নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততোই কিছু গোষ্ঠী যাদের আগে নির্বাচনের বাইরে থেকে ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন ছিল, এখন এক নতুন আলাপ শুরু করেছে। তারা বলছে—“যদি বিএনপি সরকার গঠন করে, তবে তারা দুই-তিন বছরের বেশি টিকতে পারবে না।” এক প্রভাবশালী ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবী লিখেছেন, “ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা কঠিন হবে না, তবে ক্ষমতায় থাকা কঠিন হবে।” তিনি আরও বলেছেন, “সোশ্যাল মিডিয়া (বিশেষ করে পিনাকী, ইলিয়াস), আমার দেশ, সচেতন ইসলামপন্থী নেতৃবৃন্দ এবং ঢাকা বেইজড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অস্থিরতা তৈরি করবে। ফুল টার্ম সরকার থাকতেই পারবে না।” এই ধরনের কথা শুধু তিনিই বলেননি, নাগরিক পার্টির লোকজন, জামায়াত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা, এমনকি পিনাকীর ভিডিওতেও বারবার এই কথার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে।
এই আলোচনার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, এটি সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রের সিভিল এগ্রিমেন্ট হল—সব রাজনৈতিক দল নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে নির্বাচনে যাবে। জনগণ যাকে পছন্দ করবে তাকে পাঁচ বছরের জন্য ম্যান্ডেট দেবে। পাঁচ বছর পর আবার সেই জনগণই ঠিক করবে তারা সেই সরকারকে চায় কি না। এই চুক্তিকে মানা না হলে গণতন্ত্র টিকবে না। বিরোধীদলের দায়িত্ব হল—সংসদে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নিশ্চিত করা। মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা। সরকার পতনের ষড়যন্ত্র নয়।
এই নতুন আলাপ আমাদের দেশে একদম নতুন না। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ ‘হরতালের মাধ্যমে সরকার পতন’ এর কৌশল নেয়। আবার ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বিএনপি ‘ভুয়া নির্বাচন’ বলে সংসদ বর্জন করে। ২০০১ সালে বিএনপি জেতার পর আওয়ামী লীগ বলে “বুলেট দিয়ে ব্যালট জিতেছে”, আর ২০০৬ সালে যে সংঘাত শুরু হয়েছিল, তা ১/১১-এর সামরিক-সমর্থিত সরকার তৈরি করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে এই সিভিল এগ্রিমেন্টকেই ভেঙে দেয়।
এর ফলে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড়ায়নি। নির্বাচন ব্যবস্থা নষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হারিয়ে গেছে। এখন যারা বলছেন—“বিএনপি আসলে তাদের ফুল টার্ম দিতে দেব না”—তারা কি নিশ্চিত যে আগামীবার যদি তারা নিজেরা ক্ষমতায় আসে, তখন তাদেরও পাঁচ বছর থাকতে দেয়া হবে?
এই জন্য স্পষ্ট করে বলা দরকার, জনগণ যদি কাউকে ম্যান্ডেট দেয়, তাকে পাঁচ বছর সময় দিতে হবে। আর সে পাঁচ বছরে যদি সে ভুল করে, বিরোধীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবে। সংসদে প্রশ্ন তুলবে, মিডিয়ায় আলোচনার পরিবেশ রাখবে। ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা টিকতে না দেয়া মানে জনগণের ইচ্ছাকে অশ্রদ্ধা করা।
এই ব্যপারটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না। পাকিস্তানে ২০১8 সালে ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন থেকেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। ২০২২ সালে সংসদীয় অভিশংসনের মাধ্যমে তার সরকার পড়ে যায়। কিন্তু তার আগে থেকেই সেনাবাহিনী ও বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে তার সরকারের উপর চাপ তৈরি করা হয়েছিল। পাকিস্তানে গণতন্ত্র কখনোই স্থিতিশীল হয়নি। কারণ এই সিভিল এগ্রিমেন্ট কেউ মানে নি—কে নির্বাচিত তা বড় বিষয় না, কে “অপছন্দনীয়” সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
দক্ষিণ আমেরিকার চিলির কথাই ধরি। ১৯৭০ সালে সালভাদোর আয়েন্দে জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু তার সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা কিছু গোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি। ফলে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। বিরোধীদের সমর্থনে পিনোচেটের নেতৃত্বে এক ভয়াবহ সামরিক শাসনের সূচনা হয়। পরে এই বিরোধীরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। চিলির জনগণ দশকের পর দশক সেই ভুলের মাশুল দিয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় আবার উল্টো চিত্র দেখা গেছে। নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট হন। তার প্রতি বিরোধী গোষ্ঠীর অনেক অভিযোগ ছিল। কিন্তু বিরোধীরা কেউ তার টার্ম সংক্ষিপ্ত করার ষড়যন্ত্র করেনি। কারণ সবাই বুঝেছিল, গণতন্ত্র মানে শুধুমাত্র ক্ষমতায় আসা না, তা পূর্ণ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করাও এর অংশ।
বাংলাদেশকে কোন পথ বেছে নিতে হবে? আমরা কি পাকিস্তান-চিলির মত রাজনৈতিক-সাময়িক ষড়যন্ত্র আর অনাস্থার রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করবো আগামী দিনে? নাকি দক্ষিণ আফ্রিকার মত ধৈর্য্য ও পরিপক্কতার সঙ্গে গণতন্ত্রের সংস্কৃতি গড়বো? যারা আজ বলছেন, বিএনপিকে পূর্ণ টার্ম দেয়া হবে না, তারা আসলে ভবিষ্যতে নিজেদেরও বিপদে ফেলছেন। কারণ আজ আপনি ষড়যন্ত্র করে কাউকে ক্ষমতায় থাকতে দিলেন না, কাল অন্য কেউ আপনাকে একই কাজ করবে।
তাই যদি আপনি গণতন্ত্রের বেসিক চুক্তি না মেনে ষড়যন্ত্রের পথ নেন, এবং দেশের গণতন্ত্র ব্যর্থ হয় তবে শেষমেশ আপনাকে বঙ্গোপসাগরেই ঝাঁপ দিতে হবে। গণতন্ত্রের বিকল্প আরেকটা গণতন্ত্রই, কোনো ষড়যন্ত্র, কোনো স্বপ্নময় ধর্মীয় বিপ্লব নয়। বাঙালি মুসলমানের আসলেই যাওয়ার কোন দেশ নাই। এইটা যত জলদি মানবেন ততই মঙ্গল।
ইসলামপন্থী যারা এই আলাপ তুলছেন তাদের বলি, বিশ্বাস করুন আপনাদের এই দেশেই থাকতে হবে, সেকুলার, লিবারেল, হিন্দু, মুসলমান সবার সাথেই থাকতে হবে। যদি এমন স্বপ্নে থাকেন যে আপনারা যা ইচ্ছা তাই করবেন ও ফেল করলে আপনাদের তুরস্ক বা সৌদি আরব ভাই বলে বুকে টেনে নেবে, আশ্রয় দেবে তবে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আরবদের বর্ণবাদ সম্পর্কে আপনাদের অধিকাংশের ধারণা নেই। বাংলাদেশি শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করবেন তাহলে বুঝবেন ধর্মের যে আবেগ আপনার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ তা আরব বর্ণবাদের কাছে কোনো আলোচ্য বিষয়ই না। তাই যদি আপনি গণতন্ত্রের বেসিক চুক্তি না মেনে ষড়যন্ত্রের পথ নেন, এবং দেশের গণতন্ত্র ব্যর্থ হয় তবে শেষমেশ আপনাকে বঙ্গোপসাগরেই ঝাঁপ দিতে হবে। গণতন্ত্রের বিকল্প আরেকটা গণতন্ত্রই, কোনো ষড়যন্ত্র, কোনো স্বপ্নময় ধর্মীয় বিপ্লব নয়। বাঙালি মুসলমানের আসলেই যাওয়ার কোন দেশ নাই। এইটা যত জলদি মানবেন ততই মঙ্গল।
তাই আসুন, নির্বাচনের ফল মেনে নিতে শিখি। যে দলই জিতুক, তার টার্ম পূর্ণ হোক। ভুল করলে আমরা বলবো, সমালোচনা করবো, আন্দোলন করবো, কিন্তু সরকার পতনের ষড়যন্ত্র নয়। এটাই গণতন্ত্রের আসল চুক্তি। যদি দেশের প্রতি সামান্য দায়বদ্ধতা থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের নিয়ম মানতে শিখুন। অন্যথায়, আপনি গণতন্ত্রের শত্রু।
আসিফ বিন আলী একজন শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
Leave A Reply