বিশ্বায়ন?
‘যদি হাঁচি দেয় ওয়াশিংটন, সারা দুনিয়ার ঠাণ্ডা লাগে আর যুদ্ধের হুমকির ভয়ে সেই দুনিয়া থরথর করে কাঁপতে থাকে।’ এই কথাটা একটা কার্টুনের নিচে লেখা ছিল। আর এই কথা ও কার্টুন এক সঙ্গে যিনি তৈরি করেছিলেন, তার চাক্ষুস তৎপরতা ও লিপ্ততার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ইতিহাস-নিংড়ানো কৌতুকবোধ। ইতিহাস যে একই সঙ্গে ট্র্যাজেডি, কমেডি ও প্রহসন হতে পারে, তারও প্রমাণ মেলে তারই আঁকিবুকিতে, তার অনেক কার্টুনে।
অগ্রজ কিন্তু কাছের মানুষ ও বন্ধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা মনে পড়ে। লেখক শিবিরের অফিসে তিনি একবার এক আড্ডায় বলেছিলেন, ‘যাকে ইতিহাস বলি, তার পাঠের জন্য প্রয়োজন পড়ে অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঘটনার সম্পর্ক তৈরির কাজ। তবে সেই সম্পর্ক স্থাপন করতে গেলে ঘুম তাড়ানোর জন্য জেগে থাকার কৌশল অবলম্বন করতে হয়।’
‘সবাই কি ভেতরে আছেন? অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। জেগে উঠুন।’ এ ভাবেই হাঁক ছাড়েন মার্কিন সঙ্গীতকার ও অ্যাকটিভিস্ট জিম মরিসন তার এক পপ লিরিকে। মনে পড়ে জাঁক আতালি-এর কথা। ফরাসি-আলজেরীয় তাত্ত্বিক। শুধু তাত্ত্বিকই নন, একই সঙ্গে তিনি অঙ্কশাস্ত্রবিদ, সঙ্গীতকার, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও অ্যাকটিভিস্ট। তার অন্যতম কাজের শিরোনাম _নয়েজ: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মিউজিক_। আতালি-এর এই কাজের মূল কথাটা এভাবে বলে নেওয়া যায়: কোলাহল বা হইচই ছাড়া পরিবর্তন সম্ভব নয়। ইলিয়াসের জেগে-থাকার ও জাগিয়ে রাখার কৌশল, মরিসনের লিরিক চিৎকার আর আতালি’র কাউমাউ ও কোলাহল একই সমতলে যে দুর্দান্ত সংহতি তৈরি করে, তারই নমুনা বিস্তর পাওয়া যায় ওই কার্টুনিস্টের কাজে, যার কথা আগেই বললাম।
এও সত্য যে, আমাদের এই কার্টুনিস্ট শুধু চিৎকারই করেন না; তিনি একই সঙ্গে নৈঃশব্দ্য, চিহ্ন এবং এমনকি প্রতিধ্বনিকেও চালনা করেন কার্টুন থেকে কার্টুনে। আর এভাবেই তিনি বলে দিতে চান আমরা কী ধরনের পৃথিবী ও সময়ের ভেতরে বসবাস করছি। এবং যাকে ওয়াশিংটন ও ওয়াল স্ট্রিট বিশ্বায়ন বলে বুলির তুবড়ি ছোটাচ্ছে এখনও, তা নিয়ে তিনি একের পর এক প্রশ্ন তোলেন।
হ্যাঁ, তিনি বিশ্বায়নেরই গল্প বলেন, নকশার ভেতরেই, রেখার টানে টানে, ব্যঙ্গচিত্রে, ছোট ছোট বাক্যে। মাঝে মধ্যে তার অঙ্কিত রেখাগুলো কিংবা অনায়াস আঁকিবুকি বিস্ফোরণেরও চেহারা নেয় বৈকি। আর এই চেহারাকে চিনিয়ে দেয় ইতিহাস নিজেই। ইতিহাস থেকেই তিনি সংগ্রহ করেন তার কার্টুনের রসদ ও উত্তাপ। এছাড়া তার স্বভাবজাত কৌতুকবোধ তো আছেই। আর এই কৌতুকবোধ সক্রিয় করে তোলে ভাষার ভেতরকার লেনদেন। তার কার্টুনের ওপরের, নিচের, আশপাশের বাক্যগুলো কখনো মিছিল করে, কখনো আবার গেরিলা যুদ্ধ চালায়। এক অর্থে তিনি গেরিলা ব্যঙ্গচিত্রকরও বটে। তীব্র ও তীক্ষ্ণ উপমা এবং রূপক ব্যবহারেও দারুন সিদ্ধহস্ত তিনি। তার ব্যাজস্তুতি ও বক্রোক্তি, তার বাগর্থিক আভাস ও কূটাভাস তার কার্টুনের সুবাদেই লড়াকু হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ, সম্প্রতি তার কার্টুনগুলো আবারো দেখছিলাম ও পড়ছিলাম। তার তাৎক্ষণিক ফলাফল– একদিকে হাসির তোড়, অন্যদিকে মাথার ভেতর জেগে-ওঠা চিত্রকল্পের ভিড়। বিশ্বায়ন নিয়ে তার কার্টুনগুলো কেবল কিছু চিত্রকল্পই ব্যবহার করে না, সেগুলো উসকে দেয় আরো চিত্রকল্প, অসংখ্য চিত্রকল্প।
