Site icon মুক্তিপত্র

দ্য আর্ট অফ কন্সপায়রেসি থিউরি

আমি সবসময়ই মনে করি, ব্লগার হত্যা, শাহবাগের সময়ে থাবা বাবা হত্যা, আসিফ মহিউদ্দীনের উপর হামলা, পরে প্রকাশক দীপন হত্যা, নির্বাচনের আগে লেখক অভিজিৎ হত্যা এসব উগ্র জঙ্গী ইস্লামিস্টদেরই কাজ। জঙ্গীরাই এই ঘটনা গুলো ফিজিক্যালি ঘটিয়েছে। তবে অনেকেই বলেন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই মনে করেন, এই কোনটাই বিচ্ছিন্ন ভাবে হয়নি, এই সবকটি ঘটনাই এজেন্সি গুলো আয়োজন, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। সরকারের যখন দরকার হয়েছে, এগুলোর ঘটনকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। পরিবার গুলো এসব বুঝতে পেরেছে বলেই চার্জশীট মানতে পারছে না। আলামত নষ্ট করা হয়েছে, খুনীদের ক্রসফায়ারও হয়েছে। এই হামলা ও হত্যা গুলো ঠিক যে যে উদ্দেশ্যে হয়েছে, সরকার প্রত্যাকটি ঘটনা থেকে তার সর্বোচ্চ ফায়দা উঠিয়েছে। সেখান থেকে তার কিছু পাওয়ার নেই, তাই আলামত নষ্টের সব আয়োজনের পরে মামলা গুলোও গতি হারিয়েছে। বাংলার জঙ্গী ইসলামিজম এজেন্সিরই কারসাজি, ব্যাপারটা পুরোপুরি তা নয় যদিও , তবে সরকার তার প্রয়োজন মত এদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে, নাটাই ঘুরায় এবং ছুঁড়ে ফেলে যথাসময়ে।

করোনাকালে শেখ হাসিনা সরকার সর্ব বিষয়ে নিন্দিত হয়ে পড়েছেন। উনার মন্ত্রীরা হয় চোর, না হয় নিদারুণ ভাবে অযোগ্য ও ব্যর্থ। শেখ হাসিনা এরশাদের আমলাতান্ত্রিক মডলে ফিরে গিয়ে সচিবদের দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন। ব্যাংক চুরি, ত্রাণ চুরি, চাল চুরি, ঔষধ চুরি, পিপিই চুরি সহ সর্ব প্রকার প্রকল্প চুরি ও নিন্ম মান উন্নয়ন কাজের পর এমন একটি ইস্যু নেই যা নিয়ে শেখ হাসিনা স্বস্তিতে আছেন। রাজস্ব আয় ব্যাপক কমে গেছে। করোনার কারনে ৫ কোটি লোক নতুন করে স্থায়ী বেকারত্বের ঝুঁকিতে। প্রায় সাত কোটি লোক ব্যবসা, চাকরি ও সঞ্চয় হারিয়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে গিয়েছেন কিংবা যাবার অপেক্ষায় আছেন।

এদিকে এরশাদ সাহেব মরে গেছেন বলে শেখ হাসিনার পক্ষে সামনের নির্বাচনে ‘ব্যালট ডাকাতি, জাল ভোট কিংবা রাতের ভোটের মডেলে’ আরেকটা নির্বাচন সাজানো খুব মুশকিল। ভারত-চীনের পাল্টে যাওয়া কূটনৈতিক আবহে ভারতের সহায়তা অনিশ্চিত, চীনের সহায়তা অপরীক্ষিত। ফলে সমাজের মানুষের মধ্যে ক্যাচাল লাগানোর, নির্বাচন জেতার জন্য চাই নতুন সব কৌশল। চারপাশের আলামত দেখে মনে হচ্ছে, সেই কৌশলের বীজ রোপনের সময় শুরু হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কৌশলী রাজনীতিবিদ।

