যৌনতা বিষয়টি বাংলাদেশে যে ট্যাবু এটি আমাদের কারোই অজানা নয়। আমাদের মা-বাবারা, বড়রা আমাদের সাথে শারীরিক স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে খুবই ইতস্তত বোধ করেন। এছাড়াও আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে এসব বিষয় নিয়ে ভালোমত শেখানো হয় তাও না। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেই লজ্জা-লজ্জা, কিছু বলোনা-কিছু বলোনা, এসব নিয়ে কথা বলতে নেই। আর কথা বলার মানুষটি যদি বয়সে ছোট হয় তাহলে তো কথাই নেই! বাচ্চাটা তো অকালেই গেছে, ইচড়ে পাকা হয়ে গেছে একদম!
কিন্তু অপর দিক দিয়ে বাংলাদেশে শিশু যৌন নির্যাতনের হার কিন্তু অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলেছে। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে শিশু যৌন নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েছে ৭২.৩২%। এবং এবছরের প্রথমাংশেই শিশু ধর্ষণের হার বেড়েছে ৪১%। ২০১৯ সালে শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনা ১৩৮৩ টি, এবং জানুয়ারি থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ধর্ষণের ঘটনা ৪৯৬ টি। যার মধ্যে ৫৩জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ও ২৩ জনকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি হলো, এসব ঘটনার ১ তৃতীয়াংশেরই কোন মামলা হয় নি।
২০১৮ সালে চাইল্ড পার্লামেন্টের একটি জরিপে দেখা যায়, ৬৪টি জেলার ৫১৩টি শিশুর ৮৭% শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এবং ১৫ থেকে ১৮ বছরের ৩৬৪ জন শিশুদের মাঝে চালানো একটি জরিপে দেখা যায় তাদের ৪৮.৬% সেক্সুয়াল এন্ড জেন্ডার বেসড ভায়োলন্সের (এসজিবিভি) শিকার হয়েছে।
শিশু নির্যাতনের বিষয়টি সব সময়ই খুব ভয়ংকর। আর যখন সেটি হয় যৌন নির্যাতন সেটি তো আরো ভয়ংকর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুটি বুঝতেই পারে না তার সাথে কি হচ্ছে। আর এই ঘটনাগুলো শিশুটির মনে দীর্ঘদিনের জন্য কালো ছাপ রেখে যায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তার আচরণে, বিকাশে আর দৈনন্দিন জীবনে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিশুটি তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। মানুষের প্রতি তার বিশ্বাস উঠে যায়। নিজেকে ঘৃণা করতে, অপছন্দ করতে শুরু করে।
আরো দুঃখজনক ব্যাপারটি হল শিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ কেসেই দেখা যায় শিশুটি যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার কোন কাছের ব্যাক্তি দ্বারা। আদরের ছলে, কোন কিছু উপহার দেওয়ার ছলে দিনের পর দিন শিশুটিকে নির্যাতন করে যাওয়া হয় তা বাবা-মা এমনকি প্রথমদিকে শিশুটিও বুঝতে পারে না। আর বুঝতে পারার পরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ঘটনাগুলো চেপে যাওয়া হয়। শিশুকে চাপ দেওয়া হয় কাউকে না বলতে। বিষয়গুলোকে কখনো বিচারের আওতায় আনা হয় না। এভাবে করে শিশুটির মানসিক অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হয়। অনেকে প্রচন্ড ভায়োলেন্ট হয়ে যায়, অনেকে একদম নিষ্প্রাণ হয়ে যায় আবার অনেকে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ!
