রাজনীতি নিয়ে জরিপে মানুষ কী বলছে সেটা দেখা জরুরি, কিন্তু মানুষ কী বলছে না সেটা দেখাও সমান বা কখনো আরো বেশি জরুরি।
ইনোভিশন কনসাল্টিং সারাদেশে একটা জরিপ করেছে। সেই জরিপে ১০,৬৯৬ জন উত্তর দিয়েছেন। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে – আপনি কি ঠিক করেছেন কাকে ভোট দিবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রায় ৩০% (বা অন্তত ৩,১৪৪ জন) লোক বলেছেন – আমি এখনো ঠিক করি নি। এই ৩০% লোক কারা?
এখন যারা বলেছেন তারা ঠিক করেছেন কাকে ভোট দিবেন – এই রকম ৬,৬৩১ জনকে আবার প্রশ্ন করা হয়েছে – কাকে ভোট দিবেন? এদের মধ্যে ৬৫.৩৭% বলেছেন তারা কাকে ভোট দিবেন। ৩৪.৩% (বা অন্তত ২,২৭৪ জন) বলেছেন যে – আমরা ঠিক করেছি কাকে ভোট দিবো, কিন্তু বলবো না।
১০,৬৯৬ জনের মধ্যে ৩,১৪৪ জন বলেছেন – আমরা এখনো ঠিক করি নি। ২,২৭৪ জন বলেছেন – আমরা ঠিক করেছি, কিন্তু বলবো না।
যারা এখনো ঠিক করে নি কাকে ভোট দিবে (প্রায় ৩০%) – তাদের মধ্যে নতুন ভোটার আছে অনেকে। ২০১৩ থেকে দেশে ভোটের রাজনীতি নেই। নতুন ভোটারদের প্রেফারেন্স গড়ে ওঠে নি। কিন্তু ২০০৮ এর আগে ভোটার হয়েছেন এমন লোকজনের মধ্যেও অন্তত ২৫% লোক আছে যারা বলেছেন – আমি এখনো ঠিক করি নি। এরা কারা?
আবার যারা ঠিক করেছেন যে তারা ভোট দিবেন, কিন্তু বলবেন না কাকে ভোট দিবেন (মোট ভোটারের প্রায় ২১%) – তাদের বয়সভিত্তিক ভাগটা রিপোর্টে দেখলাম না। এই যে প্রায় ৫১% লোক জরিপে বলেছেন যে – আমরা এখনো ঠিক করি নি বা ঠিক করলেও বলবো না। এরা কারা?
এদের মধ্যে অনেক ধরনের লোক থাকতে পারে। অনেক প্রথমবারের ভোটার বা গত ১৫ বছরে প্রথম ভোট না দিতে পারা লোক থাকতে পারেন। দেশে যেহেতু প্রকাশ্যে বিরোধী রাজনীতি অতো করতে দেয়া হয় নি, এরা এখনো জানেন না যে কাকে ভোট দিবেন। এদের মধ্যে এমন লোক থাকতে পারেন যে তারা যেই ধরনের রাজনীতি সমর্থন করেন, বা যেই ধরনের প্রার্থীকে ভোট দিতে চান – সেই ধরনের রাজনীতি বা প্রার্থী এখনো দেখতে পাচ্ছেন না। আপনার মানতে কষ্ট হইলেও, এদের মধ্যে অনেক আওয়ামী লীগের ভোটার থাকতে পারেন।
ধরেন আপনি আওয়ামী লীগের ভোটার। সারাজীবন আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন। আপনার বাসায় অপরিচিত একজন লোক এসে বলছে – “সালাম, আমি ইনোভিশন কনসাল্টিং থেকে আসছি। আমরা বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন নিয়ে একটা জরিপ করছি। আপনার নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হবে না। এই তথ্য আমরা কেবল গবেষণার জন্য ব্যবহার করবো। আচ্ছা, এবার বলেন – আপনি কি ঠিক করেছেন কাকে ভোট দিবেন? ঠিক করলে কাকে ভোট দিবেন?”
