গণতন্ত্র গণতন্ত্র বা নির্বাচন নির্বাচন খেলা আমাদের জীবনে শুরু হয়েছে স্কুল জীবনের শুরু থেকে বা তারও আগে।
এই খেলা শুরু করেছি ১৯৯০ এর দশকে যখন প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলাম। তখন থেকেই বুঝি গণতন্ত্র মানে মারামারি। মারামারি না হলে নির্বাচন বা গণতন্ত্র হয় না। তাই আমাদের এই খেলা শুরুর আগে থেকেই মারামারি করার জন্য সরঞ্জামাদি যোগাড় শুরু হতো।
যদি পাশবিক শক্তির কারণে রাষ্ট্রীয় সর্বশক্তি গণতন্ত্রের নামে সংঘটিত নির্বাচনের সঠিক সিদ্ধান্ত বা ফলাফল প্রকাশ করতে না পারে তবে রাষ্ট্রীয় কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে এই অনুষ্ঠান করা অনর্থক।
যোগ্যতা, জ্ঞান, সততা যেখানে কোন বিবেচ্য বিষয় নয় বরং ভোটারদের যোগ্যতা যাই হোক না কেন বা যার পেশি শক্তি বেশি সে জয় লাভ করুক বা না করুক রাজত্ব করে, যেটি নিশ্চয়ই মানবকল্যাণের জন্য উপযোগী হতে পারে না। এই ধরনের ব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র হলেও সেটি অসার। সুতরাং এটি পাগলের সিদ্ধান্ত বা বিশৃঙ্খলাতন্ত্র বৈকি। কারণ একজন অযোগ্য লোক কোন কারণে ভোট বেশি পেয়েই যোগ্য হয়ে যায় না। কিন্তু আমরা তাকে আমাদের তথা রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব তুলে দেই। তারপর তিনি আমাদের ভাগ্য নিয়ে তার জ্ঞান, যোগ্যতা অনুযায়ী যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তাই করে আমাদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন।
আবার একজন জ্ঞানী, যোগ্য এবং সৎ মানুষ কোন কারণে বেশি ভোট না পেলেই তিনি অযোগ্য হয়ে যান না। কিন্তু আমরা তাকে অযোগ্যদের কাতারে দাঁড় করিয়ে দেই এই গণতন্ত্র তথা বিশৃঙ্খলাতন্ত্রের মানদণ্ড দিয়ে।
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া দুটি পলিসির মধ্যে একটি আরেকটির সাথে সাংঘর্ষিক।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া বা আমরা নিজেরাই নিজেদের উন্নত ভাবার জন্য গৃহিত একটি পলিসি।
গণতন্ত্রের মূল শক্তি হলো অধিক জনসংখ্যা। অর্থাৎ যার যত জনসংখ্যা বা জনসমর্থন সেই জয়ী। আর যারা প্রার্থী হবেন তারা পাগল, মূর্খ, অশিক্ষিত, অযোগ্য, সন্ত্রাসী, কালোবাজারি, দূর্নীতি পরায়ন, ঘুষখোর, সূদখোর ইত্যাদি হলেও বর্তমান প্রচলিত গণতন্ত্রের কিচ্ছু আসে যায় না। যেকোনোভাবে অধিক জনসংখ্যার সমর্থন পেলেই সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনার ভার তাদের হাতে ন্যাস্ত হয়।
আবার যারা ঐ সমস্ত প্রার্থীদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন তাদের মধ্যেও যদি উপরিউক্ত পাগল, মূর্খ, অশিক্ষিত, অযোগ্য, সন্ত্রাসী, কালোবাজারি, দূর্নীতি পরায়ন, ঘুষখোর, সূদখোর বিষয়গুলো বিদ্যমান থাকে তাহলেও প্রচলিত গনতন্ত্রের কিচ্ছু আসে যায় না।
সেকারনেই বোধ হয় গণতন্ত্রকে মূর্খের ও অযোগ্যের শাসন ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন প্লেটো এবং এরিস্টটলের মতো বিশ্ব বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা।
অন্যদিকে, বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া বা আমরা নিজেরাই নিজেদের উন্নত ভাবার জন্য গৃহিত আরেকটি পলিসি। যার মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলিম দেশ গুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে জনসংখ্যা হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ।
গনতন্ত্রের জন্য যত জনসংখ্যা হয় ততই ভালো। সেদিক বিবেচনা করলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কৌশল বা পলিসি অবলম্বন করার কথা। সেটি না করে মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে পশ্চিমা বিশ্ব।
পশ্চিমারা নিজেদের দেশে গনতন্ত্র এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কৌশল আর মুসলিম দেশে গণতন্ত্র এবং জনসংখ্যা হ্রাস করনের যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা কৌশলগত আর নীতি-নৈতিকতার বিবেচনায় পরস্পর বিরোধী
তবে পশ্চিমা অনেক দেশে আবার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয় বরং বিপরীত পলিসি অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কৌশল হিসাবে যারা অধিকবার মা-বাবা হন বা অধিক সন্তান গ্রহণ করেন তাদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনেক প্রণোদনা দেওয়া হয়। সুতরাং পশ্চিমারা নিজেদের দেশে গনতন্ত্র এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কৌশল আর মুসলিম দেশে গণতন্ত্র এবং জনসংখ্যা হ্রাস করনের যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা কৌশলগত আর নীতি-নৈতিকতার বিবেচনায় পরস্পর বিরোধী।
এই নির্বাচন নির্বাচন বা গণতন্ত্রের খেলায় মারামারি, ধনসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি আর জীবননাশের ঘটনা অনিবার্য। মুসলিম বিশ্বের নির্বাচন হোক বা অন্য যে কোন উপায়ে হোক জনসংখ্যা হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ হলেই পশ্চিমাদের গৃহিত পলিসির উদ্দেশ্য সফল।
বিশ্বের অনেক বিশেষজ্ঞের মতামত অনুযায়ী বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বের সকল পলিসি স্যামুয়েল হান্টিংটনের “সভ্যতার সংঘাত” থিসিস দ্বারা প্রভাবিত।