এই চিত্রগুলো পরিবর্তন করার জন্য সবার প্রথমে এগিয়ে আসা দরকার মা-বাবার এবং এরপর সামাজিক সংস্থাগুলোর। আপনার শিশুকে ছোট থেকেই তার শরীর সম্পর্কে সচেতন হতে শেখান। তাকে তার শরীরের গোপন অংশগুলো সম্পর্কে সচেতন করুন। তাকে শেখান এই জায়গাগুলোতে একমাত্র মা-বাবা এবং ডাক্তার ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। এবং মা-বাবা, ডাক্তার করলেও তারা প্রয়োজনে করবেন।
শিশুর সাথে আপনার সম্পর্ক সহজ রাখুন। তারা যেন নির্ভয়ে আপনার সাথে কথা বলতে পারে এই পরিবেশটি তৈরি করুন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় আপনার শিশুকে সম্মান করতে শিখুন! শুনতে হয়ত কিছুটা অবাক লাগতে পারে। কিন্তু এই বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। আমাদের বাবা-মায়েরা, বড়রা শিশুদের সম্মান এবং গোপনীয়তা নিয়ে একদমই সচেতন থাকেন না। অনেক সময়ই দেখা যায় চাপ প্রয়োগ করে শিশুকে কারো সাথে খেলতে বা থাকতে পাঠানো হয়, বড়দের অসম্মান হবে বলে শিশু না চাইলেও শিশুকে তার কোলে দেওয়া হয়, যেখানে সেখানে শিশুর জামা পরিবর্তন করা হয়। আর এসব বিষয়েরই কিন্তু সুযোগ নিয়ে থাকেন নির্যাতনকারীরা। তাই আপনার শিশুর কথা শুনুন। সে কারো কাছে যেতে না চাইলে জোর করবেন না। আমরা অনেক সময় মনে করি শিশুরা কিছু বুঝতে পারে না। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। শিশু কথা বলতে শেখা শুরু করার সময় থেকেই অনেক কিছু বুঝতে পারে। তারা নাম না জানলেও বলতে না পারলেও বিষয়গুলো অনুভব করতে পারে।
আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে আপনারা অপরাধকে চাপা দিয়ে রাখবেন না। আপনারা ভিকটিমের বদলে যে দোষী তাকে দোষারোপ করতে শিখুন। আজ আপনি একজনকে ছাড় দিলে সে আরো দশটি বাচ্চার শৈশবকে নষ্ট করবে। দানবকে বাড়তে দেবার আগে তাকে শুরুতেই নির্মূল করুন। মনে রাখবেন সমাজ আমাদের না আমরা সমাজ তৈরি করি। আমরা নিজেদের মাঝে বদল আনলে সমাজ ও বদলে যাবে। তাই সমাজের ভয়ে নিজের সন্তানটিকে মেরে ফেলবেন না। নিজের সন্তানের পাশে থাকুন। অপরাধীর শাস্তি দিন এবং শিশুদের জন্য একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলুন।
এরপর একটু আলাদা করে চলে আসে ছেলে শিশুদের কথা। আমাদের দেশসহ এই উপমহাদেশে জন্মের পর থেকে ছেলে শিশুদের শিখিয়ে আসা হয় তাদের শক্ত হতে হবে, কাঁদলে চলবে না ইত্যাদি! আর একারনেই অনেক ছেলে শিশু নির্যাতনের শিকার হলেও বলতে চায় না। তারা ভাবে তাদের দুর্বল বলা হবে। আর এভাবে করে এই বিষয়গুলো চাপা পড়ে যায় আর ছেলে শিশুটির মাঝে তৈরি হয় নানা ধরণের জটিলতা। তারা নিজেদের ঠিকভাবে প্রকাশ করতে শেখে না, নিজেকে জানতেও শেখে না। তাই আপনি আপনার ছেলে শিশুটিকে ছেলে হিসেবে গড়ে তুলবার আগে একটি স্বাভাবিক শিশু হিসেবে গড়ে উঠতে দিন। তাকে তার আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতে দিন।
শেষ করবার আগে পথ শিশুদের কথা না বললেই নয়। বাংলদেশের ৭ লাখেরও বেশি পথ শিশু রয়েছে এবং এদের ৮৭% মাদকে আসক্ত। এদের অধিকাংশই তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার কারণে মানসিক ভাবে প্রচন্ড ভীতসন্তস্ত্র এবং তাদের মানসিক বিকাশ প্রচন্ডভাবে বাধাগ্রস্থ। এরা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া শারিরীক এবং যৌন নির্যাতনগুলোকে আলাদাই করতে পারে না। এই শিশুগুলোকে রক্ষা করার জন্য সকল সরকারী এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর দ্রুত এগিয়ে আসা খুবই জরুরি।
আমাদের আজকের শিশুরা আগামীর ভবিস্যত। আজ আমরা শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের কথা তো চিন্তাও করা যায় না। শিশু নির্যাতনের পরিমানকে শূন্যের কোঠায় আনতে হবে। আর এটি বাস্তবায়নের জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরের অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজন।
রেফারেন্সঃ
১। https://www.dhakatribune.com/bangladesh/nation/2019/02/11/study-7-lakh-street-children-need-care
২। https://tbsnews.net/bangladesh/violence-abuse-and-drugs-life-street-children
৩। https://tbsnews.net/bangladesh/crime/sexual-assault-against-children-rose-70-2019-report
৫। https://www.jennifersoldner.com/2015/01/the-problem-with-good-touch-bad-touch.html
৭। https://www.aa.com.tr/en/asia-pacific/bangladesh-child-sexual-abuse-reportedly-on-rise/1696828
1 Comment
Pingback: আপনার শিশুকে ভালো এবং মন্দ স্পর্শ সম্পর্কে শেখান – Roar Media