বাংলাদেশের মতো হাভাতে লেবার-রাষ্ট্রগুলো থেকে সৌদিতে শ্রম বিক্রি করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসা শবদেহের শরীরজুড়ে যা দেখি তাতে মানবসভ্যতার বড়াই নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠি।
কোনমতে জান বাঁচিয়ে ফিরে আসা নারীদের মুখ থেকে আরব্য আচরণ নিয়ে যা শুনি তাতে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি।
অবশ্যই এসমস্ত ঘটনা সম্প্রতি ঘটে চলা হঠাৎ দৃশ্যমান কোনও বাস্তবতা না।
নারীর প্রতি এই দেশগুলোতে ঘটে যাওয়া বর্বরতার প্রতিবাদে ২০১১ সাল থেকে সেখানে নারী শ্রমিক সরবরাহকারী ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কাসহ প্রায় সকল রাষ্ট্র শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রেখেছে। এবং কেউ কেউ পাঠালেও সৌদি সরকারের সাথে গ্যারান্টি ক্লজ যুক্ত সুপষ্ট চুক্তি সম্পন্ন করে পাঠাচ্ছে। অথচ যাচ্ছেতাই উন্নয়ন প্রদর্শনে ব্যস্ত বাংলাদেশ সরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সৌদি বর্বরতার অজস্র নজির থাকা সত্ত্বেও কোনও যুক্তি ব্যতীত নামমাত্র সমঝোতায় স্বাক্ষর করে বিশ্বের সর্বনিন্ম মজুরিতে সেখানে নারী শ্রমিক পাঠানোর রেকর্ড উদযাপন করেছে।
বিপরীতে ভয়াবহ যে দৃশ্যায়নের অবতারণা ঘটছে সেটাও সবাই জানে। যৌন নির্যাতনসহ অন্তত ১১টি কারণে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৮ জন নারী সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশী দূতাবাসে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রতিমাসে গড়ে ২০০ এর অধিক নারী খালি হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। হিসেবমতে, সাড়ে তিন বছরে প্রায় সাড়ে তিনশ নারী শ্রমিকের লাশ এসেছে, যাদের মধ্যে ৫৩ জনই নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছে। এবং আত্মহত্যার এই হার তিন বছর আগের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি, মানে নারীর প্রতি সৌদি নির্মমতা ১৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই যে নারীরা, বিশেষকরে যৌন হয়ে নির্যাতিত দেশে ফিরছে যারা- তাদের অনেককেই নিজ পরিবার ও সমাজ মেনে নিচ্ছে না। এবং নির্যাতন ও মানবেতর আচরণকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট সৌদি মালিকের বিরুদ্ধে তারা কোনও আইনী ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। কেননা, সেটা করতে গেলে মামলা নিস্পত্তি হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে সৌদিতে অবস্থান করতে হয় যা তাদের জীবনের জন্য নিরাপদ না। এছাড়া সৌদি থেকে দেশে ফিরতে হলে সংশ্লিষ্ট মালিকের ছাড়পত্র লাগে, যেখানে তাদেরকে নিয়োগকর্তা কোনও খারাপ আচরণ বা শর্ত ভঙ্গ করেনি টাইপের লিখিত বিবরণী দাখিল করতে হয়।
আর একারণেই এতবড় অপরাধের ক্রমবর্ধমান বাস্তবতা সত্ত্বেও সংলিষ্ট সৌদিয়ানদের বিরুদ্ধে তেমন পদক্ষেপ নেয়ার কথা শুনা যাচ্ছে না। অবশ্য এটা শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ অর্থাৎ লেবার-রাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যর্থতা। সরকারকেই এই ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে, এবং এই ব্যর্থতা মোচনে কিছু অবশ্যকীয় কর্তব্য পালন করতে হবে। সৌদিতে নারী নির্যাতন ও খুনের প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যানার থেকে আয়োজিতব্য গণজমায়েতে যে দাবিগুলো উত্থাপন করা হচ্ছে, অনতিবিলম্বে এগুলো মেনে নিতে হবে। দাবিগুলো হচ্ছেঃ
১। ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়া সত্ত্বেও রেমিটেন্সের লোভে স্রেফ সমঝোতার ভিত্তিতে সরকারের যারা বাংলাদেশী নারীদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