তাহলে ওই চিত্রকল্পের নিরিখে কি এই বিশ্বায়ন?
বিশ্বায়ন: যিশুর জন্মোৎসব আর কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো, গান্ধীর টাক আর মাওয়ের টুপি, চে গুয়েভারার চুরুট আর সাদা চামড়ায় ট্যাটু-করা ম্যালকম এক্সের ছবি, বব মার্লির জটা চুল আর ম্যাডোনার নিতম্ব হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের আকর্ষণীয় পণ্য।
পণ্য ওড়ে, পণ্য ঘোরে, পণ্য চুমু খায়, পণ্য সেক্স করে, পণ্য এমনকি বিপ্লবের কথাও বলে। পণ্য হোসে মার্তি আওড়ায়, পণ্য জসীম উদ্দীনের কবিতা মুখস্থ বলে।
বিশ্বায়ন? _ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক_ উপহার দিচ্ছে ছবির পর ছবি। ছবির সঙ্গে থাকছে কথাও। এমনি কতগুলো কথা: এক পাঞ্জাবি-পরা মার্কিন ট্যুরিস্ট নয়াদিল্লির এক পানশালায় সময় কাটাচ্ছেন; ক্ষুধার্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে তিনি পাচ্ছেন লেবাননের খাবার। খাবার যখন খাচ্ছেন, একই সঙ্গে শুনছেন ফিলিপাইনি ব্যান্ডের সঙ্গীত। যখন আবার সঙ্গীত শুনছেন, একই সঙ্গে দেখছেন কীভাবে ওই পানশালায় আইরিশ পানীয়-এর বোতলগুলো থরথরে সাজানো আছে। যখন ওই আইরিশ পানীয়তে তিনি ঠোঁট ভেজাচ্ছেন, তার চোখ গিয়ে পড়ছে এক জিন্স-পরা ভারতীয় তরুণীর ওপর। _ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক_ এ মুহূর্তটাকে গোলকায়নের ‘মাল্টিকালচারাল’ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করে ইতিমধ্যেই তাকে চিত্রকল্পময় উৎসবে রূপান্তরিত করেছে।
কিন্তু ওই কার্টুনিস্ট বলছেন, ‘ছবি শুধু দেখায় না, তা লুকিয়ে ফেলার কাজটাও সারে।’
তাহলে কী লুকায় সে? _ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক_-এর আঁকা ওই ‘মাল্টিকালচারাল’ মুহূর্ত উৎপাদন করতে গিয়ে অজস্র মানুষের যে ঘাম ও রক্ত ঝরেছে, তাদের চিহ্নই লুকিয়ে রাখে তাদের ছবিগুলো। কিন্তু ওই কার্টুনিস্ট আবারো জানাচ্ছেন, রক্তের দাগ আসলেই মোছা যায় না; দাগ মোছারও দাগ থেকে যায়। অর্থাৎ চিহ্ন মোছারও চিহ্ন থাকে।
ফিরি আবারো বিশ্বায়নে।
পশ্চিমা সাহিত্যের একজন অধ্যাপক টেক্সটের চাটনি বানাচ্ছেন। কালো নারীবাদী ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের কাছ থেকে তিনি ঝাল নিচ্ছেন, ফল নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে, মাছ নিচ্ছেন গুয়াতেমালার লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট রিগোবের্তা মেঞ্চুর কাছ থেকে, আর ট্রটস্কির কাছ থেকে নিচ্ছেন ভিনেগার। অধ্যাপক সাহেব এগুলো মিলিয়ে-মিশিয়ে গুলিয়ে খাওয়াবেন তার ছাত্রছাত্রীদেরই, যারা আবার পড়াশোনাকে শুধু ‘ফান’ হিসেবেই নিতে চায়। আহ, বিশ্বায়ন! আপনার অশেষ মর্জি!
