বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ে দেশে জনমনে নানান প্রশ্ন বিরাজমান। সম্প্রতি সময়ে যে প্রশ্নটি বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে তা হল, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পাওয়া যাচ্ছে না। কেন নাম পাওয়া যাচ্ছে না? যদিওবা পাওয়া যায় তাতে কলসে তলানিতে এসে ঠেকেছে!
কেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো অবস্থান করে নিতে পারছে না? কে দেবেন এই প্রশ্নের জবাব? নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন তাঁরা দেবেন, যেখানে উপাচার্যের দায় শতভাগ।
কিন্তু এই ‘উপাচার্য’ পদটি শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক পদে পরিণত হয়েছে। যারা ‘আমলাতান্ত্রিক’ উপায়ে নিজেদের কতৃত্ব বেশ দেখিয়ে থাকেন। বারবার উপাচার্যের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে যারা জাজ্বল্যমান উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোঁজ নিয়ে দেখলে আরও অনেকের নাম বেরিয়ে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যিনি দশ টাকায় একটি সিঙ্গারা, এক কাপ চা একটি সমুচা নিয়ে গর্ব করার কথা বলেছেন। তিনি হয়তো একগুলো দিয়েই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উজ্জ্বল করতে চেয়েছেন! উপাচার্যের ভাষ্যমতে, একটি অস্কার পাওয়ার জন্য একটি কাজ। তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন, ছাত্র ভর্তির অনিয়মে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটু ভিন্নভাবে সমাদৃত হয়েছেন। তিনি সরকারি দলের ছাত্র নেতাদের ‘ঈদ সেলামী’ দিয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নের নামে গাছ কেঁটে অবকাঠামো নির্মাণ করছেন। এই বড় বড় ‘উন্নয়ন অবকাঠামো’ দিয়ে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আন্তর্জাতিক মান’ বাড়ানো সম্ভব? তিনি বর্তমানে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের চাপে আছেন, যেখানে তাঁর উপাচার্য গদিয়ে বাঁচানো বড় কষ্টের। কষ্টের এই জন্য যে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে ও তাপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি নারী কেলেংকারী, ভিসি বাংলোয় পার্লার খোলা, নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, নিজ কতৃত্ব, স্বৈরাচারী আচরণ, মুক্ত চিন্তায় বাঁধা, দূর্নীতি, লাম্পট্য, শিক্ষার্থী বহিষ্কার, শিক্ষকদের অবমাননা ইত্যাদি অভিযোগ অভিযুক্ত ছিলেন। আর একজন উপাচার্য যিনি কিনা ঢাকায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যসম্পাদন করে থাকেন। মাথা ব্যথা হলে, পায়ে মলম দেওয়া মতো অবস্থা।
প্রশ্ন হলঃ এতো অনিয়ম, দূর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা থাকলে কিভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজ লক্ষ্য পৌঁছাতে পারবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হওয়া উচিত, জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান সংরক্ষণ এবং জ্ঞান বিতরণ , আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জাতীয় সংকট মূহুর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা। যেমনটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি সংক্রান্তিকালিন সময়ে অবদান রেখেছে। কিন্তু যা হয়নি, তা মূলে পৌঁছানো।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য ‘উপাচার্য’দের নিয়োগ এবং করণীয় কিছু বিষয় উল্লেখ করা। প্রথম যে কাজ তাহলো, নিয়োগ বিজ্ঞাপন মাধ্যমে জানানো এবং যারা এই উপাচার্য পদে আগ্রহী তাদের সকলের লিখিত মতামত গ্রহণ করা। তাঁরা আগামী যে চার বছরের জন্য উপাচার্য পদে নিয়োগ চাচ্ছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কি কি করবেন তার বিবরণী। কোন প্রকার স্বজনপ্রীতি বা দলীয় ভিত্তি উপাচার্য নিয়োগ বন্ধ করতে হবে।
এখানে আমি ইউক্রেনিয়ান (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) শিক্ষাবিদ আন্তন মাকারেঙ্কোর প্রতিষ্ঠিত ‘গোর্কি কলোনি’র কথা উল্লেখ করবো। তিনি গোর্কি কলোনির প্রতিষ্ঠা এবং সুনাম বর্ণনা করেছেন “জীবন জয়ে পথে” নামক বই। গোর্কি কলোনি শিশু অপরাধীদের জন্য এবং তাঁদের মানবিক শিক্ষা ও উৎপাদন মুখী করার উদ্দেশ্য সোভিয়েত সরকার মাকারেঙ্কোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাকারেঙ্কো প্রথম যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তাহল, সামরিক বাহিনীর মতো নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা। তিনি নিয়ম করে সকল ভালো কাজের জন্য কলোনি সদস্যদের উৎসাহিত করেছেন, তিনি শিখিয়েন কিভবে দলবদ্ধ হয়ে কাজের করতে হয়। কিন্ত তিনি তথাকথিত কোনো নিয়ম বা তত্ত্ব মাধ্যমে কলোনি সদস্যদের শিক্ষা দেননি। তাঁর সময়ের রাষ্ট্রীয় আমলাদের নির্ধারিত পাঠ্যক্রম না নেওয়া জন্য আট বছরের মাথায় কলোনি পরিচালনা পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তিনি দেখিয়েছেন , ক্ষুদার্থ মানুষকে কিছু গোদ বাঁধা তত্ত্ব দিয়ে মানবিক শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমি প্রথমত,বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম করে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদেরকে গবেষণা মূলক কাজে উৎসাহিত করবো। বিশেষ করে ‘জাতীয় জ্ঞান’ মনোযোগী হওয়া খুবই জরুরি, কারণ একবিংশ শতাব্দীতে “জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাস(epistemological violence)” শুরু হয়েছে তা থেকে প্রতিহত করার জন্য।
দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষায় পাঠ্যক্রম শিক্ষা খুবই জরুরি, তাই শিক্ষকদের কে অনুবাদে উৎসাহিত করে শিক্ষার্থীদের বিশ্ব জ্ঞানের সাথে পরিচিতি করে তোলাতে যতদূর সম্ভব কাজ করতাম।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে শিক্ষকদের অবস্থা খুবই নাজুক আবার একদিকে ‘অযোগ্য শিক্ষক’দের জন্য ‘মুক্তমান শিক্ষক’গণ সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। তাই শিক্ষকদের নাজুক অবস্থা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং যোগ্য শিক্ষক প্রার্থীকে যথাস্থানে বসানোর প্রতি দৃঢ় থাকতাম।
চতুর্থত, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমানো।
পঞ্চমত, এতো কিছুই শেষ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখে যথাসম্ভব গবেষণামুখী করা এটাই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো অনেকাংশে অপ্রাপ্তবয়স্ক(immature) লোকজনে ভরা।
সুতরাং, বলা যায় উপাচার্য চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কে অনেক উচ্চ আসনে বসাতে পারেন, নিচুস্তরে নামাতে পারেন৷ একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, ‘উপাচার্য’ কোনো পেশার নাম নয়, বরং একটি ‘দায়িত্ব’। বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বলবে, দেশ কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে।
লেখক – মোঃ আরমান আলী, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়