রাজনীতিতে, প্রতারিত হওয়া কোনো অজুহাত নয়
— লেসজেক কোলাকোওস্কি
১
আগ বাড়িয়ে অনুগত হবেন না।
কর্তৃত্ববাদের অধিকাংশ ক্ষমতাই তাদেরকে স্বাধীনভাবে প্রদান করা। এই ধরণের মুহুর্তগুলোতে, একটা নিপীড়িক সরকার কী চাইবে তা লোকেরা আগে থেকেই ভেবে নেয়, এবং এরপর না চাইতেই নিজেদেরকে সঁপে দেয়। একজন নাগরিক, যিনি নিজেকে এভাবে খাপ খাইয়ে নেন, তিনি আসলে কী করা সম্ভব সেটা শেখাচ্ছেন ক্ষমতাকে।
২
প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিফেন্ড করুন।
প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে তা, যা আমাদেরকে শোভনতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন আছে তাদের। “আমাদের প্রতিষ্ঠান” বলবেন না, যতোক্ষণ না আপনি তাদেরকে ডিফেন্ড করে তাদের নিজের করে না নিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা নিজেদেরকে রক্ষা করে না। শুরু থেকেই তাদেরকে ডিফেন্ড না করলে একটার পর একটা প্রতিষ্ঠানের পতন ঘটে। তাই আপনি কেয়ার করেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান বেছে নিন — একটা আদালত, একটা সংবাদপত্র, একটা আইন, একটা শ্রমিক ইউনিয়ন — এবং এর পক্ষে দাঁড়ান।
৩
একদলীয় রাষ্ট্রের ব্যাপারে সাবধান।
যে পার্টিগুলো রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করেছে এবং প্রতিপক্ষকে দমন করেছে তারা শুরু থেকেই সর্বশক্তিমান ছিলো না। তারা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সুযোগ নিয়েছে নিজেদের প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক জীবনকে অসম্ভব করে তোলার জন্য। তাই বহুদলীয় ব্যবস্থাকে সমর্থন করুন এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচনের নিয়মকানুনকে ডিফেন্ড করুন। স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিন যতোদিন সেই অধিকার আপনার হাতে থাকে। ভোটে দাঁড়ানোর অপশনটাও বিবেচনা করুন।
৪
সারা দুনিয়ার জন্য দায়িত্ব নিন।
আজকে যা প্রতীক, তা-ই আগামি দিনের বাস্তবতা। স্বস্তিকা ও ঘৃণার অন্যান্য চিহ্ন লক্ষ্য করুন। এড়িয়ে যাবেন না, অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন না। নিজের হাতে সেগুলো সরিয়ে দিন এবং অন্যরাও যাতে একই কাজ করে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।
৫
পেশাগত নৈতিকতা মনে রাখুন।
রাজনীতিবিদরা যখন একটা নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, ন্যায্য চর্চার প্রতি পেশাগতভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকা আরো বেশি জরুরী হয়ে পড়ে। আইনজীবী ছাড়া আইনের শাসনের বারোটা বাজানো কঠিন, অথবা বিচারক ছাড়া লোকদেখানো বিচারের আয়োজন করা। কর্তৃত্ববাদীদের প্রয়োজন হয় বশ মানা সিভিল সার্ভেন্টদের, আর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের পরিচালকরা খুঁজতে থাকে শস্তা শ্রমে আগ্রহ থাকা ব্যবসায়ীদের।
৬
আধাসামরিক বাহিনীদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হোন।
যখন নিজেদেরকে সবসময় ব্যবস্থার বিরোধী দাবি করা বন্দুকবাজ লোকদেরকে গায়ে উর্দি চাপাতে এবং মশাল ও কোনো নেতার ছবি নিয়ে মিছিল করতে দেখবেন, বুঝবেন কেয়ামতের বেশিদিন বাকি নেই। যখন নেতাপন্থী আধাসামরিক বাহিনী আর আনুষ্ঠানিক পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে দেখবেন, বুঝবেন কেয়ামত এসে গেছে।
৭
হাতে যদি অস্ত্র তুলে নিতে হয়, চিন্তাশীল হোন।
আপনি যদি জনসেবার স্বার্থে অস্ত্র বহন করেন, খোদা আপনার মঙ্গল করুক ও আপনাকে রক্ষা করুক। কিন্তু এটা জেনে রাখবেন যে অতীতের অন্যায়গুলোর সাথে পুলিশ ও সৈন্যদের নিজেদেরকে একদিন অনিয়মিত কাজকর্ম করতে আবিষ্কার করতে দেখার সম্পর্ক ছিলো। না বলার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
৮
রুখে দাঁড়ান।
কাউকে না কাউকে তো এটা করতেই হবে। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া সহজ। ভিন্ন কিছু বলতে বা করতে গেলে অদ্ভূত লাগতে পারে। কিন্তু অই অস্বস্তিবোধটুকু ছাড়া কোনো স্বাধীনতা নাই। রোজা পার্কসের কথা স্মরণ করুন। যেই মুহূর্তে আপনি একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, স্ট্যাটাস কো-র ঘোর কেটে যাবে, এবং অন্যরাও রুখে দাঁড়াতে শুরু করবে।
৯
আমাদের ভাষার প্রতি সদয় হোন।
সবাই যেসব ফ্রেজ ব্যবহার করে সেগুলো তোতার মতো আউড়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। কথা বলার নিজস্ব একটা ভঙ্গি দাঁড় করান, এমনকি সেটা যদি সবাই যা বলছে তা প্রকাশ করার জন্যেও হয়। নিজেকে ইন্টারনেট থেকে আলাদা করার একটা প্রয়াস নিন। বই পড়ুন।
১০
সত্যে বিশ্বাস করুন।
ফ্যাক্ট বিসর্জন দেয়ার অর্থ স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়া। যদি কিছুই সত্য না হয়, তাহলে কেউই ক্ষমতার সমালোচনা করতে পারে না, কারণ সেটা করার কোনো ভিত্তিই আর থাকে না। যদি কিছুই সত্য না হয়, তাহলে সবই দৃশ্য। সবচে মোটা মানিব্যাগটা সবচে বেশি চোখ ধাঁধানো আলোর মূল্য পরিশোধ করে।
১১
অনুসন্ধান করুন।
কী ঘটেছে সেটা নিজেই খুঁজে বের করুন। দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠে বেশি সময় দিন। প্রিন্ট মিডিয়া সাবস্ক্রাইব করার মাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ভর্তুকি দিন। এটা বুঝতে শিখুন যে ইন্টারনেটে যা কিছু আছে তার একটা অংশ আপনার ক্ষতি করার জন্য আছে। প্রচারণা ক্যাম্পেইন (যার একাংশ দেশের বাইরে থেকে আসে) খতিয়ে দেখে এমন সাইটগুলো সম্পর্কে জানুন। অন্যদের সাথে যা শেয়ার করছেন তার ব্যাপারে দায়িত্ব নিন।
১২
দৃষ্টি বিনিময় করুন এবং সামান্য বাতচিত করুন।
এটা শুধু ভদ্রতার বিষয় না। এটা একজন নাগরিক ও সমাজের একজন দায়িত্বশীল সদস্য হওয়ার অংশ। এটা নিজের পরিপার্শ্বের সংস্পর্শে থাকার, সামাজিক বাধাগুলো ভেঙে ফেলার, এবং কাকে বিশ্বাস করতে হবে ও কাকে বিশ্বাস করা যাবে না সেটা অনুধাবন করার একটা পদ্ধতিও বটে। আমরা যদি প্রত্যাখ্যানের একটা সংস্কৃতিতে প্রবেশ করি, আপনি আপনার দৈনন্দিন জীবনের মনস্তাত্ত্বিক ভূচিত্রটা জানতে চাইবেন।
১৩
দৈহিক রাজনীতির চর্চা করুন।
ক্ষমতা চায় আপনার শরীর আপনার চেয়ারে বসে নরম হোক এবং আপনার সব আবেগ স্ক্রিণেই উবে যাক। ঘরের বাইরে বের হোন। আপনার শরীরটাকে অপরিচিত জায়গায় অপরিচিত লোকজনের কাছে নিয়ে যান। নতুন বন্ধু বানান এবং তাদের সাথে পা মেলান।
১৪
একটা ব্যক্তিগত জীবন গড়ে তুলুন।
নোংরাতর শাসকরা আপনার ব্যাপার তারা যা জানে তাই ব্যবহার করবে আপনাকে কোনঠাসা করার জন্য। আপনার কম্পিউটার থেকে নিয়মিত ভিত্তিতে ম্যালওয়ার সরান। মনে রাখবেন ইমেইল হচ্ছে আকাশলিখন। ইন্টারনেটের বিকল্প ধরণ ব্যবহার করার কথা বিবেচনা করুন, অথবা স্রেফ এটা কম ব্যবহার করুন। ব্যক্তিগত বিনিময়গুলো হাতে হাতে করুন। একই কারণে, আইনী যে-কোনো ধরণের ঝামেলা থাকলে তা নিরসন করুন। স্বৈরতন্ত্রীরা দড়ি খোঁজে আপনাকে ঝুলিয়ে দেয়ার জন্য। চেষ্টা করুন যাতে এমন কোনো দড়ি না থাকে আপনার।
১৫
ভালো উদ্দেশ্যের পেছনে পয়সা ঢালুন।
রাজনৈতিক হোক বা না হোক, জীবন সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, এমন সংগঠনে সক্রিয় হোন। একটা বা দুইটা চ্যারিটি বেছে নিন এবং অটোপে চালু করুন। তাহলে আপনি নিজেকে একটি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ারত অবস্থায় আবিষ্কার করবেন যা কিনা নাগরিক সমাজকে সাহায্য করে এবং অন্যদেরকে ভালো কাজে সহায়তা করে।
১৬
ভিনদেশী বন্ধুদের কাছ থেকে শিখুন।
বন্ধুত্বগুলোকে দেশের সীমানার বাইরেও টিকিয়ে রাখুন, অথবা বিদেশে নতুন বন্ধু বানান। বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (আমাদের প্রেক্ষিতেঃ বাংলাদেশে – অনুবাদকের নোট) যেসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা বৃহত্তর একটা প্রবণতার উপাদান। আর দুনিয়ার কোনো দেশই নিজে নিজে কোনো সমস্যার সমাধান বের করতে পারবে না। নিশ্চিত করুন আপনার ও আপনার পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্ট করা আছে কিনা।
১৭
ভয়ংকর শব্দগুলোর জন্য কান পেতে রাখুন।
উগ্রপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদ জাতীয় শব্দ ব্যবহারে সতর্ক হোন। জরুরী অবস্থা আর ব্যতিক্রমী অবস্থা জাতীয় মারাত্মক শব্দের ব্যাপারে সজাগ থাকুন। দেশপ্রেমের অভিধানের বেঈমানীমূলক ব্যবহার দেখলে ক্ষিপ্ত হোন।
১৮
যখন অচিন্তনীয়র আগমন ঘটে, শান্ত থাকুন।
আধুনিক স্বৈরতন্ত্র হচ্ছে সন্ত্রাস ব্যবস্থাপনা। যখন সন্ত্রাসবাদী হামলা ঘটে, মনে রাখুন স্বৈরতন্ত্রীরা এই ধরণের ঘটনাকে ক্ষমতা সংহত করার কাজে ব্যবহার করে। আকস্মিক বিপর্যয় যার জন্য ক্ষমতার ভারসাম্যে ইতি টেনে দিতে হয়, বিরোধী দলগুলোকে বিলুপ্ত করে দিতে হয়, চিন্তা প্রকাশের ও সুষ্ঠূ বিচারের অধিকার কেড়ে নিতে হয় এবং ইত্যাদি ইত্যাদি… এগুলো হচ্ছে হিটলারি কেতাবের পুরনোতম কৌশল। এসবে মজবেন না।
১৯
দেশপ্রেমিক হোন।
আসন্ন প্রজন্মগুলোর জন্য আমেরিকার (আমাদের প্রেক্ষিতেঃ বাংলাদেশের) অর্থটা কী হবে তাঁর একটা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। তাদের এটার প্রয়োজন হবে।
২০
যতোটা সাহসী হওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব, ততোটাই হোন।
আমাদের কেউই যদি স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে আমাদের সকলেই স্বৈরতন্ত্রের অধীনেই মারা যাবে।
লেখক সম্পর্কে
টিমোথি স্নাইডার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসশাস্ত্রের লেভিন অধ্যাপক। তিনি ব্লাডল্যান্ডসঃ ইওরোপ বিটউইন হিটলার অ্যান্ড স্ট্যালিন এবং ব্ল্যাক আর্থঃ দ্য হলোকাস্ট অ্যাজ হিস্টোরি অ্যান্ড ওয়ার্নিং গ্রন্থের রচয়িতা। স্নাইডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের দ্য কমিটি অন কনসায়েন্সের একজন সদস্য এবং ভিয়েনার দি ইন্সটিটিউট অফ হিউম্যান সায়েন্সেসের একজন স্থায়ী ফেলো।
এখানে স্নাইডারেরঅন টাইরানিঃ টুয়েন্টি লেসনস ফ্রম টুয়েনটিথ সেঞ্চুরি (২০১৭) বইটির বিশটি অধ্যায়ের সারসংক্ষেপটুকু তর্জমা করা হয়েছে, মূল বইটি পাওয়া যাবে এই লিংকেঃ http://gen.lib.rus.ec/book/index.php?md5=C4832134090A0EE899ABCE7CC168B302
লেখক ও অনুবাদকঃ ইরফানুর রহমান রাফিন মুক্তিফোরামের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য