বিএনপির কি বামদিকে যাওয়া উচিৎ? ইন্টারনেটে এ প্রশ্নটা বারবার শোনা যাচ্ছে, আর এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে আমাদের দেখতে হবে, বামদিকে যাওয়া আসলে কোনদিকে যাওয়া, আর বিএনপিই বা এত দিক থাকতে বাম দিকে কেনো যাবে?
বাম দিকটা কোথায়?
বাম রাজনীতি সম্পর্কে বাংলাদেশে যে ভুল আর অধিমিশ্রিত ধারণাটি আছে, সেটি মূলত সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের বামপন্থীদের সেকুলার রাজনীতি এবং আওয়ামী তোষণের ভেতর দিয়ে। লক্ষ্য করে দেখবেন, বাংলাদেশে বামপন্থী হিসেবে প্রথম যে বৈশিষ্ট্য মিডিয়াতে, বইয়ে, সমাজের নানা স্তরে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা হলো বামপন্থীরা সেকুলার এবং নাস্তিক। এবং এই ধারণার জন্যে বাংলাদেশের আমজনতার পড়াশোনার অভাবকে দায়ী করাও যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের বাম রাজনীতির বিভিন্ন দল একদিকে নিজেদের কট্টরভাবে মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী ইত্যাদি দাবী করলেও, তাদের পরিমণ্ডলটি ঐতিহাসিকভাবে হয়ে এসেছে একটি সাংস্কৃতিক সামাজিক গ্রুপ, যাদের শ্রমিক বা কৃষকের অর্থনীতি সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহী না হলেও চলে।
জানি, অনেক মার্ক্সবাদী দল এই কথাটুকুর প্রতিবাদ করবেন, কিন্তু এটা অস্বীকার করা অসম্ভব যে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলো যে কয়বার গর্জে উঠেছে, শ্রেণীশত্রু খতম করতে তাদেরকে ততটা ব্যাতিব্যস্ত দেখা যায়নি। এর সাথে যোগ হয়েছে নব্বইয়ের দশকের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) রাজনীতি, যার সদস্য ছিলেন বামপন্থী নেতৃত্বের অনেকেই এবং যা জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর কার্যত আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যেতে শুরু করে। ফলে, অনেক দেশেই বামপন্থী রাজনীতি মূলত নারীদের রাজনীতি বা ইমিগ্র্যান্টদের রাজনীতি হলেও, বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতি কখনো রোহিঙ্গা রাজনীতি বা নারীর রাজনীতি হয় নাই, নারীদের সাথে কথা বলার সময়েও ফ্রেম হয়েছে রাষ্ট্র থেকে ধর্মের পৃথকীকরণ।
এই সমস্যা অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য স্থানেও আছে, যেমন ভারত রাষ্ট্রের অনেক প্রদেশেই বামপন্থী রাজনীতি এই ধরনের নির্ধার্মিক অবস্থানের কথা বলে। এতে লাভ যারই হোক, ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশে বামধারার রাজনীতির। বিএনপি বামদিকে যাবে কি না প্রশ্ন করলেই প্রথম যে পাল্টা প্রশ্নটা চলে আসে, সেটা হলো, বিএনপি কি এইবার নাস্তিক হয়ে যাবে?
বিএনপির কিছু অদ্ভুত সমস্যা
জনশ্রুতি আছে যে জিয়াউর রহমান একবার বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্মিকে আদেশ দিয়েছিলেন, বিদেশী কিছু নাগরিককে কিছু ধার্মিক ব্যক্তি আক্রমণ করলে ওই এলাকার সকল লেবাসধারী ব্যক্তিকে পাল্টা আক্রমণের জন্য। এতে অবশ্য লাভ হয়নি। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বিএনপির আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া, কিন্তু তবুও সেকুলার মধ্যবিত্ত অংশটির মন বিএনপি জয় করতে পারেনি। এর কারণ নানাবিধ হলেও, আওয়ামী লীগের ভেতর ঘাদানিকের ঢুকে যাওয়া (১৯৯৬ থেকেই), এবং সেই আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর জোটবদ্ধ নির্বাচন বিএনপির প্রতি সেকুলারদের অবজ্ঞা আর ঘৃণার অন্যতম কারণ।
এক্ষেত্রে অবশ্য জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বকেও সাধুবাদ দিতে হয়, কারণ খেয়াল করবেন, পৃথিবীর কেউ কখনো আওয়ামী লীগ-ওয়ার্কার্স পার্টি বা আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আছে, এ কথা বলেনি, কিন্তু বিএনপি-জামায়াত হয়ে গেছে দ্বন্দ্ব সমাসের একটি আদর্শ উদাহরণ।
এর অর্ধেক যদি আওয়ামী মিডিয়ার কারণে হয়েও থাকে, বাকি অর্ধেক হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক সক্ষমতার কারণে। বিএনপি একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক দল, যার সংখ্যাগুরু তোষণের একটা ঝোঁক আছে, এবং যার অর্থনীতি কিঞ্চিৎ সংকোচনবাদী, কিন্তু পুরোটা নয়, ফলে সাবমেরিন ক্যাবলে ২০০১-০৬ এর বিএনপি সরকার আপত্তি করলেও এশিয়া এনার্জির সাথে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লা উত্তোলনে সে আপত্তি করেনি, বরং আন্দোলনরত জনতার উপর ২০০৬ সালে সেই সরকারের আমলে গুলিও চলেছে।
বিএনপি নিজে বরাবর বলে এসেছে, তারা বামের ডানে, ডানের বামে, কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণেই হোক, বামপন্থীদের থেকে দূরত্বের কারণেই হোক, আর আওয়ামী মিথ্যাচারের জন্যই হোক, বিএনপির পরিচয় হয়েছে মধ্য ডানপন্থী একটি দল হিসেবে। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে হঠাৎ করে আবার কী হলো?