এই বিশ্বায়ন নিয়ে ওই কার্টুনিস্ট নিজেই একটি রচনা লিখেছেন। সেখানে একটি জায়গায় তিনি বলছেন, ‘মুক্তবাণিজ্যের বিশ্বায়ন এখন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটাচ্ছে। চীন এখনো সমাজতন্ত্রের তকমা এঁটে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে জোগান দিচ্ছে ক্রীতদাসীয় শ্রম; ভারতের একটি ফার্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি করপোরেশনের ফর্ম পূরণ করে দিচ্ছে, যে করপোরেশন আবার পেরুতে ভদকা বানিয়ে তা বিক্রি করছে পোল্যান্ড থেকে আসা ওইসব মানুষের কাছে, যারা ইংল্যান্ডের টাকায় মাদ্রিদে অট্টালিকা তোলার কাজ হাতে নিয়েছে। আরো মজার ব্যাপার হলো, ওই বিশ্বায়নের সুবাদেই আমরা জানতে পারছি মেক্সিকোর নিকৃষ্টতম রাষ্ট্রপতির নাম; নাম তার জর্জ বুশ জুনিয়র।’
তাহলে জর্জ বুশ মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতি? হ্যাঁ, ওই কার্টুনিস্টের মতে, জর্জ বুশই মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতি– নিকৃষ্টতম রাষ্ট্রপতিই বটে। কার্টুনিস্ট বলছেন, তার নিজ দেশ মেক্সিকোর ইতিহাসে তিনি অনেক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রপতির সন্ধান পেয়েছেন বটে, কিন্তু কেউ-ই শক্তিতে বুশের ধারে-কাছে যাওয়ার ক্ষতা রাখেন না। আসলে ওই কার্টুনিস্ট কেবল বুশের কথাই বলছেন না, তিনি দেখাতে চাইছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাম্প্রতিকতম স্তরের ফ্যাসিস্ট চেহারাকেই। আর এই চেহারাই প্রবলভাবে উপস্থিত মেক্সিকোর ভূমিতে।
২
এতক্ষণ আমি যে কার্টুনিস্টের কথা বলছিলাম, তার নাম
এল্ ফিগন্। কিন্তু তার আসল নাম রাফায়েল বারাহাস দুরান। তিনি তার কাজে
ব্যঙ্গ আর প্রতিবাদকে একসঙ্গে ধারণ করেন; প্রথা ও প্রতিষ্ঠানকে তিনি তার
কাজে বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ করেন, চ্যালেঞ্জ করেন। জাতীয় শাসক শ্রেণীর সঙ্গে
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যবাদী যোগসাজশকে তিনি রেখায় রেখায় বা
আঁকিবুকিতেই উন্মোচন করেন অবলীলায়। শাসক শ্রেণীর ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের
ভাড়া-খাটা বুদ্ধিজীবীদের অন্তঃসারশূন্যতাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে তাদের
তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করেছেন তিনি তার একাধিক কার্টুনে। নান্দনিকতার ঘোরে
মজে-থাকা লেখক ও শিল্পীদের ঔপনিবেশিক মনোগঠন ও জনবিচ্ছিন্নতাকে আঘাতের পর
আঘাত হেনেছেন এল্ ফিগন্ তার কাজে। তিনি মনে করেন, সৌন্দর্যের দোহাই পেড়ে
তাদের নান্দনিকতা আবার সৌন্দর্যহীনতার সমস্ত কারণকে প্রচ্ছন্ন রাখে; এ
নান্দনিকতা এভাবে আসলেই সৌন্দর্যবিরোধী। কেননা এ নান্দনিকতা সৌন্দর্যের