ধরেন আপনি আওয়ামী লীগের ভোটার। সারাজীবন আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন। আপনার বাসায় অপরিচিত একজন লোক এসে বলছে – “সালাম, আমি ইনোভিশন কনসাল্টিং থেকে আসছি। আমরা বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন নিয়ে একটা জরিপ করছি। আপনার নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হবে না। এই তথ্য আমরা কেবল গবেষণার জন্য ব্যবহার করবো। আচ্ছা, এবার বলেন – আপনি কি ঠিক করেছেন কাকে ভোট দিবেন? ঠিক করলে কাকে ভোট দিবেন?”
আপনার কি মনে হয় – আওয়ামী লীগের ভোটার নির্ভয়ে উত্তর দিবে? টেকনিক্যাল টার্মে বলতে গেলে – আপনার কি মনে হয় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় উত্তরদাতা তার ‘ট্রু অ্যাটিচুড’ প্রকাশ করবেন? ২০১৫ সালে আমি অনার্সের থিসিসের জন্য ঢাকায় কিছু ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম লোকজনের রাজনীতি-সংক্রান্ত মতামত নিয়ে। তখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করতে লোকজন ভয় পাচ্ছিলো। এখন তার উল্টাটা হচ্ছে না, এটা মনে করার কোনো কারণ নাই।
এখন কতো শতাংশ যে আসলে নতুন আনডিসাইডেড ভোটার, আর কতো শতাংশ যে আসল আওয়ামী লীগের ভোটার – এটা বোঝার উপায় নাই। অন্তত যতোটুকু ফল প্রকাশ হয়েছে সেটা থেকে। অনেক সময়ে লিস্ট চয়েস এক্সপেরিমেন্ট জাতীয় কিছু করে হয়তো কিছুটা বোঝা সম্ভব। জরিপেও একদল উত্তরদাতাকে এক ধরনের প্রশ্ন, আর আরেকদল উত্তরদাতাকে এক্সপেরিমেন্টাল ফ্রেমিং-এ প্রশ্ন করে দেখা যেত, কোন ধরনের প্রশ্নে উত্তরদাতারা তাদের ‘ট্রু অ্যাটিচুড’ প্রকাশ করে।
এগুলো বলার কারণ – এই জরিপের ফলাফল সবাই যেভাবে পড়ছেন বা বিশ্লেষণ করছেন, তাতে এই ব্যাপারটা সবাই বাদ দিয়ে যাচ্ছেন। একটা ন্যাশনালি রিপ্রেজেন্টেটিভ স্ট্র্যাটিফাইড র্যান্ডম স্যামপ্লিং এ করা জরিপে, যদি এখনো এতো নন-রেস্পন্স থাকে, বা প্রেফারেন্স রিভিল না করে রেস্পন্ডেন্ট; এর প্রথম অর্থ হচ্ছে – এই রেস্পন্ডেন্টরা উত্তর দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না, বা ভয় পাচ্ছেন। অর্থাৎ, একটা ভয়ের পরিবেশ আছে। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে – যে ধরনের রাজনীতি তারা দেখছেন গত ৬-৭ মাসে, তাতে তারা তাদের পছন্দের প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল পাচ্ছেন না।
আমি ভুল হতে পারি। কোথায় ভুল জানাবেন। কিছু কি খেয়াল করি নাই? এরকম হলেও জানাবেন।
জরিপ করার জন্য, এবং রিপোর্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার জন্য ইনোভিশনকে ধন্যবাদ। বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনীতিতে, ফেসবুকের লাইক-লাভ-হাহা এর সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এজন্য অনেকে ‘ফেসবুক-তুষ্টি’-মূলক রাজনৈতিক অবস্থান নিচ্ছেন বা মত প্রকাশ করছেন। এজন্য ফেসবুকে রিয়াকশন এবং কমেন্টে সিস্টেমেটিকভাবে বিনিয়োগ হলেও অবাক হবো না। এই ধরনের জরিপ আমাদেরকে সাহায্য করবে ফেসবুক এবং ফেসবুকের বাইরে মানুষজন কী ভাবছেন তা জানতে। তবে এই ধরনের জরিপে – মানুষ কী বলছে তা যেমন জরুরি, কী বলছে না তা দেখাও জরুরি।
ইয়াসিন শাফি পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধ্যয়নরত একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী
Leave A Reply