জীবনে খুব কম কনসার্টেই আমি অংশ নিতে পেরেছি। এটা আমার একটা বড় দুর্ভাগ্য।
তবে যেকয়টি কনসার্টে আমি গিয়েছি, তার মাঝে সবচেয়ে চমৎকার অভিজ্ঞতাগুলোর একটি ছিল জেমস এর কনসার্টে অংশ নিতে পারা।
পরপর অনেকগুলো ব্যান্ড উঠে গাইলো, আমরা মাথা নাড়লাম, একটা দুইটা গাইলামও। কিন্তু এরপর একটি ছোট্ট বিরতি নেয়া হল। স্টেজের সবগুলো মনিটর এনে গোল করে রাখা হল ভোকাল মাইকের চারদিকে। এরপর কবি এলেন, আর চট্টগ্রামের আজীজ স্টেডিয়ামে আগুন ধরে গেলো। আমার রক্তের প্রতিটি দানা কেঁপে উঠলো।
এই কি সেই অনুভূতি যার জন্যে মানুষ শিল্প করে, গান গায়, ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, রাজনীতি করে?
পুরো স্টেডিয়াম কাঁঁপতে থাকল এক অবিচ্ছেদ্য ধ্বনিতে, “গুরু, গুরু, গুরু।” নেতা যেমন নিজেকে দাবি করতে হয়না কারো, জেমসকেও কখনো দাবি করতে হয়নি যে তিনি বাংলাদেশের রক সঙ্গীতের গুরু। তবে জনতা তাকে এই নাম দিয়েছে পরম ভালোবাসায়। একেই বলে সত্যিকারের ক্ষমতা। এই ক্ষমতার জন্যে কাউকে জোর করতে হয় না, কারুকে অত্যাচার করতে হয়না, রগ ফুলিয়ে স্লোগান দিতে হয়না, মিথ্যে ইতিহাস আর কল্পিত পরিসংখ্যান আওড়ানো লাগে না। কেবল জনতার মঞ্চে দাঁড়ানো লাগে। আর জনতাই নিজে থেকে কেঁপে ওঠে, “গুরু, গুরু, গুরু।”
আপনারা হয়তো ভাবছেন মুক্তিফোরামের সম্পাদকীয়তে একজন সংগীতশিল্পীকে নিয়ে কথা বলছি কেন। বলছি কারণ মুক্তি মানে শুধু রাজনৈতিক মুক্তি নয়। মুক্তি মানে সামাজিক মুক্তি, মূল্যবোধের মুক্তি, সাংস্কৃতিক মুক্তি। সেগুলোর অনেক দিক দিয়ে জেমস এবং তার সমসাময়িকেরা ছিলেন মুক্তির মশাল।
যে সময়ে তারা রক সঙ্গীত গাওয়া শুরু করেছিলেন, তখন তাদেরকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল অপসংস্কৃতি হিসেবে। তারা মদ, গাঁজা, ড্রাগসে মেতে থাকেন এমনটা বলা হতো। অনেকে বলতেন তারা দেশীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এবং এই কথাগুলো অনেক নাকউঁঁচু মানুষজন এখনও বলেন।
তবু জেমস থামেননাই। জেমসরা থামেন নাই। তারা সমাজকে পরিবর্তন করেছেন, সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তারা প্রমাণ করেছেন যে সংস্কৃতি আলমারিতে তুলে রাখার জিনিস নয়। সংস্কৃতির ধর্মই হল পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং আধুনিকায়ন। যারা বলতেন রক সঙ্গীতে মাধুর্য নেই, তারা কি মা গানটির দরদ শুনেছেন। যারা বলতেন রক বৈদেশিক আগ্রাসন, তারা কি শুনেছেন আমার সোনার বাংলা?
জেমসের সংগীত এবং তার জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে যে বাঙ্গালি ও বাংলা সংস্কৃতি কালের আবর্তে হারিয়ে যাবেনা, বরং কালের স্রোতে ভেসে বারংবার নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পাবে। জেমসদের দেখানো পথে হেঁটে আজ বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে শত শত নতুন ব্যান্ড। প্রতিবছর রচিত হচ্ছে অসংখ্য নতুন গান। যদি আমরা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদীদের কথা শুনে জেমসদের চুপ করিয়ে দিতাম, তবে কি আমরা কোনদিনও সংস্কৃতির এই নতুন মাত্রাটি খুঁজে পেতাম?
তাই জেমসের গানে, জেমসদের গানে আমাদের জন্যে একটি বার্তা রয়েছে। বার্তাটি পরিবররতনের, বার্তাটি বিপ্লবের।
জেমস আমাদের শেখায় যে বিপ্লব করতে সবসময় অস্ত্র বা প্ল্যাকার্ড হাতে পথে নামতে হয় না, অনেক সময় আঙ্গুল রাখতে হয় গিটারে।
শুভ জন্মদিন, গুরু।
মুক্তিফোরামের পক্ষে এই সম্পাদকীয়টি রচনা করেছেন অনুপম দেবাশীষ রায়।