অন্তর্বর্তী শূন্যতা
গত ষোলো বছরে পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে (১১৩২+ মৃত্যু, তথ্যসূত্র আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন বা আইএলও) নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোকে বিব্রত হওয়া থেকে বাঁচাতে আওয়ামী লীগ ঘটিয়েছে একই বছরের ৫ মে, মাত্র এগারো দিনের ব্যবধানে, মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে শাপলা হত্যাকাণ্ড (৬১+ মৃত্যু, তথ্যসূত্র অধিকার)। এই ঘটনাকেও বাংলাদেশের বামপন্থীরা রানা প্লাজার লেন্স থেকে না দেখে দেখেছে শাহবাগ বনাম শাপলার বাইনারী থেকে, সেকুলারিজম বনাম মোল্লাতন্ত্রের লড়াই হিসেবে।
এরপর শেখ হাসিনা কওমী জননী উপাধি পেয়েছেন, জঙ্গি নাটকের মাধ্যমে প্রচুর নিরীহ মাদ্রাসার ছাত্রকে ক্রসফায়ারে দিয়েছেন, একদিকে ক্ষমতাবান হুজুরদের প্রিয় হয়েছেন (শায়খ আহমাদুল্লাহ ও অন্যান্য), অন্যদিকে বিশ্বাসী জনতার (যাদেরকে অনেকে কটাক্ষ করে তৌহিদী জনতা বলেন) বিরাগভাজন হয়েছেন।
ঠিক যেমন একদিকে বামপন্থী কর্মীদেরকে ছাত্রলীগ বছরের পর বছর পিটিয়েছে, আরেকদিকে বামপন্থী নেতারা হাসিনার দফতরের সাথে আনন্দ যাপন থেকে হজ্বে গমন, কিছুই বাকী রাখেন নাই। একদিকে বর্ষীয়ান বামপন্থী নেতারা বলেছেন, শেখ হাসিনা না থাকলে দেশ হয়ে যাবে ইসলামী রাষ্ট্র, আরেকদিকে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছেলেমেয়ে একসাথে দেখা গেলো কেনো, এই দাবীতে মারতে মারতে আধামরা করেছে। তাদের খুন, ধর্ষণের তালিকা লম্বা হয়েছে, যেমন বুয়েটের আবরার ফাহাদকে “শিবির সন্দেহে” ছাত্রলীগের সদস্যেরা খুন করার পাশাপাশি অনেকের মনে থাকার কথা কীভাবে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে বিএনপিকে ভোট দেয়ায় আওয়ামী লীগের একাধিক কর্মী এক নারীকে ধর্ষণ করে (‘ধানের শীষে ভোট দেয়ায় গণধর্ষণ’: দায় নেবে না আওয়ামী লীগ, বিবিসি, ৩ জানুয়ারি ২০১৯)।
পাল্লা দিয়ে লম্বা হয়েছে সামরিক বাহিনী আর পুলিশ বাহিনী কর্তৃক গুম-খুনের লিস্টও।
আর তারপর একদিন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন ভারতে। তৈরী হয়েছে পাল্লার বামদিকে এক ভয়ানক শূন্যতা, কারণ একদিকে ওয়ার্কার্স পার্টি বা জাসদ দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের গায়ে পরজীবী হিসেবে বেঁচে থেকে নিজেদের কোনো স্বাধীন সত্ত্বাও বাকি রাখে নাই, অন্যদিকে সিপিবি বা বাসদের মতন দলগুলোও ভাঙন আর দলছুট সদস্যের যোগান দিতে দিতে এখন সাংগঠনিকভাবে অক্ষম।
আমরা কেউ কেউ নতুন সৃষ্টি হওয়া নাগরিক পার্টিকে মধ্য বাম একটি দল ভাবলেও, তারা একবার সমকামী সদস্যকে নেতৃত্বে আনা আর আরেকবার সেটা বেমালুম অস্বীকার করার চক্রে আটকা পড়ে গেছে মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় বিএনপি কি অল্প একটু হলেও বামদিকে যাওয়ার কথা ভাবছে?
রাজনীতি কোনো পর্যায় সারণী নয়
বিএনপি ডানপন্থী দল, এই চরিত্রায়নে জামায়াতে ইসলামী, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো আর আওয়ামী লীগের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি, বিএনপি তকমাটা নিজের গায়ে বসতে দিয়েছে শুধু। আর ডান থেকে বামে বা বাম থেকে ডানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বারবার গেছে। আর্জেন্টিনার হুয়ান দোমিঙ্গো পেরনের পার্তিদো হুস্তিসিয়ালিস্তা বা জাস্টিসিয়ালিস্ট পার্টি (আগে নাম ছিলো পেরনবাদী পার্টি) বারবার ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে গেছে। প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা হুয়ান দোমিঙ্গো পেরন শুরুতে ছিলেন বামঘেঁষা, দলটি নব্বইয়ের দশকে কার্লোস মেনেমের অধীনে ছিলো নিওলিবারেল ডানপন্থী, কির্চনের দম্পতির নেতৃত্বে শূন্য দশকে তারা আবার গেছে বামদিকে।
বামদিক থেকে ডানদিকে গেছে আয়ারল্যান্ডের ফিয়ানা ফল বা যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান আর ডেমোক্রেটিক পার্টি বিশ থেকে চল্লিশের দশকের মাঝে মূলত নিজেদের অবস্থান অদলবদল করেছে। এখানে আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে বামপন্থা মানেই হুজুরদের বিরোধিতা নয়, তবে ফ্রী স্বাস্থ্যসেবা এবং ধনীদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা বিশ্বজুড়ে বামপন্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লাতিন আমেরিকায় ক্যাথলিক ফাদারদের একটা অংশ হয়েছে বামপন্থী, বিশেষ করে স্প্যানিশভাষী অঞ্চলসমূহে (ব্রাজিলে নয়), ব্রাজিলে আবার বামপন্থীরা হয়েছে সমকামীদের সমর্থক, কিউবার চে আর ফিদেল হয়েছে সমকামীদের বিশাল শত্রু (যারা বিশ্বাস করতে পারছেন না, ইউটিউবে দেখতে পারেন কীভাবে কিউবা তাদেরকে নৌকায় করে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলো)।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে রাজনীতি কোনো পর্যায় সারণী না, বাম বা ডান কোনো ধাতু বা অধাতুর মতন ক্যাটাগরি না, বিএনপি বা লেবার পার্টিও সোডিয়াম বা এলুমিনিয়াম বা কপার না, যে একবার ডান বলে দিলাম মানে কেয়ামত পর্যন্ত সে ডানদিকেই থাকবে, বাম কী, সেটাও বারবার ভাবার সুযোগ আছে।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে রাজনীতি কোনো পর্যায় সারণী না, বাম বা ডান কোনো ধাতু বা অধাতুর মতন ক্যাটাগরি না, বিএনপি বা লেবার পার্টিও সোডিয়াম বা এলুমিনিয়াম বা কপার না, যে একবার ডান বলে দিলাম মানে কেয়ামত পর্যন্ত সে ডানদিকেই থাকবে, বাম কী, সেটাও বারবার ভাবার সুযোগ আছে।
১০ অক্টোবর ২০২৪-এ যখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান সোশাল মিডিয়াতে বলেন, “বাঙালি-অবাঙালি, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, কিংবা সংস্কারবাদী প্রত্যেক নাগরিকের একমাত্র পরিচয় — আমরা বাংলাদেশি”, এটা কি আসলে একটু একটু করে বামদিকে যাওয়ারই ইঙ্গিত?
দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়াতে বাংলাদেশের মানুষ কাকে ভোট দিবে তা আমরা হলফ করে বলতে পারি না, আর এদিকে ইউনিসেফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে দেশের ৩ কোটি ৮০ লক্ষ নারী ১৮ বছরের নীচে বিয়ে করেছেন (বলা ভালো বিয়ে দেয়া হয়েছে), ১৫ বছরের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটি ১ কোটি ৩০ লক্ষ।
বোঝাই যাচ্ছে ১৬ বছর নারী স্বৈরশাসকের রাজত্ব আর বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে আইন থেকে শুরু করে স্কুলের রচনা, বহু কিছু লেখা হওয়ার পরেও বাংলাদেশের একটা বিপুল জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে উন্নয়ন আর আদর্শের এইসব আলোচনার বাইরে। বিএনপি কি করতে পারবে নতুন কিছু?
আওয়ামী লীগের ভোটাররা কি এবার বিএনপিকে ভোট দিবে, যেখানে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সদস্যেরা নিজেরাই এতদিন “লুকিয়ে” ছিলেন আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগের ভেতর? আমরা তাকিয়ে আছি ভবিষ্যতের দিকে।
মিম আরাফাত মানব, স্পেনে বসবাসরত গবেষক ও মুক্তিপত্রের যুগ্ম-সম্পাদক
Leave A Reply