আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অব্যবহিত পরেই আমরা এক চিরাচরিত প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম- নারী ও পুরুষ সমান কি না?
২০২৫ সালে এসেও এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। এটি এক বাক্যে স্বীকৃত একটি বিষয় যে নারী- পুরুষ সকলেই সমান অধিকারের অধিকারী। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে নারী-পুরুষের জীবনযাত্রা, কর্মক্ষমতা ও দায়িত্ব ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে যখন প্রশ্ন আসে নারী ও পুরুষ সমান কিনা তখন আমরা বিবেচনা করি নারী ও পুরুষ অধিকারের প্রশ্নে সমান কিনা। এর উত্তর হচ্ছে , হ্যাঁ। নারী ও পুরুষ আলাদা সত্ত্বা হলেও আইনের দৃষ্টিতে নাগরিক হিসেবে সবাই সমান এবং সমান অধিকার লাভ করবে।
লিঙ্গ সমতা মানে এই নয় যে নারী ও পুরুষ সম্পূর্ণ একরকম। বরং, এটি নিশ্চিত করা যে প্রত্যেককে সমান মর্যাদা ও সুযোগ দেওয়া হবে, যাতে তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায় (UDHR) বলা হয়েছে, “সকল মানুষ স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারে সমানভাবে জন্মগ্রহণ করে।” অর্থাৎ, লিঙ্গ সমতা হলো একটি মৌলিক অধিকার, যা সবার জন্য প্রযোজ্য। এর মানে, সবাই শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাবে, শুধু লিঙ্গের কারণে কেউ পিছিয়ে থাকবে না।
বাংলাদেশের সংবিধানেও নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।”
এছাড়াও সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান নিরাপত্তার অধিকারী।” ২৮(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করিবে।” এই বিধানগুলো নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করে এবং তাদের সমান অধিকার ও সুযোগের নিশ্চয়তা প্রদান করে।
লিঙ্গ সমতা শুধু ন্যায়বিচারের বিষয় নয়, এটি মানুষের মৌলিক অধিকারও। লিঙ্গ বৈষম্য থাকলে সমাজের অগ্রগতি থমকে যায়। উদাহরণস্বরূপ, নারীরা যদি শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ না পায়, তাহলে তাদের প্রতিভা বিকশিত হতে পারে না, যা পুরো সমাজের ক্ষতি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে নারী ও পুরুষ সমান সুযোগ পায়, সেখানকার অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং দারিদ্র্য কমে যায়।
লিঙ্গ সমতা মানে হলো নারী ও পুরুষকে একইভাবে মূল্যায়ন করা, কিন্তু তাদের আলাদা চাহিদাগুলোও বিবেচনায় রাখা
সমাজেও লিঙ্গ সমতার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেখানে নারী ও পুরুষ সমান সুযোগ পায়, সেখানে অপরাধ কম হয়, পরিবারে স্থিতিশীলতা বাড়ে এবং সমাজে শান্তি বজায় থাকে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে লিঙ্গ সমতা অর্জন করতে হবে। এর জন্য নারীদের রাজনীতি, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমান সুযোগ দিতে হবে। যখন নারীরা নেতৃত্বে আসে, তখন নীতিগুলো আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় এবং পুরো সমাজের উন্নতি হয়। যেসব দেশে নারীরা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে বেশি অংশ নেয়, সেসব দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সুরক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে সমাজের সব মানুষ উপকৃত হয়।
নারীদের ক্ষমতায়ন শুধু তাদের জন্য নয়, বরং পুরো দেশের জন্য ভালো। তবে নেতৃত্বে থাকা নারীদেরও সাহসী ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। এনসিপি পার্টির সামান্থা শারমিনের সাম্প্রতিক বক্তব্য লিঙ্গ সমতার প্রতি হতাশাজনক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়। রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তাদের সৎ সাহস থাকতে হবে এই সত্যটি বলার যে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান। নেতৃত্ব মানেই শুধু পদ পাওয়া নয়, বরং ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়ানো।
জামায়াতের মত রক্ষণশীল দল যেখানে বলতে পারে যে নারী-পুরুষকে সমান মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেবে, সেইখানে এনসিপি থেকে সামান্তা শারমিন নারী হয়ে নারী-পুরুষ নিয়ে একবারও সমান কথাটা মুখ দিয়ে বের করতে পারেননি। এটি আসলে ভোটের রাজনীতিকে প্রতিনিধিত্ব করে। একপক্ষের ভোট হারানোর ভয়ে তিনি কৌশলী উত্তর দিয়েছেন, কিন্তু সেই একপক্ষের সংখ্যা কত? তাহলে এনসিপি কি এখন পপুলিস্ট রাজনীতি করবে? সেটাই মনে হয়েছে সামান্তার কথায়।
তার এই লুকোচুরি ও অস্পষ্টতা জাতীয় নাগরিক পার্টির ইমেজের জন্যে ক্ষতির কারণ হতে পারে। রাজনীতির মাঠে কোনো নির্দিষ্ট পক্ষকে খুশি করার চেয়ে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করাই এনসিপির লক্ষ্য হওয়া উচিত। একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে এনসিপিকে অবশ্যই সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
সাম্য মানে সবার জন্য একরকম সুযোগ বা সুবিধা নিশ্চিত করা, যেখানে সমতা মানে ব্যক্তির নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া যাতে তারা সত্যিকার অর্থে সমান সুযোগ পায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন অন্ধ ব্যক্তি এবং একজন সুস্থ ব্যক্তি সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার জন্য একই ব্যবস্থা পান, তবে এটি সাম্য হতে পারে, কিন্তু সমতা তখনই নিশ্চিত হবে যখন অন্ধ ব্যক্তির জন্য বিকল্প ব্যবস্থা, যেমন র্যাম্প বা লিফট, রাখা হবে।
তাই, লিঙ্গ সমতা মানে হলো নারী ও পুরুষকে একইভাবে মূল্যায়ন করা, কিন্তু তাদের আলাদা চাহিদাগুলোও বিবেচনায় রাখা।
অপরাজিতা দেবনাথ ঢাকা জজ কোর্টের একজন অ্যাডভোকেট
Leave A Reply