আমি মনে করি, আয়মান সাদিককে ”হাজার হাজার” বার হত্যার হুমকির ঘটনা সত্য হতে পারে। অন্তত ‘হাজারে হাজারে’ না হলেও অন্তত ‘শত শতবার’ হবে। অনেকেই বলছেন, এই কাজগুলো আমাদের সরকারের এজেন্সিরা নিয়ন্ত্রণ করছে, আওয়ামী ওলামালীগ এগুলার বাস্তবায়ন করছে। আর বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত, ধর্মীয় ও সামাজিক অশিক্ষায়-কুশিক্ষার বাংলাদেশে এগুলা করতে উন্মাদ, জঙ্গী ও সহমত লীগ ভাড়া করা খুবই সহজ। আবার কথায় কথায় কল্লা ফেলে দেয়ার, যাকে তাকে যখন তখন কাফের ঘোষণা করার মত ধর্মান্ধ উন্মাদও এখানে আছে বেশ। ফলে সরকারের জন্য একটা উইন উইন সিচুয়েশান বিরাজ করছে। গ্রামীণফোনকে ডাউন দিতে ‘রবি’ শুরু থেকেই সরকারের সাথে বিশেষ সম্পর্কে লিপ্ত। ভালো স্পেকট্রাম বরাদ্দ, বকেয়া আদায়, জিপির নতুন সীম ও প্যাকেজের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং জিপির বিপণন নিষেধাজ্ঞা সব কিছুতে ‘রবি’র সাথে সরকারের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর প্রমাণ আছে। এবং অনেকে এও সন্দেহ করেন যে, রবি টেন মিনিট স্কুলের সমকামীতা বিষয়ক ভিডিও (তার মধ্যে যাই থাকুক, দেখিনি আমি) কন্টেন্টও পরিকল্পিত হতে পারে। এই পুরো ঘটনা আয়মান সাদিকের জানার বাইরেই হয়েছে, কর্পোরেট ইনফ্লুয়েন্সে হয়ে থাকতে পারে, যাতে এজেন্সির ইন্ধন থাকতে পারে। এটা কন্সপাইরেসি থিউরি হলেও বিচ্ছিন্নভাবে হঠাত করে এটা কেউ তৈরি করে দেয়নি হয়ত। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আয়মান যা বলছেন তা সত্য। তার জীবননাশের আশংকাও পুরোপুরি সত্যই মনে হচ্ছে।

এই রেজিম ক্যাল্কুলেটিভ রেজিম। একটা ফ্যাসিস্ট রেজিম যেভাবে তাঁর সব ফ্রন্ট সেট করে থাকে, এই রেজিম তাই। এই রাষ্ট্রের কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন ভাবে হয়ে যায় না। যদিও শত সহস্র বার ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে দাবী করা হয়, উপস্থাপন করা হয়।

ফলে করোনার ব্যর্থতা ও চিকিৎসা বিপর্যয় ঢাকতে, টালমাটাল আর্থনীতি আড়াল করতে, ব্যাংক লুট অব্যহত রাখতে, খাদ্য সংকট ও বেকারত্ব অস্বীকার করে সমাজে ক্যাচাল লাগিয়ে দিতে, এবং একই সাথে আরেকটি বলপ্রয়োগের নির্বাচনের আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগানর ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করতে রেজিমের যদি ‘আয়মান সাদিক’ কিংবা ‘রবি’ টেন মিনিট স্কুলের কোন শিক্ষককে হত্যা করার দরকার পড়ে, কিংবা হিন্দু মন্দির ভাঙ্গা ভাঙ্গা লাগে, সংখ্যালঘু পিটানো লাগে, রোহিঙ্গাদের সহিংস করা লাগে, বৌদ্ধ হত্যা লাগে কিংবা আমাদের প্রিয় নবীজী (সা) কে গালি দেয়ার মত চাঞ্চল্যকর কোন ইস্লামিস্ট ইস্যুর দরকার পড়ে- রেজিম এজেন্সির নিয়ন্ত্রণে পোষা ইস্লামিস্ট জঙ্গীদের দিয়ে তাই করবে। তাই করে ছাড়বে। এবং ঘটনার পরে যায়গামত শেখ হাসিনাও সহানুভূতি, আর্থিক সাহায্য দিতে বাসায় বাসায় যাবেন। নিজে কাঁদবেন, দেশের ও দেশের বাইরের এলিট সেটেলমেন্টের সবাইকে অঝোরে কাঁদাবেন।