সাক্ষাৎ শত্রু হিসেবে পুঁজিকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। তাই তাদের সুন্দর
চিত্রকল্প বা ছবি অতটা সুন্দর নয়, যতটা দেখায়।
এল্ ফিগন্ এও মনে করেন, যিনি শিল্পী, তিনি প্রেমিক, আর যিনি প্রেমিক, তিনি বিদ্রোহীও বটে। তার মতে, যে শিল্পে প্রেম ও বিদ্রোহ নেই, সেই শিল্প চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে গণবিরোধী বলেই অন্তঃসারশূন্য।
এল্ ফিগন্-এর অসংখ্য ধাক্কা-দেওয়া, প্রশ্ন-তোলা কার্টুন একের পর এক বেরিয়েছে মেক্সিকোর জাতীয় দৈনিক _লা হোরনাদা_-তে। এছাড়া তিনি শিশুদের বইয়ে ছবি এঁকেছেন প্রচুর। বিভিন্ন রাডিক্যাল প্রবন্ধ ও বইয়ের জন্যও ছবি এঁকেছেন এল্ ফিগন্। ছবি আঁকার জন্য যে বিষয়গুলো তাকে বিশেষভাবে টেনেছে, সেগুলো হলো– মেক্সিকোতে নয়া উদারনীতি, উত্তর আমেরিকার ‘মুক্ত’ বাণিজ্য চুক্তি, রাষ্ট্রপতি স্যালিনাসের প্রশাসনযন্ত্র, গণমাধ্যমের রাজনীতি ও রাজনীতির গণমাধ্যম (যেখানে ‘মাধ্যম’ আছে ঠিকই কিন্তু ‘গণ’ নেই) এবং ঊনিশ শতকের মেক্সিকোর রাজনৈতিক কার্টুন।
কিন্তু এল্ ফিগন্-এর যে কাজটি আমাকে বিশেষভাবে টেনেছে, তা হচ্ছে তার কার্টুনের ভেতর দিয়েই উপস্থাপিত পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়নের দীর্ঘ ইতিহাস। এল্ ফিগন্ এ ইতিহাসকে একই সঙ্গে তার ছবি ও কথায় দৃশ্যমান ও ব্যঙ্গবিদ্ধ করেছেন। কাজটি তিনি করেছিলেন হিস্পানি ভাষায়। আর এমনভাবে করেছেন যে, পুঁজিবাদ এবং বিশ্বায়নের দীর্ঘ ইতিহাসকে তরতর করে দেখা যায় ও পড়া যায়। এল্ ফিগন্ -এর এই কাজটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মার্ক ফ্রাইড। নিঃসন্দেহে চমৎকার অনুবাদ। ২০০৪ সালে মেট্রপলিটন বুকস অব নিউইয়র্ক এ অনুবাদটি প্রকাশ করে। ইংরেজি অনুবাদে এল্ ফিগন্-এর এই কার্টুন-সংকলনের শিরোনাম (ব্যঙ্গার্থেই) দাঁড়ায় _হাউ টু সাকসিড্ অ্যাট গ্লোবালাইজেশন: এ প্রাইমার ফর দ্য রোডসাইড ভেনডার_।
৩
হ্যাঁ, ওই শিরোনাম নিজেই হয়ে ওঠে একটি গেরিলা কৌশল। আক্ষরিক অর্থে যদি শিরোনামকে নিই, তাহলে মনে হবে যে, বইটি রাস্তার ধারের হকার বা ফেরিওয়ালাকে বিত্তশালী করার পথ বাৎলানোর জন্যই লেখা হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়। মরক্কোর কবি, কথাসাহিত্যিক ও তাত্ত্বিক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিনের ‘গেরিলা ভাষাতত্ত্ব’-এর কথা চলে আসে এখানে। এ ভাষাতত্ত্ব ভাষিক আক্রমণের কলাকৌশল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জোর দিয়েছে ছদ্মবেশী শিরোনামের ওপর, যে শিরোনাম ওঁৎ পেতে লুকিয়ে থাকে তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুকে ধরার জন্যই। হ্যাঁ, এল্ ফিগন্ ছদ্মবেশী শিরোনামই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বইটির মুখবন্ধে গিয়ে তিনি ছদ্মনাম পরিত্যাগ করেন। তিনি আমাদের জানিয়ে দেন, “কার্টুনের এ সংকলন দেখায় কীভাবে ‘মুক্ত’বাজার অর্থনীতি আমাদের যাপিত জীবনের বিভিন্ন এলাকাকে প্রভাবিত করে, যেভাবে তা প্রভাবিত করে আমাদের আত্মসম্মানবোধকে, আমাদের পরিচয়কে, আমাদের ভাষাকে।”
