বর্তমানে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর মাঝে এক ধরনের মতের অনৈক্য থেকে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, যা বহুল প্রতীক্ষিত জাতীয় ঐক্যমতের পথকে কঠিন করে তুলেছে।
পাল্টাপাল্টি বক্তব্য
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার সভার যথাক্রমে পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। নাহিদ ইসলাম রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন আগামী নির্বাচন হবে একই সাথে রাষ্ট্র পরিচালনার ও সংবিধান সভার নির্বাচন। তবে তা কেমন করে সম্ভব হবে, তার কোন রূপরেখা তিনি দেননি।
অপরদিকে, সালাহ উদ্দিন আহমদ এই প্রস্তাব নাকচ করে জানিয়েছেন তার দল বিশ্বাস করে যে আগামী নির্বাচন কেবল আইনসভার নির্বাচন হবে এবং সেই আইনসভাই সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে।
এই রাজনৈতিক মতানৈক্য আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবলমাত্র ক্ষমতার হাতবদলের জন্য হয়নি। এটি হয়েছে রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে। শেখ হাসিনার নির্মম একনায়কতন্ত্র আমাদেরকে শিখিয়েছে যে পুরাতন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে কেউই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। কাজেই আমাদের সামনে এগোনোর জন্য এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন যেটি নিশ্চিত করবে যে কেউ আর কোনদিন বাংলাদেশে একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে পারবে না।
সেটি করার জন্য সংবিধানের আমূল পরিবর্তন জরুরি। কেবলমাত্র কাগুজে পরিবর্তনের জন্য নয়, নয়া সংবিধানে যদি ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যবস্থা করা যায় তবে তা হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে তার জনগনের নতুন এক ধরণের রাজনৈতিক চুক্তির সামিল, যা কিনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
সমাধান
তাই এই রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে সমাধান করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে বিএনপির ৩১ দফার আলোকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নির্মান করে উচ্চকক্ষকে সংবিধান সংস্কারের ভার দেয়া ও নিম্নকক্ষকে অপরাপর আইন তৈরির সভা হিসেবে গড়ে তোলা। আমি মনে করি এটি করার জন্য একই সাথে দুইটি প্রত্যক্ষ নির্বাচন করা যেতে পারে যেখানে যেমন নিম্নকক্ষের ৩০০ আসনের জন্য নির্বাচন হবে, তেমনি উচ্চকক্ষের একটি নির্দিষ্টসংখ্যক আসনের জন্যেও প্রত্যক্ষ নির্বাচন হবে।
এই উচ্চকক্ষ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে একটি সংস্কারকৃত সংসদের রূপরেখা হাজির করবে ও নিম্নকক্ষে এটি নিয়ে ভোটাভুটি করার পরে এই নতুন সংস্কারকৃত সংবিধান জনগণের সামনে গণভোটের জন্য হাজির করবে। জনগণের ভোটের পরে যদি সংস্কারকৃত সংবিধান গণগ্রহণযোগ্য হয়, তবে সেটিই হবে আমাদের রাষ্ট্রের নতুন সংবিধান। তার পরে উচ্চকক্ষ আবার আমেরিকার সিনেটের মতো বা যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের আদলে নিম্নকক্ষের আইনসমূহকে রিভিউ করবে।
কিছু উদাহরণ
সংসদের উচ্চকক্ষ পৃথিবীর ইতিহাসে নানান সময়ে সংবিধান সংস্কারের কাজ করে এসেছে। যেমন ১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে আর্টিকেলস অফ কনফেডারেশনকে প্রতিস্থাপিত করে। যুক্তরাজ্য ১৯১১, ১৯৪৯ ও ১৯৯৯ সালে হাউজ অফ লর্ডসের মাধ্যমে গভীরভাবে সাংবিধানিক সংস্কারের নিমিত্তে পার্লামেন্ট অ্যাক্ট পাশ করার মাধ্যমে নিজেদের অতিরিক্ত ক্ষমতাকে কমিয়ে আনে।
ফ্রান্সের বর্তমান পঞ্চম প্রজাতন্ত্র তাদের সিনেটের মাধ্যমে অনুমোদিত হয় এবং চার্লস দ্য গলের অধীনে ১৯৫৮ সালে সংবিধানের আমূল পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। জার্মানির ১৯৪৯ সালের বুন্দেসরাত (তাদের উচ্চকক্ষ) যুদ্ধপরবর্তী সংবিধান নির্মানে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। অপরদিকে কানাডার ১৯৮২ সালের কন্সটিটিউশন অ্যাক্ট নির্মাণে কানাডার সিনেট নেতৃত্ব দেয় এবং এর মাধ্যমে তাদের চার্টার অফ রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডম তৈরি হয়।
আমাদের এখন প্রয়োজন এমন একটি চার্টার ও সংস্কারকৃত নতুন একটি সংবিধান যেটি নতুন বাংলাদেশের জন্ম দিতে পারে।
বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত
বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে গৃহীত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত হয়েছে, তবে একটি সুসংগঠিত ও দীর্ঘমেয়াদী সাংবিধানিক সংস্কার এখনো অনুপস্থিত। বর্তমান এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় কাঠামোতে সংবিধান সংশোধনের সকল ক্ষমতা এককভাবে জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত, যা নানান সময় রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঝুঁকি তৈরি করে। তাই, একটি উচ্চকক্ষ গঠন করে তাকে সংবিধান সংস্কারের দায়িত্ব প্রদান করা হলে তা অধিকতর ভারসাম্যপূর্ণ, দীর্ঘমেয়াদী এবং গণতান্ত্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
উচ্চকক্ষ গঠনের ফলে সাংবিধানিক সংশোধন ও সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদী ও নিরপেক্ষ পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় যে কোনো সরকার সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে সহজেই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে। ফলে সংবিধান রাজনৈতিক দলের স্বার্থে পরিবর্তিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উচ্চকক্ষ থাকলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুচিন্তিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার সম্ভব হবে।
বর্তমান ব্যবস্থায় যে কোনো সরকার সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে সহজেই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে। ফলে সংবিধান রাজনৈতিক দলের স্বার্থে পরিবর্তিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উচ্চকক্ষ থাকলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুচিন্তিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার সম্ভব হবে।
এককক্ষবিশিষ্ট সংসদে আইন প্রণয়ন দ্রুত সম্পন্ন হলেও সেটি অনেক সময় রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। উচ্চকক্ষ গঠিত হলে নিম্নকক্ষ কর্তৃক প্রণীত আইনের ওপর একটি গভীর পর্যালোচনার সুযোগ থাকবে এবং আইনটি রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপন্থী কিনা, তা মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।
উচ্চকক্ষের দায়িত্ব
উচ্চকক্ষের মূল দায়িত্ব হবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো রক্ষা করা এবং পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা। এটি নিশ্চিত করবে যে কোনো দল বা গোষ্ঠী নিজেদের স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করতে না পারে। উচ্চকক্ষ গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে একটি কার্যকর মডেল তৈরি করা যেতে পারে। উচ্চকক্ষের সদস্যরা সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি মনোনীত সদস্যও থাকতে পারে, যাতে বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
উচ্চকক্ষের সদস্যদের মেয়াদ নিম্নকক্ষের তুলনায় দীর্ঘতর হওয়া উচিত, যাতে তারা স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক চাপে না পড়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। উচ্চকক্ষের মূল দায়িত্ব হবে সংবিধান পর্যালোচনা, জাতীয় নীতিমালা নির্ধারণ, এবং নিম্নকক্ষের তৈরি করা আইন যাচাই করা।
নিম্নকক্ষ যথারীতি আইনসভা হিসেবে কাজ করলেও সংবিধান সংশোধনের জন্য উচ্চকক্ষের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এর ফলে নিম্নকক্ষের একক সিদ্ধান্তে নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন হবে।
বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী সাংবিধানিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত করতে উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধুমাত্র সংবিধান সংস্কারের একটি কার্যকর প্রক্রিয়া তৈরি করবে না, বরং রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে অধিকতর স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্রের বিকাশ নিশ্চিত করবে। তাই, ভবিষ্যতে একটি উচ্চকক্ষ গঠন করে সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়াকে আরও গ্রহণযোগ্য ও সুসংগঠিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিপত্রের প্রধান সম্পাদক ও ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের পিএইচডি শিক্ষার্থী।
Leave A Reply