২। নারী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন ও ধর্ষণের খবর জানা স্বত্ত্বেও দূতাবাস ও মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৩। সৌদি মালিকের নির্যাতনে মৃত্যু এবং আত্মহত্যার শিকার নারী-শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ন্যূনতম ২ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৪। সৌদি থেকে নির্যাতিত হয়ে স্বদেশে ফিরতে বাধ্য হওয়া নারীদেরকে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রতি ন্যূনতম ১ কোটি টাকা প্রদান করতে হবে।
৫। যেসমস্ত নারী সৌদি আরবে নির্যাতন-নিপীড়নে শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাদেরকে সরকারের নিজদায়িত্বে দেশে ফেরত আনতে হবে এবং ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৬। নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনাদানকারী হিসেবে অভিযুক্ত সৌদি নাগরিকদের বিচারের আওতায় আনতে সৌদি সরকারকে চাপ দিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৭। সৌদি আরবে শ্রমিক হিসাবে নির্যাতিত নারীর মামলা করার প্রক্রিয়া সহজ ও মানবিক করতে সৌদি সরকারকে চাপ দিতে হবে। মামলা নিস্পত্তি হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে সৌদিতে থাকার বাধ্যবাধকতা বাতিল করতে হবে।
৮। নির্যাতনের মুখে দেশে ফেরার প্রচলিত নিয়মানুসারে ‘নিয়োগকর্তা তাঁর সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ বা শর্ত ভঙ্গ করেনি’ টাইপের লিখিত বিবরণী দেয়ার বাধ্যবাধকতা বাতিল করতে সৌদি সরকারকে চাপ দিতে হবে।
৯। নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে আসা নারীদের পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো পরিবার জায়গা দিতে না চাইলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এবং এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
১০। সৌদিতে নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো অর্থ লেনদেনের শর্ত না থাকা সত্ত্বেও যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি নারী শ্রমিকদের কাছ থেকে টাকাপয়সা নিয়ে থাকে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
১১। অতিরিক্ত মুনাফার জন্য মধ্যস্বত্ত্বভোগী রিক্রুটিং এজেন্সি, যারা নারী শ্রমিকদেরকে অন্যদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
১২। রিক্রুটিং এজেন্সি কর্তৃক সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিকের দায়দায়িত্ব ৩ মাসের বদলে পুরুষ শ্রমিকদের মতোই ২ বছর করতে হবে।
১৩। কোনো সমঝোতা চুক্তির ওপর ভিত্তি করে নয়, সরাসরি আইনী প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ চুক্তির মাধ্যমে নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাতে হবে। চুক্তিতে শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি ক্লজ যুক্ত থাকতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রক্তের মতো সর্বগুরুত্ববহ উপাদানের ভূমিকা রেখে চলেছে রেমিটেন্স নামক যে প্রবাসী শ্রমিকদের শ্রম ও ঘামের অবদান, সেই অবদানকে সম্মান জানানো মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষের কর্তব্য জ্ঞান করতে হবে। এবং প্রবাসী শ্রমিকদের, বিশেষত নারী শ্রমিকদের ওপরে চলমান বাস্তবতা নিরসনে যদি সরকার সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না রাখে তাহলে তারা সমাজদেশের সর্বস্তরে ধিক্কৃত হবে।
এইসকল দাবিগুলোকে সামনে রেখে আমরা এই শুক্রবার সকাল ১০ টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনে দাঁড়াবো। সাথে থাকবেন গণঐক্যের বন্ধুরা। সকলকে আমাদের সাথে যোগদানের আহ্বান জানাই।
ফেসবুক ইভেন্টে যোগ দিন এখানেঃ www.facebook.com/events/553197272103989
মুক্তিফোরামের পক্ষে এ সম্পাদকীয়টি লিখেছেন চারু হক