ভাষাকেও? অবশ্যই।
হ্যাঁ, পুঁজি কেবল পরিবেশের দূষণই ঘটায় না; ঘটায় ভাষার দূষণও। এ ইঙ্গিতটা আসে এল্ ফিগন্-এর কার্টুন থেকেই। বেশ আগেই তো নিকারাগুয়ার লড়াকু কবি আর্নেস্তো কার্দেনাল তার _জিরো আওয়ার_ নামের কাব্যগ্রন্থে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এই বাক্যটা: ‘কোম্পানিগুলো আমাদের ভাষাকে কলুষিত করছে।’ এ ভাষিক দূষণের খপ্পরে আমরা অনেকেই কোনো না কোনোভাবে পড়ে থাকি। এমনকি একজন ‘প্রগতিশীল’ লেখককে এ কথাটা বলতে শুনেছি: ‘বাহ! আপনি তো বিষয়টা নিয়ে মাল্টি-মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন তুলেছেন।’ না, ব্যঙ্গ করে বলেননি ওই কথাটা; বলেছেন প্রশংসা করতে গিয়েই। অর্থাৎ প্রশংসা করতে গেলেও মার্কিন ডলার বা বিনিময়-মূল্যের রূপককে চালু রাখতে হয়। হরহামেশাই অনেকে বলে থাকেন, ‘হ্যাঁ, তোমার চিন্তাটা পাবলিক খাবে না।’ এখানে ‘পাবলিক’ মানে আসলে জনগণ নয়; তারা হলো বাজারমুখী ভোক্তা।
উদারপন্থিরা উদরপন্থিও বটে। তবে বাজারের রূপক ব্যবহার করে থাকে শুধু উদারপন্থি বা উদরপন্থিরাই নন, অনেকেই বটে। আর ভাষাই প্রমাণ করে দেয় যে, বাজার-মূল্য বা বিনিময়-মূল্য পরাভূত করে অন্য সব মূল্যকে– নৈতিক মূল্য থেকে নান্দনিক মূল্য পর্যন্ত বিভিন্ন মূল্যকে। ‘মানবসম্পদ’ কথাটাও চলে আসে এখানে। মানুষকে মানুষ না বানিয়ে তাকে কেবল সম্পদে রূপান্তরিত করার তাগিদটাও পুঁজির লজিকের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এল্ ফিগন্-এর কার্টুনগুলো এসব বিষয়কে রেখায় ও কথায় উপস্থিত করে পুরো বিশ্বায়নের ধারণাকে পুঁজির ভেলকিবাজি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উরুগুয়ের লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানোর ওই স্লোগানটা মনে আসে: ‘গ্লোবালাইজেশন ইজ গ্লোবালোনি’। অর্থাৎ বিশ্বায়ন হচ্ছে পুঁজির বিশ্বায়িত ভাঁওতাবাজি বা রংবাজি। আমরা অবশ্য এখানে একটা কথা চালু করতে পারি; সেটা হলো–পুঁজিবাজি।
অবশ্যই বলা যাবে, এল্ ফিগন্-এর কার্টুনগুলো কেবল পুঁজিবাজির ইতিহাসকেই সামনে আনে না; পুঁজিবাজিকে সুযোগ পেলেই বিভিন্ন কায়দায় আক্রমণও করে বটে। ‘সম্পর্কই সত্য’– কথাটা বলে উপনিষদ যেমনি, বিশ্বায়নও তেমনি। তবে এল্ ফিগন্-এর মতে, তারা একভাবে তা বলে না মোটেই। এল্ ফিগন্-এর কার্টুনগুলোই আমাদের একাধিক প্রশ্নকে পুঁজিবাজির খপ্পর থেকে বের করে আনে।
