সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে চলমান সংঘাত ও মানবিক সংকটের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি মানবিক করিডোর চালুর কথা ভাবছে। এর উদ্দেশ্য, সংঘাতে আটকে পড়া রোহিঙ্গা ও রাখাইন জনগোষ্ঠীকে খাদ্য, চিকিৎসা ও অন্যান্য জরুরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।
প্রথম দর্শনে এই উদ্যোগ মানবিকতার অনন্য উদাহরণ মনে হতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো, এই সিদ্ধান্ত বহুমাত্রিক কূটনৈতিক, নিরাপত্তাগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। প্রশ্ন উঠছে- বাংলাদেশ কি নৈতিকতা আর রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দ্বন্দ্বে কৌশলগত ভুলের পথে হাঁটছে?
মানবিক করিডোর: মহৎ ধারণা, কঠিন বাস্তবতা
জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানবিক করিডোর হলো একটি সাময়িকভাবে নিরস্ত্রীকৃত এলাকা, যেখানে সংঘাত চলাকালীন নিরাপদে সাহায্য ও মানুষ পারাপার করা যায়।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যারা ২০১৭ সালের গণহত্যা থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছে। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও প্রত্যাবাসন এখনো অনিশ্চিত। এর মধ্যে আরেকটি করিডোর খুললে নতুন করে শরণার্থী প্রবেশের আশঙ্কা প্রবল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “যদি মানবিক করিডোর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে এটি অনিচ্ছাকৃতভাবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন প্রবেশদ্বার হয়ে উঠতে পারে, যা বাংলাদেশের ওপর বিদ্যমান চাপ আরও বাড়াবে।” (দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২০২৫)
সীমান্ত নিরাপত্তার নতুন ঝুঁকি
মানবিক করিডোর স্থাপন মানে সীমান্তে মানুষের ও পণ্যের চলাচল বেড়ে যাওয়া। আরাকান ও টেকনাফ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে পূর্ব থেকেই অস্ত্র ও মাদকের প্রবল প্রবাহ দেখা গেছে। করিডরের আড়ালে এটি আরও বিস্তৃত হতে পারে।
সীমান্তবর্তী সংকটপূর্ণ অঞ্চলসমূহ অস্ত্র ও মাদক পাচারের ঝুঁকিতে থাকে। কঠোর নজরদারি ছাড়া মানবিক করিডোর অপরাধ চক্রের জন্য নতুন পথ হয়ে উঠতে পারে।
বিশেষ করে ইয়াবা পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত নাফ নদী করিডরের আওতায় এলে বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি দেখা দিতে পারে।
মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্যে আঘাত
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়” এই নীতিতে বহুমাত্রিক কূটনীতি পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু এককভাবে মানবিক করিডোর স্থাপন করলে মিয়ানমারের দৃষ্টিতে এটি সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষক ফারহানা সোবহান বলেন, “একতরফা মানবিক উদ্যোগ মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে ক্ষুব্ধ করতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা এটিকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি মনে করে।” (সিপিডি পলিসি ব্রিফ, ফেব্রুয়ারি ২০২৫)
ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটার আশঙ্কা তৈরি হবে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্কে সম্ভাব্য টানাপোড়েন
মিয়ানমার চীনের এক কৌশলগত মিত্র, বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর আওতাধীন বিবেচনায়। বাংলাদেশ যদি মানবিক করিডোর ইস্যুতে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পদক্ষেপ নেয়, তবে তা চীনের কাছে অস্বস্তিকর হতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, “চীন মিয়ানমারকে তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখে। বাংলাদেশ যদি পশ্চিমা স্বার্থের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে মানবিক উদ্যোগ নেয়, তবে তা ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।” (চায়না-সাউথ এশিয়া জার্নাল, ২০২৩)
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান অবকাঠামো প্রকল্প, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য এই সম্পর্কে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে সামান্য কূটনৈতিক ভুল বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জটিল অবস্থান
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন মন্তব্য করেন: “বাংলাদেশকে মানবিক দায়িত্ব এবং ভূরাজনৈতিক নিরপেক্ষতার মাঝখানে খুব সতর্কভাবে পথ চলতে হবে। যদি বাংলাদেশ পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন হস্তক্ষেপের সঙ্গে অতিরিক্তভাবে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
(সূত্র: ডিপ্লোমেটিক ইনসাইটt, ২০২৫)
বাংলাদেশ বহুদিন ধরে “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরিতা নয়”—এই নীতিতে বিশ্বাস করে আসছে। কিন্তু মানবিক করিডোর চালুর মতো পদক্ষেপ সেই পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে, বিশেষ করে যদি তা বৃহৎ শক্তিগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আমাদের জড়িয়ে ফেলে।