কারন স্যামুয়েল হান্টিংটন তার “সভ্যতার সংঘাত” থিসিসে দেখিয়েছেন মুসলিম জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৭০ সাল নাগাদ ইসলামী সভ্যতা বিশ্ব শাসন করবে। আর সেই আশঙ্কা থেকেই যেকোনো উপায়ে বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা হ্রাস করা পশ্চিমাদের পলিসি প্রতিযোগিতা। হোক সেটি পারস্পরিক সাংঘর্ষিক সেদিকে লক্ষ্য করার সময় নেই তাদের।
তবে উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের জনক এডওয়ার্ড সাঈদ হান্টিংটনের জবাব দিয়েছিলেন তার ‘ক্ল্যাশ অফ ইগনোরেন্স’ বইয়ে। তিনি হান্টিংটনের এই তত্ত্বকে বর্ণবাদী বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন এবং হিটলার যেমনভাবে ইহুদিদেরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন, হান্টিংটনও তেমনিভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছেন বলে মতামত দিয়েছেন।
আরেক বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ নোয়াম চমস্কি এই তত্ত্ব নিয়ে বলেছেন, এটি মূলত স্নায়ুযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ফাঁকা স্থানকেই পূরণ করার উদ্দেশ্য নিয়েই তৈরি করা হয়েছে, যাতে তাদের নাম দিয়ে যেকোনো ধরনের নৃশংসতা চালানো যায়।
বিশ্বে চলমান গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সমরতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্রে বিশ্ববাসীর অভিজ্ঞতা তিক্ত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের জন্য তো ইসলামতন্ত্র রয়েছে তবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দেশের জন্য একটি সাধারণ তন্ত্র বের করা যায়।
বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীর জন্য যেমন উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার পর নিয়োগ দেয়া হয়। সেই নিয়োগ প্রাপ্তদের মধ্য থেকেই পরবর্তীতে পেশাদারিত্ব এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর প্রধান হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
সাধারণত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কোন ধরনের পেশাদারিত্ব বা যোগ্যতার অভাব বা অভিযোগ জানা যায় না।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এমন একটি বিভাগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে অথবা বর্তমানে দেশে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে সেখানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহী তারা একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভর্তি হবেন। সেখানে ভর্তিকৃতদের মধ্য থেকে যারা উত্তীর্ণ হবেন তাদের সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ইত্যাদির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট একটি কমিশন নির্দিষ্ট বাছাই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনার স্থানীয় সরকারের প্রথম ধাপ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, তারপর সভাপতি, এরপর উপজেলা পরিষদের সদস্য ধারাবাহিকভাবে সংসদ সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত করবেন।
যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহী থাকবেন তারা ক্যারিয়ারের শুরুতেই প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। যারা বাছাই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপরিচালনার মেইনস্ট্রিম কর্মকান্ডে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না তারা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকান্ডে নিযুক্ত হবেন। এক্ষেত্রে জনগণ সন্তুষ্ট থাকবেন কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। তবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে সাপ্লাই-ডিমান্ড চেইন ঠিক রাখতে হবে।
এ পদ্ধতি শুধু রাষ্ট্র পরিচালনা নয় অন্যান্য সেক্টরেও অনুসরণ করলে দেশে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরির পথ উন্মুক্ত হবে। কেননা কেউ ক্যারিয়ারের মাঝ পথে এসে তার ক্যারিয়ার বদল করার সুযোগ পাবেন না বরং নিজ যোগ্যতার সেক্টরে মনোযোগ সহকারে কাজ করে অধিক যোগ্যতা অর্জন করার সুযোগ পাবেন।
বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে “ক্লাসের সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থী ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের মানুষকে সেবা দেয় আর রাস্তাঘাট, দালানকোঠা বানায়। মাঝারি ধরনের শিক্ষার্থী প্রশাসনে যুক্ত হয়ে ঐ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের পরিচালনা করে। আর সবচেয়ে খারাপ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ফেইল করে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।”
তবে উপরিউক্ত পদ্ধতি চালু হলে আমাদের আর ফেইল করা শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে না এবং প্রবাদটি অকার্যকর হয়ে পড়বে।
এটিকে যোগ্যতাতন্ত্র বলা যেতে পারে। সমস্ত প্রক্রিয়ায় সততা থেকে বিচ্যুত হলে যোগ্যতাতন্ত্র ও ব্যর্থ হবে। এভাবে অন্যান্য তন্ত্রের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে কেবল যোগ্যতাতন্ত্রের মাধ্যমেই বিশ্ববাসীর মুক্তি হতে পারে।
মুহাম্মদ আল-হেলাল, এমফিল গবেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়