বিশ্বায়নের সুবাদে সম্পর্ক-স্থাপন ও বিস্তারের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে: কার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক? কেমন সেই সম্পর্ক? এল্ ফিগন্-এর কার্টুনগুলো মার্কস ও এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর অনুসরণেই বলে দেয়, পুঁজির ইতিহাস হলো উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে দুনিয়া জুড়ে সম্পর্ক-বিস্তারের ইতিহাস; পুঁজি নিজেই কোনো ধরনের ভৌগোলিক সীমান্তকে বরদাশত করে না; ঈশ্বরের মতোই সে সর্বগামী হতে চায়।
এল্ ফিগন্-এর কার্টুনগুলো এও দেখায় যে, সম্পর্ক বিস্তারের কাজ করতে গিয়ে বিশ্বায়িত পুঁজি নিজের সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের শ্রমশক্তিকে সম্পর্কিত করে; নিজের সঙ্গে বিভিন্ন পরিসর ও সময়কে সম্পর্কিত করে; নিজের সঙ্গে বিভিন্ন বাজারকে সম্পর্কিত করে এবং নিজের সঙ্গে বিভিন্ন ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানোৎপাদনকেও সম্পর্কিত করে। এভাবে বিশ্বায়নের অর্থ দাঁড়ায় পুঁজির সম্পর্কের সমগ্র, যা দৈশিক ও বৈশ্বিক।
কিন্তু এল্ ফিগন্-এর কার্টুনগুলো এও দেখিয়ে দেয়, সম্পর্ক মানেই সমতা নয়।
যদিও বিশ্বায়ন হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে স্থানের, মানুষের সঙ্গে সংস্কৃতির এবং মানুষের সঙ্গে পণ্যদ্রব্যের সম্পর্কস্থাপনের চলমান প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে আধুনিক প্রযুক্তি (নিজেকে সবসময়ই অগ্রসর বা এমনকি বিপ্লবায়িত করার ভেতর দিযেই), এ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেই আবার বিভিন্ন ধরনের অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক, অসম উৎপাদন-সম্পর্ক, অসম শ্রেণী-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতি-সম্পর্কও উৎপাদিত ও পুনরুৎপাদিত হতে থাকে। _ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক_-এর ওই চিত্রকল্পটার কথাটাই ধরি: দুনিয়ার সবাই তো আর লেবাননের খাবার খেয়ে আইরিশ পানীয়তে ঠোঁট ভিজিয়ে আর ফিলিপাইনি ব্যান্ডের সঙ্গীত শুনে জিন্স-পরা ভারতীয নারীকে চোখের সামনে দেখতে পায় না। এল্ ফিগন্-এর মতেই, বিশ্বায়নের আরেক নাম ‘বৈষম্যায়ন’, যার আবার আরেক নাম পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ ও সাম্প্রতিকতম স্তর– মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। আর ‘বিশ্বায়ন মানেই মার্কিনায়ন’– এ কথাটা বেশ আগেই জোরেশোরে ও উল্লাসে বলে গেছেন খোদ রোনাল্ড রেগান।