এখানে “বৃহৎ শক্তিগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব” বলতে মূলত বোঝানো হচ্ছে চীন ও পশ্চিমা দেশসমূহের (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের) মধ্যকার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, যার কেন্দ্রস্থল বর্তমানে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, যার মধ্যে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এক্ষেত্রে কয়েক ধরনের ব্যাপার ঘটতে পারে:
বাংলাদেশের জন্য মূল ঝুঁকি হলো— যদি মানবিক করিডোর কোনো একটি জোটের (পশ্চিমা বা চীনকেন্দ্রিক) প্রভাববলয়ে পড়ে, তবে তা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলবে
চীন বনাম যুক্তরাষ্ট্র:
মিয়ানমারে চীনের বিরাট বিনিয়োগ রয়েছে—বিশেষ করে রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও পাইপলাইন প্রকল্প। চীন চায় সেখানে স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক, কিন্তু তারা সামরিক জান্তার সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থীদের সমর্থন করে এবং সামরিক জান্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
যদি বাংলাদেশ পশ্চিমা সহায়তায় করিডোর চালায় বা তাদের তত্ত্বাবধানে রিলিফ দেয়, তবে চীন সেটিকে নিজস্ব প্রভাব বলয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখতে পারে।
আসিয়ান (বিশেষ করে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর) বনাম পশ্চিমা মূল্যবোধ:
আসিয়ানের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো মিয়ানমারে সরাসরি হস্তক্ষেপে বরাবরই অনিচ্ছুক, তাদের অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে। সেখানে বাংলাদেশ যদি করিডোর পরিচালনা করে, তাহলে আসিয়ানকেও তার নিরপেক্ষতা থেকে সরে আসতে হতে পারে।
ভারত বনাম চীন প্রভাব:
রাখাইন অঞ্চল ভারতের “অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি” এবং “কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প”-এর অংশ। বাংলাদেশ যদি চীন-সমর্থিত বা পশ্চিমা-সমর্থিত করিডোর চালু করে, তা ভারতের দৃষ্টিতে নিরাপত্তা ঝুঁকি বা কৌশলগত বাধা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের জন্য মূল ঝুঁকি হলো— যদি মানবিক করিডোর কোনো একটি জোটের (পশ্চিমা বা চীনকেন্দ্রিক) প্রভাববলয়ে পড়ে, তবে তা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলবে।
অর্থনৈতিক বোঝা ও আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রশ্ন
একটি মানবিক করিডোর স্থাপন ও তা রক্ষণাবেক্ষণ বিশাল অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করে- বিশেষত নিরাপত্তা, খাদ্য ও অবকাঠামো খাতে। প্রশ্ন হলো, এই অর্থ কোথা থেকে আসবে?
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (BIDS) অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, “একটি মানবিক করিডোর স্থাপন ও তা চালিয়ে রাখা বিপুল খরচসাপেক্ষ — পরিবহন, নিরাপত্তা এবং অবকাঠামোতে। বর্তমান রাজস্ব ঘাটতির প্রেক্ষাপটে, বাহ্যিক সহায়তা নিশ্চিত করতেই হবে।” (বিআইডিএস ওয়ার্কিং পেপার, এপ্রিল ২০২৫)
আইএমএফ ও অন্যান্য দাতাসংস্থার ঋণের শর্তাবলিতে আবদ্ধ বাংলাদেশ এই মুহূর্তে নতুন বোঝা গ্রহণ করতে কতটা প্রস্তুত, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ।
কৌশলগত বিকল্প: বহুপাক্ষিকতা ও আঞ্চলিক সংলাপ
এই পর্যায়ে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিচক্ষণ কৌশল হবে একক সিদ্ধান্ত না নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ তানভীর হাসান বলেন, “বাংলাদেশকে বহুপাক্ষিকভাবে কাজ করতে হবে — আসিয়ান, ইউএনএইচসিআর এবং আঞ্চলিক প্রধান শক্তিগুলো যেমন ভারত ও চীনকে সম্পৃক্ত করে — যাতে এই করিডোরকে একতরফা পদক্ষেপ মনে না করা হয়।” (রাউন্ড টেবিল অন হিউম্যানিট্যারিয়ান ডিপ্লোমেসি, মার্চ ২০২৫)
এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (OIC)-এর মাধ্যমে এই করিডোরের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব।
মহৎ উদ্দেশ্য, পরিণামের দায়ও ব্যাপক
মানবিক করিডোর একটি সাহসী চিন্তা—অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য সহানুভূতির প্রমাণ। তবে কূটনৈতিক বাস্তবতা, আঞ্চলিক রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা যদি বিবেচনায় আনা না হয়, তবে এই উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পররাষ্ট্রনীতিকে অবশ্যই নৈতিকতা ও কৌশলের ভারসাম্যে পরিচালিত হতে হবে। আরাকান পরিস্থিতি একটি মানবিক সংকট—তাতে হস্তক্ষেপও হতে হবে মানবিক কূটনীতির মাধ্যমে, রাজনৈতিক উত্তেজনার মাধ্যমে নয়।
শেষকথা
বাংলাদেশের মানবিক করিডোর যদি আন্তর্জাতিক সমন্বয়, স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা এবং আর্থিক প্রস্তুতির আলোকে পরিচালিত হয়, তবে এটি একটি শক্তিশালী মানবিক পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু একপাক্ষিক ও কৌশলগতভাবে দুর্বল হলে তা হবে এক বিপজ্জনক ঝুঁকি।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন