বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ভারতই শুধু নয়, বরং পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটিও ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং এর বাংলাদেশ সফরের পর থেকেই বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার ঘনিষ্ঠতা উত্তরোত্তর বাড়ছিল। ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দুই ডজনেরও বেশি প্রকল্পে বাংলাদেশকে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে চীন।
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটে’র (এইআই) হিসেবে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাৎসরিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যি প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। বিশাল এই অঙ্কের প্রায় সবটাই আমদানি করে বাংলাদেশ।
একক দেশ হিসেবে চীনের কাছ থেকেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে চীন থেকে পণ্য আমদানি প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে চীন থেকে বছরে যেখানে সাড়ে ছয়শ কোটি মার্কিন ডলারের মতো পণ্য আমদানি করা হতো, এখন সেটি বেড়ে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
আঞ্চলিক বিবেচনায় বাংলাদেশ চীনের বড় রপ্তানির উৎস। “মূলতঃ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কারণেই চীনের কাছে বাংলাদেশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি”, বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।
বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জামও কিনে থাকে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে চীন থেকে দু’টি সাবমেরিনও কিনেছে বাংলাদেশ। ফলে চীনের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
২০২৪ সালের ৮ জুলাই চীন সফরে গিয়েছিলেন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এটি ছিলো তার দ্বিতীয় বিদেশ সফর।
এই সফরে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়ার আশা করছিল বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য যে, পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলি টানেল তৈরির পর তিস্তা প্রকল্পেও যুক্ত হতে আগ্রহী ছিল চীন।
বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব ও বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এ ব্যাপারে বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, “এই পুরো বিষয়টাতে বাংলাদেশের যতটুকু স্বার্থ আছে, চীনের স্বার্থ তার থেকে একটুও কম নয়। তাছাড়া, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকেও চীনের কাছে বাংলাদেশের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।”
এই গুরুত্বের কারণ বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’-কে মোকাবেলা করতে চায় চীন। ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই কৌশল ঘোষণা করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক ও সামরিক উপস্থিতি শক্তিশালী করার কৌশল। এটি মূলত চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা, মুক্ত ও স্বাধীন বাণিজ্য নিশ্চিত করা এবং মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে প্রণীত।
কৌশল মোকাবিলার অংশ হিসেবে চীন বঙ্গোপসাগরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমগ্র পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস করে, ফলে পণ্যের বাজার হিসেবে এই অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এই কৌশল মোকাবিলার অংশ হিসেবে চীন বঙ্গোপসাগরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমগ্র পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস করে, ফলে পণ্যের বাজার হিসেবে এই অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এ ব্যাপারে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গত জুলাইয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজ বলেছিলেন, “আপনি যদি ২০৪০ সালের হিসাব করেন, তাহলে দেখবেন তখন সারা বিশ্বের জিডিপি-র ৪৫ শতাংশের বেশি থাকবে এই অঞ্চলে। দ্বিতীয় যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো- এই অঞ্চল দিয়েই মূলত বৈশ্বিক জ্বালানির একটি বড় অংশের সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।“
বুঝতে কষ্ট হয়না, এ কারণেই বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে এই অঞ্চলের জন্য পৃথক কৌশল ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তবে এরও আগে ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নামের উন্নয়ন কৌশল ও কাঠামো উপস্থাপন করেছিল চীন। এটি বর্তমানে ‘বেল্ট & রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই নামে পরিচিত। বিআরআই এর দুটি প্রধান অংশ:
১. সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট
স্থলপথে চীন, মধ্য এশিয়া, রাশিয়া ও ইউরোপকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা এবং নতুন রেললাইন, মহাসড়ক, গ্যাস ও তেল পাইপলাইন নির্মাণের মাধ্যমে বাণিজ্য সহজতর করা।
২. মেরিটাইম সিল্ক রোড
সমুদ্রপথে দক্ষিণ চীন সাগর, ভারত মহাসাগর ও ইউরোপ পর্যন্ত বাণিজ্য নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। বন্দর নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করা, যেমন: শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর, পাকিস্তানের গওয়াদর বন্দর, গ্রীসের পাইরেয়াস বন্দর ইত্যাদি।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের ৬০ টি দেশের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সরাসরি যুক্ত হতে চায় চীন। চীনের এই মহাপরিকল্পনা নস্যাৎ করতেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি।’
এই কৌশলের অংশ হিসেবে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে কোয়াড নামে নিরাপত্তা জোট গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ফলে বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ আশেপাশের দেশগুলোকে নিজের পক্ষে রাখতে চাইছে চীন।
এক্ষেত্রে চীনকে বাদ দিয়ে জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশকে নিয়ে নিরাপদ অঞ্চল গড়তে চায় যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু বাংলাদেশ এর অংশ হোক, সেটি চায় না চীন। এ ব্যাপারে ২০২১ এর মে মাসেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি বলেছিলেন, “কোয়াডে অংশগ্রহণ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করবে।“
তবে শেখ হাসিনার জুলাই সফরের সময় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেছিলেন, “চীনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচটি মূলনীতি বা পঞ্চশীল চেতনা ও ‘বেল্ট & রোড এনিশিয়েটিভকে সামনে রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে চায় চীন।”
তবে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে চীনের অনিশ্চয়তা ছিলো। তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের চীন সফর এক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবার ইঙ্গিত দিয়েছে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেসব মেগা উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখা ও সব প্রকল্পের জন্য না হলেও কিছু প্রকল্পে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে সম্মতি রয়েছে চীনের।
মূলত সুদের হার কমানো, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো ও প্রকল্পে অর্থায়নের পরিমাণের হার বাড়ানো- সবক্ষেত্রেই প্রকল্প অনুযায়ী চীন সিদ্ধান্ত নেবে বলে মিডিয়াগুলোকে জানিয়েছিলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
এছাড়া, স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করবে চীন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঢাকার পূর্বাচলে এক হাজার শয্যার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে চীন। এই মৈত্রী হাসপাতালটি পরিচালিত হবে চীনা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে।
তবে ঋণের ব্যাপারে ঢাকার অনুরোধ পুরোপুরি রাখতে পারবে না চীন। ক্রেতার অগ্রাধিকারমূলক ঋণ (পিবিসি) ও সরকারি ছাড়কৃত (জিসিএল) ঋণের সুদের হার কমানো ও মেয়াদ ২০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করার বিষয়ে চীন রাজি হলেও সব প্রকল্পের জন্য তা সম্ভব নয় বলে তারা জানিয়েছে।
তবে বাংলাদেশের জনগণের চাওয়ার প্রতি সম্মান রয়েছে ও বিগত সরকারের মতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিও সহযোগিতার মনোভাব রক্ষা করবে বলে জানিয়েছে চীন।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত একজন সাংবাদিক ও লেখক
Leave A Reply