হ্যাঁ, এল্ ফিগন্-এর কার্টুনগুলো একের পর এক পুঁজিবাজির জারিজুরি ফাঁস করতে থাকে। তিনি একই সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ওপর চোখ রাখেন। যেমন তিনি চোখ রাখেন তাদের আন্তঃসম্পর্কের ওপরও। তিনি প্রশ্নও তোলেন। হ্যাঁ, বিশ্বায়ন যদি আহামরি কোনো বিষয় হয়েই থাকে, তাহলে এখনও কেন প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার শিশু ক্ষুধায়, পুষ্টিহীনতায়, চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে? কেন তাহলে পৃথিবীর শতকরা ৮০ ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে পৃথিবীর মাত্র শতকরা ২০ ভাগ মানুষের হাতে? কেন পৃথিবীর মাত্র ৩ জন মানুষের সম্পদ ৪৮টি দরিদ্র দেশগুলোর জিডিপিকেও ছাড়িয়ে যায়? কেন প্রতি বছর কমপক্ষে ৫০ হাজার নারী ও শিশু যৌনশ্রম বা চাপিয়ে-দেওয়া শ্রমের জন্য মার্কিন মুলুকে পাচার হচ্ছে? কেন ওই একই দেশে প্রতি ৬ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়? কেন পৃথিবীর অনেক গরিব দেশেই জীবনযাত্রার মান ৩০ বছর আগে যা ছিল, তা এখন তার চেয়েও নিচে? কেন অনেকেই না খেয়ে মরে আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত খেয়ে মরে? এল্ ফিগন্ জানাচ্ছেন, এসব প্রশ্ন পুরনো ও মামুলি ঠেকলেও বাস্তবতার অনিবার্য তাপে ও চাপেই প্রশ্নগুলো ফিরে আসে বড় বা এমনকি মৌলিক প্রশ্ন হয়েই। এল্ ফিগন্-এর মতে, এ প্রশ্নগুলোর সুরাহা করতে পারেনি বলেই সবচেয়ে অগ্রসর পুঁজিবাদ এখন সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে ব্যর্থ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা, এল ফিসগোঁর কার্টুনের ভাষ্য মোতাবেক, মানুষের গণতন্ত্রের পয়লা নম্বর শত্রু।
হ্যাঁ, পুঁজিবাদের বা পুঁজিবাজির দৃশ্যমান ইতিহাসের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য এবং ওই ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য আর পৃথিবীর খেটে-খাওয়া মানুষের গণতন্ত্রের স্বার্থেই আমরা ব্যবহার করতে পারি এল্ ফিগন্-এর কার্টুন। কার্টুন যে কত শক্তিশালী ও লড়াকু হতে পারে, কার্টুন কী করে একই সঙ্গে রেখা ও শব্দকে বুলেটের মতো ছুঁড়তে পারে, কিংবা কার্টুন আক্রমণ রচনা করার জন্য কীভাবে ওঁৎ পেতে থাকে গেরিলা যোদ্ধার মতো, কিংবা কার্টুন শ্লেষ ও বক্রোক্তিকে কীভাবে দূর থেকে আকস্মিক বল্লমের মতো ছুঁড়তে থাকে, কিংবা কার্টুন কীভাবে তৈরি করে কবিতা ও পরিসংখ্যান এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির বোঝাপড়া ও সংহতি কিংবা কীভাবে কার্টুন নিজেই কাজ করে ক্যামেরা বা তত্ত্বের মতো, সেসব বিষয়ের উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকে এল্ ফিগন্-এর সৃজনশীল লিপ্ততা ও কর্মতৎপরতা।
লেখকঃ
আজফার হোসেন
অধ্যাপক, ইন্টিগ্রেটিভ্, রিলিজিয়াস, অ্যান্ড ইন্টারকালচারাল ডিপার্টমেন্ট, গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটি, মিশিগান।