের সংখ্যা সামগ্রিক জনসংখ্যার শতকরা ভাগ হিসেবে বিচার করলে তুলনামূলক কম হলেও, যারা আছে তাদের সাংস্কৃতিক পুঁজি (Cultural Capital) অত্যন্ত শক্তিশালী। এই গোষ্ঠীর প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক এবং সামাজিক আন্দোলনকর্মীরা রাজনৈতিক ডিসকোর্সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যদি বিএনপি তাদের সমর্থন অর্জন করতে পারে, তবে তারা শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতিতে নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ও নীতিগত শক্তি হিসেবেও একটি অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
বিএনপির জন্য সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল হতে পারে গণতন্ত্র মঞ্চ এবং অন্যান্য মধ্য-বাম দলগুলোর সাথে একটি নৈতিক ও কৌশলগত জোট গঠন করা এবং সম্ভব হলে তাদের সাথে একটি নির্বাচনী জোটের কথা চিন্তা করা। এটি শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতিতে তাদের শক্তিশালী করবে না, বরং তাদের গণতান্ত্রিক ও অধিকারকেন্দ্রিক ইমেজও মজবুত করবে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, কেবলমাত্র আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয়। বরং বিএনপিকে বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যেখানে তারা শুধুমাত্র আন্দোলনভিত্তিক নয়, বরং নীতি ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতির দিকেও মনোযোগ দেবে।
তবে, বিএনপির জন্য এই পথচলা সহজ হবে না। তাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, বামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সদয় হতে গিয়ে যেন তারা তাদের মূল ভোটার ভিত্তি, অর্থাৎ ডানপন্থী ও রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ভোটারদের বিচ্ছিন্ন না করে ফেলে। বিএনপির ভোটাররা সাধারণত ঐতিহ্যগতভাবে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং জাতীয়তাবাদী পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই, যদি বিএনপি অতিমাত্রায় বামমুখী হয়ে পড়ে, তবে এটি তাদের রক্ষণশীল ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে এবং তারা হয়তো জামায়াত বা অন্য ইসলামপন্থী দলগুলোর দিকে ঝুঁকবে।
অন্যদিকে, যদি বিএনপি এই ধরণের নিন্দা ও সমর্থনের রাজনীতি কেবলমাত্র সরকারের সমালোচনার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলেও এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ কৌশল হতে পারে। কারণ, এটি দেখিয়ে দেয় যে বিএনপি শুধু নিজেদের রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য নয়, বরং সাধারণ নাগরিকদের ন্যায়বিচারের দাবিতেও সরব। এতে করে বিএনপির গণতান্ত্রিক ইমেজ আরও দৃঢ় হবে এবং এটি তাদের সরকারের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির এই নতুন রাজনৈতিক কৌশল কি শুধুমাত্র সাময়িক নীতি, নাকি এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ? যদি এটি শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা করার জন্য করা হয়, তবে এটি সাময়িক আলোচনার বিষয় হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসূ হবে না। তবে, যদি এটি সত্যিকার অর্থে একটি কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, তাহলে এটি বিএনপির জন্য একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক পদক্ষেপ হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান প্রজন্ম আগের মতো কেবল দলীয় রাজনীতির প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখায় না। তারা অধিকারের প্রশ্নে সরব এবং দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিচার বিশ্লেষণ করতে চায়। তাই বিএনপি যদি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে এবং গণতন্ত্র ও অধিকারভিত্তিক রাজনীতির দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে এটি তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হতে পারে। যে তরুণ ভোট এনসিপি নিজের করে ভাবতে চাইছে, যদি রাজনৈতিক সমীকরণে বিএনপি কিছু বুদ্ধিমান পদক্ষেপ নিতে পারে, তবে সেই ভোটের একটি বড় অংশ তারা হয়তো নিজেদের করে নিতে পারবে।
ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ইস্যুতে বিএনপির মহাসচিবের নিন্দা জানানোর ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহে একটি নতুন দিক নির্দেশনা দিতে পারে। এটি শুধুমাত্র একটি প্রতিবাদ বা সরকারের সমালোচনার কৌশল নয়, বরং এটি মধ্য-বাম রাজনৈতিক শক্তির সাথে বিএনপির সম্পর্কোন্নয়নের একটি সূচনা হতে পারে। তবে, বিএনপিকে অবশ্যই কৌশলগতভাবে তাদের অবস্থান ঠিক করতে হবে যাতে তারা তাদের মূল সমর্থন হারিয়ে না ফেলে। ভবিষ্যতে এই ধরণের আরও পদক্ষেপ বিএনপির রাজনীতির দিকনির্দেশনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারে এবং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যে নতুন পরিবর্তন আনতে পারে।
অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিপত্রের প্রধান সম্পাদক ও ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের পিএইচডি শিক্ষার্থী।
Leave A Reply