সীতাকুণ্ডের একটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাটি আমাদের সামনে আবারও রাজনৈতিক সহিংসতার একটি নগ্ন চিত্র তুলে ধরেছে। এটি একটি নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সহিংসতা বিষয়ক কাঠামোগত তত্ত্ব (Structural Theory of Political Violence) ও সাংগঠনিক সহিংসতা তত্ত্ব (Organizational Violence Theory) এর বাস্তব প্রয়োগ।
রাজনৈতিক সহিংসতার তত্ত্ব অনুসারে, একটি দল বা গোষ্ঠী যখন তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক পদ্ধতির বদলে বলপ্রয়োগ, হুমকি কিংবা ভয়ভীতির আশ্রয় নেয়, তখন তা সহিংসতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়। বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা যখন নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের মতো স্পর্শকাতর স্থানে হানা দেয় এবং একজন প্রধান শিক্ষককে কান্নায় ভেঙে পড়া অবস্থায় পদত্যাগে বাধ্য করে—তা নিছক দলীয় দুর্বৃত্তায়নের ফল নয়, বরং একটি সুগঠিত রাজনৈতিক সহিংস কর্মপন্থার অংশ।
এই ধরনের সহিংসতা কেবল শারীরিক নয়, এটি মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক এবং নৈতিক জুলুমও। একজন শিক্ষক, যিনি প্রতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তাঁকে অপমানিত করে রাষ্ট্র বার্তা দিচ্ছে-‘নিরপেক্ষতা এই দেশে বিপজ্জনক’।
‘স্টেট ফেইলিওর থিওরি’ অনুসারে, যখন রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন সহিংসতা নিজেই বিচারব্যবস্থার স্থান দখল করে। সরকারের নীরবতা, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং দলীয় রাজনীতির প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাত এমন এক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে, যেখানে মব-লিঞ্চিং আর দলীয় বলপ্রয়োগ রাষ্ট্রীয় ন্যায়ের ছায়া হয়ে উঠছে।
সীতাকুণ্ডের ঘটনায় সরকারের সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকায় আমরা বুঝতে পারি, এটি কোনো বিচ্যুতি নয় বরং একটি ‘নতুন স্বাভাবিক’ (new normal)। রাজনৈতিক দলগুলো এখন সমাজের প্রতিটি স্তরে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সহিংসতাকেই রণকৌশল হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিংসতা এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। ২০০১, ২০১৩, ২০১৮—প্রতিটি নির্বাচনী বা সরকার পরিবর্তনের প্রাক্কালে সহিংসতা যেমন রাজনীতির আবশ্যিক অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে, তেমনি এখন এই সহিংসতা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার ভেতরে প্রবেশ করে পড়েছে।
‘Political Opportunity Theory’ অনুসারে, দলগুলো যখন মনে করে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার দুর্বলতা ও প্রশাসনিক শৈথিল্য তাদের সহিংসতা বৈধতা দিচ্ছে, তখন তারা সংঘবদ্ধ হয়ে এটি প্রয়োগ করে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ—দুই দলই বিগত এক দশকে এই সংস্কৃতি চর্চায় অংশ নিয়েছে। সীতাকুণ্ডের ঘটনা কেবল বিএনপির আচরণ নয়; এটি একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সহিংস ইতিহাসের ধারাবাহিকতা।
মব-লিঞ্চিং এখন আর হঠাৎকার জনরোষ নয়; এটি একটি রাজনীতিকরণকৃত গণ-উন্মত্ততা। যেখানে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং দলীয় রাজনীতির প্রভাব সাধারণ জনগণকে ‘বিচারক ও শাস্তিদাতা’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেয়।
মব-লিঞ্চিং এখন আর হঠাৎকার জনরোষ নয়; এটি একটি রাজনীতিকরণকৃত গণ-উন্মত্ততা। যেখানে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং দলীয় রাজনীতির প্রভাব সাধারণ জনগণকে ‘বিচারক ও শাস্তিদাতা’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখন প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করা রাজনৈতিক আদর্শে পরিণত হয়, তখন জনগণ নিজেরাই আইন হাতে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়।
শাসকগোষ্ঠীর দিক থেকে এটি আত্মঘাতী; কারণ যখন সহিংসতার সংস্কৃতি পুষ্ট হয়, তখন তা আর দলীয় অনুগতদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই সংস্কৃতি একসময় সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করে ফেলে।
আজ শিক্ষক অপমানিত হয়েছেন, কাল হয়তো কেউ পুড়িয়ে মারা হবে, আর পরশু রাজপথে কারো গলা কাটা যাবে। রাজনৈতিক সহিংসতার এই প্রবণতা রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করছে। সরকার যদি এখনই স্পষ্ট অবস্থান না নেয়, তবে গণতন্ত্রের মুখোশ পরে সহিংসতার যে রাজনীতি চলছে, তা ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়ঙ্কর বার্তা বহন করবে।
এখন সময় রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার এবং নৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার। অন্যথায়, সহিংসতা শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নয়—পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়তিতে পরিণত হবে।
বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি এখন আর কোনো অনুমান নয়—এটি একটি চলমান বাস্তবতা। সম্প্রতি সীতাকুণ্ডের একটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের হুমকির মুখে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনায় এই বাস্তবতা যেন নতুন করে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় নীরবতা এবং সরকারি দিক থেকে কোনো দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া না আসার মধ্য দিয়ে এই ভয় এখন শুধু সামাজিক বা রাজনৈতিক নয়—রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত একটি শাসন কৌশল হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশি-মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজ তাঁর গবেষণায় (ভয়ের সংস্কৃতি) দেখিয়েছেন, ভয়ের সংস্কৃতি কোনো আকস্মিক সমাজ-উৎপাদিত অবস্থা নয়, বরং এটি সংগঠিতভাবে উৎপাদিত, পরিচালিত এবং পুষ্ট একটি রাষ্ট্রীয় নীতি। এই নীতির ভিত্তি হলো—অভিনেতারা যেন আইনের আশ্রয় না খুঁজে, বরং রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে।
তিনি বলেছিলেন, “ভয়ের সংস্কৃতি হলো এমন এক পরিবেশ, যেখানে আতঙ্ক, সন্ত্রাস ও বলপ্রয়োগ একাধারে ক্ষমতার ধরন ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি।” আজ সীতাকুণ্ডের মতো ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, কীভাবে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক শক্তি হানা দেয়, একজন শিক্ষকের ওপর দলীয় অসন্তোষ জন্মায়, এবং শেষ পর্যন্ত এক দলীয় রোষে শিক্ষক ‘বিতাড়িত’ হন—নিরাপত্তাহীনতার ভেতর।
এই ভয় শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করছে না; তা ‘নিরপেক্ষতা’কে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করছে। আর সরকার? রাষ্ট্রযন্ত্র? প্রশাসন?—সব যেন পরিকল্পিতভাবে চুপ! এই নৈঃশব্দ্যই ভয়ের সংস্কৃতির মূল চালিকা শক্তি। রাষ্ট্র যখন ভয় উৎপাদনের প্রতি নিষ্ক্রিয় থাকে, তখন জনগণ বুঝে নেয়—এটি একটি ‘সহনীয় অপরাধ’, বরং উৎসাহিত অপরাধ।
আজ একজন শিক্ষক, কাল একজন সাংবাদিক, পরশু একজন ইউটিউবার—ভিন্নমত প্রকাশের প্রতিটি স্তরেই ভয় ঢুকে পড়ছে। এই আতঙ্কব্যবস্থার ভিত গড়ে তুলছে এক অদৃশ্য, অথচ সর্বব্যাপী নির্যাতন-রাজনীতি। এটি হলো “banality of evil”—অর্থাৎ, যেখানে সহিংসতা ও দমন-পীড়ন এতটাই দৈনন্দিন হয়ে যায় যে সমাজ এটিকে আর অন্যায় বলে মনে করে না।
সীতাকুণ্ডের ঘটনায় সরকারের প্রতিক্রিয়া নেই, কারণ এই প্রতিক্রিয়া অনুপস্থিত থাকাই এখন ‘রাষ্ট্রনীতি’। ভয়ের সংস্কৃতি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে প্রতিপক্ষের মুখ বন্ধ করা এবং নিরপেক্ষ কণ্ঠগুলোকে ‘শত্রু’ বিবেচনা করাই ক্ষমতার চর্চা। মিডিয়া হাউসগুলোর অভ্যন্তরেও এখন এই ভয় পুঁজির মতো কাজ করছে—নির্বাচিত শব্দ, এড়ানো তথ্য এবং সেলফ-সেন্সরশিপই হয়ে উঠেছে রিপোর্টিংয়ের মূলপদ্ধতি।
যে রাষ্ট্র সহিংসতা, মব-লিঞ্চিং এবং চরম রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখায় না, সে আসলে এই ঘটনাগুলোর মৌন সমর্থক। ভয় এখন আর একক ব্যক্তি বা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করছে। এবং সরকার নিজেই এখন এই ভয়ের প্রধান স্থপতি।
ভয়ের সংস্কৃতি শুধু একটির দলীয় কৌশল নয়; এটি একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার রাজনৈতিক পরিণতি। যখন শিক্ষকরা নিরাপদ নন, সাংবাদিকরা কণ্ঠরোধের শিকার হন, সাধারণ নাগরিক বিচারহীনতার শিকার হন—তখন প্রশ্ন তুলতেই হবে: রাষ্ট্র কাদের জন্য? এবং কাদের বিরুদ্ধে?
রাজীব নন্দী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
Leave A Reply