চারদিকে রব উঠবে, জঙ্গী পেটাতে, ধর্মান্ধ হুজুর সামলাতে বারবার দরকার, শেখ হাসিনার সরকার। তখন সর্ব বঙ্গীয় সহমত লীগের ঘরে ঘরে শুরু হবে নবান্নের উৎসব পার্বণ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হয়রানি, মামলা, জেল জুলুম ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে। (ছোট্র করে বলে রাখি, বিগত কয়েক মাসে আমিও কয়েকবার গালি/ হুমকি পেয়েছি। রাষ্ট্রচিন্তার প্রোগ্রাম শুরু হলেই তারা এসে হাজির হয়। ইদানিং অন্য এক্টিভিস্টদেরকেও সামানে গালিগালাজ ও হুমকিতে রাখা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ন সব ফেইসবুক আইডি হ্যাক হচ্ছে!)

এদিকে মাওলানা বাবুনগরীকে বের করে দিয়ে বা দমিয়ে দিয়ে হেফাজতের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সরকার নিয়েছে মাত্র গত মাসেই। এমতাবস্থায় ইস্লামিস্টদের সুতার নাটাইও সরকারের কব্জায়। হতে পারে সমকামীতার ইস্যু সফল হবে না। তবে নারীবাদী, সংখ্যা লঘু কিংবা রোহিংগাদের সহিংস হবার মত ইস্যু তৈরির সব উপযগীতাই তো রেডি আছে। আর আমরাও ক্যাচালে লিপ্ত হতে বড্ড আরাম পাই!

কথা ছিল-
স্বাস্থ্যখাত বিপর্যয়, চিকিৎসা বৈষম্য ও ভিয়াইপিগিরি, বাজেটে মাথাপিছু ডাক্তার-নার্স-বেড-আইসিইউ ইত্যাদি চিকিৎসা ফ্যাসিলিটির টার্গেট না থাকা, চিকিৎসার নামে মানুষ হয়রানি, অক্সিজেন স্বপ্লতা, অতি মৃত্যু, টেস্টের নামে ভন্ডামি, সাধারণ মানুষের দীর্ঘ ভোগান্তি, নেতাদের পলায়ন, পুনঃ তফশীলের নামে ব্যাংক লুট, চাল চুরি, ত্রাণ চুরি, খাদ্য ও মানবিক সংকট, করোনা কালে শ্রমিক ছাটাই, আগাম বন্যার ফসলহানি রোধের ব্যবস্থা না করা ইত্যাদি নিয়ে আপনারা সবাই একযোগে শেখ হাসিনা সরকারের মুন্ডপাত করবেন।

আজ আপনারা পড়ে আছেন সমকামীতা, পায়ুকামীতা এসব নিয়ে, কাল হয়ত আরেকটা কিছু নিয়ে। কিন্তু অধিকার আদায়ের সংগ্রামটাই আপনারা ভুলে গেছেন। সরকার বুঝে শুনেই কলকাঠি নাড়ে, আপনারাও পারেন বটে! এভাবেই বার বার একটা স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট সরকার সমাজ বিভক্ত করে পার পাচ্ছে।

শুধু নিরর্থক আলোচনা-সমালোচনা কেন্দ্রিক ক্যাচালে না জড়িয়ে, রাজনীতিকে রিড করুন। নিজের ঈমান ও নবীজির সম্মানকে হৃদয়ের গহীনে সুরক্ষিত রেখে ফ্যাসিবাদ হটানোর কৌশল ঠিক করেন। সামাজিক অপরাধ হটাতে চান তো আগে রাজনৈতিক অপরাধ হটান। রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ হটানো গেলে আপনার মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের অধিকার, অর্থনৈইতিক অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা তো ফিরে পাবেনই, সাথে রক্ষা পাবে আপনার ঈমান আকিদ্বাও! সরকারের যাবতীয় জুলুমকে মেনে নিয়ে বিশেষ বিশেষ সেন্সিটিভ ধর্মীয় ইস্যুতে জেগে উঠার চল, আপনাকে জুলুম থেকে বের করবে না বরং জুলুমের চক্রেই আবদ্ধ রেখে ফ্যাসিস্ট রেজিমকে শক্তিশালী করবে। বিগত দশকে ঠিক তাই করেছে।

ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ, গবেষক,লেখক।

Exit mobile version