ইয়েমেন, মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি দরিদ্র আরব রাষ্ট্র, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের অন্যতম প্রতীক। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান গৃহযুদ্ধ, বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এই রাষ্ট্রকে প্রায় ধ্বংসের সম্মুখীন করে তুলেছে। কোটি মানুষের খাদ্যাভাবে ভোগা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিপর্যয়, শিক্ষাব্যবস্থার ধস – সব মিলিয়ে ইয়েমেন এখন এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত।
সংকটের পটভূমি
ইয়েমেনের সংকট শুরু হয় ২০১১ সালের আরব বসন্তের ঢেউয়ের উত্তাল সময়টায়। দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ-র পতনের পর নতুন প্রেসিডেন্ট আবদ-রাব্বু মানসুর হাদির নেতৃত্বে দেশটিকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুর্নীতি, বেকারত্ব, এবং রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে হাদি সরকার দ্রুতই জনপ্রিয়তা হারায়।
২০১৪ সালে শিয়া মতাদর্শী হুতি বিদ্রোহীরা হাদির সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এরপর ২০১৫ সালে হাদি সৌদি আরবে পালিয়ে যান, এবং সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের দমন করতে সামরিক অভিযান শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ, যার ফলে দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
প্রধান পক্ষসমূহ
১. হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী
ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের শিয়া জামাত ‘আনসার আল্লাহ’ নামে পরিচিত এই গোষ্ঠী, যারা ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তা পেয়ে থাকে। হুতিরা মূলত নিজস্ব অঞ্চলগুলোর রাজনৈতিক অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আন্দোলন শুরু করলেও পরে তা সামরিক লড়াইয়ে রূপ নেয়।
২. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার:
হাদি নেতৃত্বাধীন সরকার সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE), এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর সমর্থনপুষ্ট। তবে পরিবর্তিত বাস্তবতায় এই সরকার বর্তমানে ইয়েমেনের বড় একটি অংশে প্রভাব হারিয়েছে।
৩. দক্ষিণ ইয়েমেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী:
“সাউথার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল” (STC) নামের গোষ্ঠীটি দক্ষিণ ইয়েমেনকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে। এরা কিছু সময় UAE-এর সমর্থন পেয়েছে, যদিও পরবর্তীতে তাদের অবস্থান দ্বিধান্বিত হয়।
৪. আল-কায়েদা ও আইএস
অরাজক পরিস্থিতির সুযোগে এই উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ইয়েমেনে ঘাঁটি গেড়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে তাদের উপস্থিতি রয়েছে।
পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিসমূহের ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা ও দায়
ইয়েমেন সংকটে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা এই সংঘাতকে দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল করে তুলেছে। যুদ্ধের শুরুর সময় থেকেই পরাশক্তিগুলো নিজেদের কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থে পরিস্থিতিকে ব্যবহার করেছে, যার ফল ভুগছে ইয়েমেনের সাধারণ জনগণ।
সৌদি আরব:
হুতি বিদ্রোহীদের ইরানি প্রভাবিত শিয়া শক্তি হিসেবে দেখে সৌদি আরব ২০১৫ সালে সামরিক জোট গঠন করে। বিমান হামলা, অবরোধ এবং স্থল অভিযান পরিচালনা করে হুতিদের দমন করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এই অভিযান হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু, অবকাঠামোর ধ্বংস এবং মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে।
ইরান
হুতিদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বিস্তারে চেষ্টা করে। যদিও তারা সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে, তবুও বাস্তবে হুতিদের হাতে ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ বহুবার সামনে এসেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE):
দক্ষিণ ইয়েমেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে আরব আমিরাত নতুন একটি ভূরাজনৈতিক বলয়ের জন্ম দিয়েছে, যা দেশটিকে আরেকটি বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স:
এই দেশগুলো সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও সৌদি জোটকে ব্যাপক অস্ত্র, প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েছে। এতে সংঘাতের তীব্রতা বেড়েছে, এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘিত হয়েছে। তাদের অস্ত্র ব্যবহারে স্কুল, হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে, বহু শিশু নিহত হয়েছে।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
জাতিসংঘ শান্তি উদ্যোগ ও মানবিক সহায়তা দিতে চাইলেও বড় পরাশক্তিগুলোর দ্বৈতনীতি ও স্বার্থের কারণে তারা অনেক সময় দুর্বল থেকেছে। নিষেধাজ্ঞা বা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কার্যকর চাপ প্রয়োগের অভাব রয়েছে।
রাশিয়া ও চীন
যদিও এরা সরাসরি কোনো পক্ষ নেয়নি, তবে জাতিসংঘে হুতিদের বিরুদ্ধে প্রস্তাবের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখেছে। রাশিয়া ইয়েমেন সংকটকে যুক্তরাষ্ট্রের “একতরফা হস্তক্ষেপের ফলাফল” বলে থাকে এবং ইরানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখে।
মানবিক বিপর্যয়
ইয়েমেনের মানবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রায় ২.৭ কোটি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, অন্তত ৫০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং প্রতিদিন প্রায় ৪০০ শিশু অপুষ্টিজনিত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করছে।
ইয়েমেনের মানবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রায় ২.৭ কোটি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, অন্তত ৫০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং প্রতিদিন প্রায় ৪০০ শিশু অপুষ্টিজনিত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করছে।
যুদ্ধের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ফলে কলেরা, ডায়রিয়া ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘাটতির কারণে বহু মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছে না। ওষুধের অভাব, চিকিৎসক সংকট এবং বারবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলার ফলে স্বাস্থ্যখাত কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। প্রায় ২ মিলিয়নের বেশি শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বোমা হামলায় ধ্বংস হয়েছে অথবা শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে।
লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা সীমান্তে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের জন্য খাবার, নিরাপদ পানি এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল। অনেক পরিবার দিনে একবেলা খাবার পায়, অনেক ক্ষেত্রেই তা নেই বললেই চলে।
এই সংকট নারী ও শিশুদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে। বহু কিশোরী বিয়েতে বাধ্য হচ্ছে, যাতে পরিবার কিছুটা অর্থিক সহায়তা পায়। শিশুশ্রম, পাচার এবং যৌন সহিংসতার মতো সমস্যাও বেড়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ইয়েমেনে প্রায় ২.৭ কোটি মানুষ মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ৫০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, এবং লক্ষাধিক শিশু চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছে। ১০ হাজারের বেশি শিশু সরাসরি যুদ্ধজনিত কারণে প্রাণ হারিয়েছে।স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, হাজার হাজার মানুষ কলেরা, টাইফয়েডসহ প্রতিরোধযোগ্য রোগে মারা যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত, বহু শিশু ও কিশোর অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর হাতে আটকে আছে।
কোন পথে সমাধান?
১. জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তি
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হুতি, হাদি সরকার এবং অন্যান্য পক্ষগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। জাতিসংঘের দূত হান্স গ্রুন্ডবার্গ এই প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যে সক্রিয়।
২. সৌদি-ইরান সরাসরি আলোচনার প্রসার:
২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় রিয়াদ-তেহরান পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এই সুযোগে ইয়েমেন নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা যেতে পারে।
৩. মানবিক সহায়তা নিশ্চিতে করিডোর খোলা:
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য নিরবচ্ছিন্ন মানবিক করিডোর নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধরত পক্ষগুলোর উচিত হবে এসব সংস্থার কার্যক্রমে বাধা না দেওয়া।
৪. অস্ত্র সরবরাহ বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ:
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অস্ত্র বিক্রিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে যুদ্ধকে স্তিমিত করতে পারে। অস্ত্র ব্যবসা বন্ধে বৈশ্বিক প্রচারণা প্রয়োজন।
৫. স্থানীয় শান্তি উদ্যোগ ও জনগণের অংশগ্রহণ:
নারী, তরুণ, ও ধর্মীয় নেতাদের অংশগ্রহণে স্থানীয়ভাবে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জনভিত্তিক সমাধান দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয়।
সার্বিক বিশ্লেষণ শেষে এ কথা বলা যায় যে, ইয়েমেন সংকট একটি বহুমাত্রিক সমস্যা—এর মূলে রয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় বিভাজন, এবং পরাশক্তির ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষ। কোনো এক পক্ষের জয় নয়, বরং আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সকল পক্ষের স্বার্থ রক্ষাই হতে পারে এর সমাধান। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দরিদ্র দেশের জনগণ কতদিন বিশ্বশক্তির খেলায় বলি হবে? সময় এসেছে রাজনীতি, কূটনীতি ও মানবিক বিবেচনার সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটানোর ও ইয়েমেন সংকটের কার্যকর সমাধানের।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।
Leave A Reply