আমি ধর্ম-কর্ম মানিও না, র্চচাও করি না। পোশাক- পরিচ্ছদ কেন্দ্রিক কম কাপড় বা বেশি কাপড় এই রকমের কোন সুচিবায়ুতা আমার নেই। শাড়ি পরতে আমার ভালো লাগে কারন ওটাতে আমাকে দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু দেশে থাকতে আমি বাঙালি বা আমার বাঙালিয়ানা নিয়ে কখনও কোনো রকমের আদিখ্যেতা করেছি, এই রকম আমার মনে পরে না।
আমি বর্তমানে এ রকমের একটা পশ্চিমা দেশে থাকি যেটা কোন এক সময় বৃটিশ কলোনি ছিলো। এখানে মেইন স্ট্রিম, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, সব কিছুই সাংঘাতিক ভাবেই ইউরোসেন্ট্রিক। বিশেষ করে, আমি যেহেতু সরকারি একটা অফিসে জব করি, সেখানে ইউরোপিয়ান বেশি।
এখানে আগমনের পর আমি খুব ছোট একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি তাদের পোশাকটাও পরি, আবার খুব নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত দুইদিন পাঞ্জাবী বা কামিজ পরে অফিসে যাই । তবে এই কাজটি আমি এলোমেলো করি, বিষয়টি কিন্তু এ রকম না। এটা হলো, পোশাক/ কালচার কেন্দ্রিক আমার সচেতন পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড পয়েন্ট। ভিন্ন পোশাকে আমি খুব সরল ভাবেই বলতে চাই, ‘দেখো, আমি ইউরোপিয়ান না। এবং কালচারালী ইউরোপিয়ান হওয়ার কোন খায়েশ আমার নেই। তবে অনেক কষ্টে তোমার ভাষাটা আমি শিখতে পারছি, এর বেশি আমি পারব না।’
প্রতিটি কালচারের প্রতি রেসপেক্টটা মিচুয়াল রেসপেক্ট হওয়া উচিত। তোমার কালচারের প্রতি যেমন আমার অশ্রদ্ধা নেই, তেমনি তোমার কালচার আমার চেয়ে সুপিরিয়র, আমি এটাও মনে করি না। কাজেই, আমি আসলে তোমার মতো হওয়ার তাগিদও অনুভব করি না। আমি আমার মতো আমার বাঙালি বাঙালিয়ানা কালচার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য এবং সুখি।
তাই, দেশীয় পোশাক পরে ইউরোপিয়ান পরিবেশে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুরতে আমার খুব একটা সমস্যা হয় না। কাজেই, পশ্চিমের একটা দেশে থাকি বলেই আমি ইউরোপিয়ানদের মতো না, এবং এই রকমের হওয়ার চেষ্টাও আসলে আমি কখনো করি না।
এবার একটু অন্যরকম আলোচনা করি, চলেন। দেখবেন, দেশে থাকতে যেসব বাঙালি, বাঙালিয়ানা এই সমস্ত বলে সবচেয়ে আদিখ্যেতা করে, পশ্চিমা দেশে গিয়ে তারাই আবার সবার আগে বাঙালিয়ানা কালচার ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বিষয়টি এ রকম যে এরা প্লেনের টিকেট কেনার আগেই একটা হাফপ্যান্ট কিনে লাগ্যাজে ভরে রাখে। এবং এখন, আপনি খেয়াল করে দেখেন যে এমন একটা চিন্তার শর্ত আমরা তৈরি করে ফেলছি যেখানে ইউরোপিয়ান পোশাক পরলেই কিন্তু আমাদের কাছে সেটা স্মার্ট মনে হয়! বারংবার বলছি, যেকোনো দেশি পোশাকের মেয়ের চেয়ে প্যান্টশার্ট পরা এবং দুইটা ইংলিশ শব্দ বলতে পারা মেয়েটাকেই আমাদের চোখে স্মার্ট দেখায়, এটা অস্বীকার করতে পারবেন? এখানে, মেয়ে বললাম কারণ সকল দেশের সকল পুরুষ লোকেরা এখন প্যান্টশার্টই পরে অভ্যস্ত। ভাবটা এমন যে দেশীয় কালচার রক্ষার দায়িত্ব যেন তাদের নেই। ওটা মনে হয় যেন একচেটিয়া আমাদের, মেয়েদেরই ব্যাপার!
বলতে চাইলাম, এই যে আমরা ইউরোপিয়ানদের মতো হতে চাই, চলতে চাই, কিন্তু এটা কেন চাই? কারণ হিসেবে আমার কাছে মনে হয়, অতীত হয়ে যাওয়া দুইশত বছরের কলোনিয়াল হ্যাংওভার হচ্ছে ইউরোপিয়ান কালচার মানে বেটার কালচার। ইউরোপিয়ানরা আমাদের চেয়ে সুপিরিয়র, উচু জাত ইত্যাদি এসব আমরা অবচেতনে এখনো মনে করি, লালন করি। এবং এজন্য সুপিরিয়র ঐসব জাতিকে অনুসরণ করে তাদের মতো হতে চাই।
পশ্চিমা দেশগুলোর মাটিতে পা ফেলেই পাশ্চাত্য ছোট ছোট পোশাক পরার মধ্যে দিয়ে আপনি বিরাট প্রগতিশীল নারীবাদী হয়ে গেছেন, এটা আসলে প্রমাণ হয় না। কারণস্বরুপ এখানে এই পোশাকগুলো পরা কোনো বিশেষ বিষয় না, প্রকৃতপক্ষে এগুলো কোনো ঘটনাই না। আপনি ওদের মতো পোশাক পরেছেন মানে আপনি এখন অনেকখানি ওদের মতো। ব্যস, এতটুকুই প্রমাণ হয়, এর চেয়ে বেশি কিছু না।
লেখক: দিলশানা পারুল