আশাহীন এই পৃথিবীতে মানুষের দাপট দেখা যায় ফেসবুকে।

ফেসবুক এখন বিচারালয়, ফেসবুক এখন খেলার মাঠ, ফেসবুকই এখন প্রার্থনালয়।

ক্রিটিক্যাল স্টাডিজের চশমা চোখে একদিন ফেসবুকের মহাসমুদ্রে দেখি অভিনব এক মানুষ। বিক্ষুদ্ধ, মৌলিক এবং স্পষ্টভাষী। একা তরী বেয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে এক মাঝি- নাম তার সিফাত উল্লাহ। ফেসবুকের ভরা মজলিশে তিনি সেফুদা! সেই সেফুদা ফেইসবুক লাইভে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সম্প্রতি ফেঁসে গেছেন।

সেফুদাকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন বাংলাদেশের মহামান্য আদালত। পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আস সামস জগলুল হোসেন পরোয়ানা জারির এ আদেশ দেন সম্প্রতি। সংবাদে প্রকাশ, তাকে গ্রেপ্তার করা গেল কি না তা আগামী ১৯ নভেম্বর পুলিশকে জানাতে বলেছে আদালত।

মামলায় বলা হয়, গত ৯ এপ্রিল বাদী ফেইসবুকে দেখতে পান যে, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা প্রবাসী সেফাতউল্লাহ ওরফে সেফুদা তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে এসে ‘কোরআন সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের আজেবাজে কথা’ বলছেন এবং কোরআন ‘অবমাননা’ করছেন।

প্রশ্ন উঠে, বর্তমানে রাজনীতি, ব্যক্তি, সমাজ তথা পুরো বাংলাদেশের মানসিক বিপন্নতার সময় সিফাত উল্লাহকি সত্যিই একা দোষী? আমার তো মনে হয়, ‘মানসিক ভাবে বিপন্ন সিফাত উল্লাহ’র কাছে গোটা যেন সমাজটাই অপরাধী। তাই তাঁর লক্ষ্য সমাজ। তিনি সমাজকে তুলোধুনা করতে উস্তাদ। জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠের বরাতে জানা যায়- ‘অল্প সময়ে ফেসবুক তারকা বনে যাওয়া এ সেফুদা মূলত মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তার এমন কর্মকাণ্ডে পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজন খুবই লজ্জিত বলেন তার স্ত্রী। জানা যায় তার পুরো নাম সেফাতউল্লাহ মজুমদার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করেছেন l (সূত্র:কে এই সিফাত উল্লাহ ওরফে সেফুদা?, ১৫ আগস্ট, ২০১৮ কালের কণ্ঠ)’।

সোশ্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রতিক বছরজুড়ে নানা ধরণের অসঙ্গতিপূর্ণ ভিডিওবার্তা ছড়িয়ে বেশ আলোচনায় সিফাত উল্লাহ ওরফে সেফুদা নামে এই প্রবাসী বাংলাদেশি। নানা বিষয় নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে অল্প সময়ে ‘তারকা’ বনে যান সেফুদা। তাঁর অনলাইন এক্টিভিটি অনুসরণ করে বোঝা যায় যে, আসলে তাঁর আপনজন নেই। এমনকি তাঁর জলদগম্ভীর ভাষ্যমতে ‘সব গার্লফ্রেন্ড’ই ‘সাবেক’। তার সব নায়িকারা ‘পাস্ট পারফেক্ট টেন্স’। তাই ফেসবুক’র ভরা মজশিল আর ইউটিউব’র বাজারেই তিনি স্বছন্দ।

ফেসবুক আর ইউটিউব থেকে ‘লাইভ’ওষুধ খেয়ে তিনি নিজেকে ভাবেন ‘সুস্থ’। বাংলাদেশের কড়া আইনের থেকে দূরে থেকে প্রবাসতীর্থের স্বাধীনতায় তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ্য।

এর আগে পাঠকবৃন্দ হয়তো স্মরণ করতে পারবেন, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বিবিরহাট থেকে দুই ব্যক্তির টেলিফোন আলাপ। ১:৫৬মিনিটের কল রেকর্ডিং এর অডিও ক্লিপ “ক্যানে চলর অ ভাই” ছিলো সেইসময় ভাইরাল হওয়া একটা ডায়লগ।

সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমরা একে দেখতে পারি। গণসমাজের অধিবাসীদের কতগুলি যৌথ আচরণের প্রবণতার কথা বলা হয়েছে সমাজবিজ্ঞানে। যে আচরণকে বলা হয় গণআচরণ। গণআচরণের অনেকগুলো ধাপ আছে। যেমন: গুজব, হুজুগ, উন্মাদনা আর গণবিকার। গনবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যার ইংরেজি মাস হিস্টিরিয়া। ‘কেনে চলর’ সংলাপে একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে অপেক্ষাকৃত তরুণের মুখরোচক আলাপ ক্রমেই ঝগড়ায় রূপ নেয়।

যদিও ঝগড়া নয়, এটা মূলত তরুণের দিক থেকে উসকানি। যে উসকানিতে রাগ আছে, কৌতুহল আছে, ক্রোধ আছে, আছে বিবিরহাটে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা, আছে দেশে কিছু না থাকার বেদনা,আছে স্থানীয় দাপট, সবশেষে আছে গালাগাল। সব মিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য এই ‘কেনে চলর’ সংলাপ। সমাজে যখন স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধি-কর্তব্যবোধের বিনাশ ঘটে তখন ‘হালকা চটুল’ এরকম সংলাপগুলো মুখে মুখে বয়ে বেড়ায়। অকাজের ভিড়ে ওই সংলাপ আউড়ানো হয়ে পড়ে মূল কাজ। মানুষ ইয়ার্কির ছলে মজা নেয়। নিষ্প্রাণ-গুম-হত্যা-আতঙ্কের সমাজে এযেন একচিলতে অবকাশ।

হোক না ইয়ার্কি, দোষ কী? এই গণবিকার হলো একধরণের ভাবাবেগযুক্ত আচরণ যার মধ্যে বুদ্ধি বা যুক্তির সম্পর্ক নেই। এই আচরণ একসঙ্গে বহু লোকের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। ভাবাবেগে গা ভাসিয়ে দিয়ে মানুষ এই গণবিকারগ্রস্ততায় ভুগে। প্রবল উত্তেজনায় এই আচরণ করে আধুনিক ভোক্তা সমাজ। এটা গণআচরণেরই অংশ। এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তার কিছু নেই।

সমাজ যে গতিশীল, সমাজ যে সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে আছে, এটা তারই লক্ষণ! চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় টেলিফোন সংলাপ ‘কেনে চলর’ আধুনিক গণসমাজের গণআচরণের একটি মোক্ষম উদাহারণ। মানুষ মজা নেয়ার জন্য এই সংলাপ শুনেছে, শেয়ার করেছে, সাপ্লাই করেছে একে অপরের কাছে। হকার্স মার্কেট থেকে চলন্ত বাস, মির্জাপুর থেকে খুলশী আবাসিক, গার্মেন্ট শ্রমিক থেকে কোটিপতি সবার মুখে মুখে ছিলো ‘কেনে চলর’ সংলাপ।

এই ‘কেনে চলর’ সংলাপটির বহুল ব্যবহার ও প্রসার ছিলো একধরণের গণবিকার। যা সমাজে বেশিদিন স্থায়ী হয় না। নতুন আরো একটা বাজারে আসলে পুরাতনটা তার জায়গা ছেড়ে দেয়। যথারীতি ‘কেনে চলর’ হারিয়ে গিয়ে সেফুদাতে বিলিন হয়েছে। যেভাবে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল ‘থানিয়া কুতায়’ বা ‘সাইফুল বোতল ফেট্টরি’। যার সবকিছুর বাজার এই ফেসবুকের ভরা মজলিশ।

মনের গহীনের কিছু কথা, কিছু ভাব, কিছু আবেগ গোপন রাখার যে আকুতি তা মুহূর্তেই বিশ্বময় ছড়িয়ে আন্তর্জাতিকতায় রূপ নিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুক সেই বার্তাবাহকের কাজ করছে। আবেগের বন্যায় সেখানে বাঁধভাঙ্গা প্লাবন। লাইক-কমেন্ট-শেয়ার-এর এক মহা উৎসব। সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে এই ফেসবুক আমাদের প্রযুক্তি দুনিয়ার অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী একটি যোগাযোগ মাধ্যম।

সমাজ গবেষণা’র (Social Studies) অংশ হিসেবে তাই বাংলাদেশের সমাজকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এই সোশ্যাল মিডিয়া দাপট অনুভব করছি। মানুষের জীবন যাপন, যোগাযোগ, আবেগ-অনুভূতি বাটোয়ারার এত বড় সামাজিক যোগাযোগ সাইট এর আগে কখনো এতটা প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে হাজির হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে ফেসবুক এই ইন্টারনেটভিত্তিক সাইবার কমিউনিটি গড়ে তোলার সমাজের জনপ্রিয় টুলস। গোটা ভার্চুয়াল বিশ্বের সাথে সাদৃশ্যময় কৃত্রিম জগতটি এখানে স্পষ্ট ধরা পড়লেও

ফেসবুকের বন্ধন অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। বাংলাদেশে ব্লগ, ইমেইলের পর সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম পথিকৃৎ ‘ফেসবুক’।

ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সামাজিক চ্যানেলগুলোর মধ্যে ফেসবুকই বড়। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যতম বড় একটি ফর্ম হলো ফেসবুক। ফেসবুক এমন এক মঞ্চ, যা মানুষকে আত্মগুরুত্বের স্বাদ দিচ্ছে। প্রযুক্তি বিশ্বের যা অভূতপূর্ব। নিমেষের মধ্যে হাজারো ভার্চুয়াল বন্ধু পেয়ে সবাই ভাবছি জনপ্রিয় হলাম। নিজের কর্মকাণ্ডকে সর্বগোচরে আনবার উত্তেজনা ফেসবুক আমাদের প্রান্ত থেকে বিশ্বে নিয়ে যায়। সংযোগই মানুষে মানুষে সম্পর্ক নির্মাণ করে। সংযোগের ভেতর থেকেই নির্মিত হয় সম্পর্ক। সম্পর্ক অটুট থাকে শেকড়ে।

ষাটের দশকে যে গ্লোবাল ভিলেজের প্রবক্তা মার্শাল ম্যাকলুহান যে গ্লোবাল ভিলেজে বলে গেছেন, মিডিয়ার প্রাযুক্তিক বিষ্ফোরণ এবং পুঁজির সঞ্চরণশীলতার কল্যানে তা এখন সর্বপ্রতিষ্ঠিত। ইন্টারনেট পুরো দুনিয়াটাকে আক্ষরিক অর্থেই একটি গ্রামে পরিণত করেছে।সেই গ্রামে ‘যার কেউ নাই, তার ফেসবুক আছে। তবে, যার কেবল ফেসবুকই আছে, তার আসলে কেউ নেই’।

জীবনের সমান্তলার আরেকটি ভার্চুয়াল জীবন ফেসবুক। অদাহ্য অকাট্য ফেসবুকই আজ বিশ্বময় নতুন প্রজন্মের শেকড় হয়ে উঠছে। কারণ, গরুর হাটে কেবল গরুই থাকে না। থাকে ছাগল, থাকে মহিষ, থাকে উট-দুম্বাও! আশাহীন এই পৃথিবীতে মানুষের দাপট ফেসবুকে। ক্রিটিক্যাল স্টাডিজের চশমায় তাই একদিন ফেসবুকের মহাসমুদ্রে দেখি একা তরী বেয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে এক মাঝি সিফাত উল্লাহ।

ফেসবুকের ভরা মজলিশে তিনি আজ ‘অপরাধী সেফুদা’! সেফুদা নিজেই নিজের দণ্ড ঘোষাণা করেন প্রতিটি ভিডিও বক্তব্যে। তাঁকে নতুন করে দণ্ড দিবো কিভাবে? যে সিফাত উল্লাহ নিজেকেই প্রাণদণ্ড দিতে উদ্যত, তাকে বঙ্কিমী শুদ্ধতায় কারাদণ্ডের আদেশ শুনিয়ে কী লাভ? বিচিত্র এই ধরণীতে ‘ভাবের প্রকাশ’ ঘটাতে গিয়ে সিফাত উল্লাহ সেফুদার ভাবের প্রকাশ হয়তো আত্মঘাতী কিন্তু স্বচ্ছন্দ্য।

সামাজিক যোগাযোগ সাইটে গত একটি বছর সিফাত ঝড়ের সবচেয়ে ভালো দিক, আমাদের সকলের নিজেদের মধ্যকার সিফাত উল্লাহকে আরো একবার দেখার সুযোগ। ফেসবুক ও ইউটিউবের মত প্রকাশ্য পরিসরে ‘সেন্সরড খিস্তি’ শোনার অবদমিত আনন্দ প্রমাণ করে যে, এই সমাজ সিফাত উল্লাহকে খায়। যার কেউ নাই তার আছে ফেসবুক, কিন্তু যার কেবল ফেসবুকই আছে, তার আসলে কেউ নেই। তাদের অন্তিম পরিণতির নাম- সিফাত উল্লাহ।

লেখক: রাজীব নন্দী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক rajibndy@gmail.com

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply