দুই প্রতিবেশী পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই তিক্ততায় ভরা। যুদ্ধ, সীমান্ত সংঘর্ষ, এবং কূটনৈতিক টানাপোড়েন—এসব যেন উপমহাদেশের রাজনীতিতে নিয়ত ঘটে চলা ঘটনা। তবে ২০২৫ সালের মে মাসে সংঘটিত সীমিত সময়ের সংঘাত, যেটি ভারতের দিক থেকে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পরিচিত, সেই পুরনো বৈরিতাকে এক নতুন রূপ দেয়। এই সংঘর্ষ ছিল দ্রুততার মিশেলে ক্ষিপ্র, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যনির্ভর এবং প্রযুক্তিনির্ভর। এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন।
সংঘাতের সারসংক্ষেপ
ঘটনার সূত্রপাত হয় জম্মু ও কাশ্মীরের পাহেলগামে একটি পর্যটকবাহী বাসে আত্মঘাতী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ভারত অভিযোগ করে, হামলার নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জইশ-ই-মোহাম্মদ। এই হামলার জবাবে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালায়, যা ছিল ২৫ মিনিটের মধ্যে ২৪টি নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা।
ভারতের দাবি অনুযায়ী, নয়টি জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস হয় এবং প্রায় ৭০ জন জঙ্গি নিহত হয়। পাকিস্তান প্রথমে হামলার বিষয়টি স্বীকার করতে কিছুটা গড়িমসি করে, তবে পরে জানায় যে ভারতের হামলায় কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম ও সরকার যেভাবে তা প্রচার করছে তা অতিরঞ্জিত।
ভারতের আক্রমণ: লক্ষ্যনির্ভর, প্রযুক্তিনির্ভর, এবং প্রতীকী শক্তি প্রদর্শন
ভারতীয় সামরিক বাহিনী এ অভিযানে ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র (ফায়ার & ফরগেট), ইজরায়েলি প্রযুক্তিনির্ভর ‘স্কাইস্ট্রাইকার ২’ ড্রোন এবং উপগ্রহ-নির্ভর লক্ষ্য চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। অপারেশনটি চালানো হয় গভীর রাতে, পাকিস্তানের ভূখণ্ডের ভেতরে ৫০–৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রবেশ করে।
এই অভিযান ভারতের জন্য কেবল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিক্রিয়া ছিল না; এটি ছিল সামরিক সক্ষমতা, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং রাজনৈতিক দৃঢ়তা প্রদর্শনের এক উপলক্ষও। অভিযানের ব্যাপারে ভারত পাকিস্তানকে আগেই অবহিত করেছিল বলে জানা গেছে—এটি অনেকের কাছেই কৌশলগত নানানপ্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তবুও ভারতের দিক থেকে এটি ছিল ‘নির্ভুল, দ্রুত এবং ন্যায্য’ এক জবাব।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া: আত্মরক্ষা না সীমিত জবাব?
পাকিস্তান প্রথম দিকে এই হামলার কথা স্বীকার করতে তেমন আগ্রহ না দেখালেও পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে স্বীকার করে। তারা জানায় যে কিছু জায়গায় ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে, কিন্তু তেমন কোনো বড় ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সীমিতভাবে পাল্টা প্রস্তুতি নিলেও সরাসরি পাল্টা হামলা চালায়নি। বিশ্লেষকদের মতে, এর দুটি কারণ থাকতে পারে:
১. দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা।
২. আন্তর্জাতিকভাবে এক নতুন যুদ্ধকে উত্তেজিত করতে না চাওয়ার কৌশল।
তবে পাকিস্তান কূটনৈতিক পরিসরে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই হামলাকে জাতিসংঘ, ওআইসি এবং চীনের কাছে তুলে ধরে। এর ফলে একটি কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়।
ভারতের অর্জন
এই সীমিত সংঘাত ভারতকে একাধিকভাবে লাভবান করে:
ক. সামরিক সক্ষমতার প্রকাশ: অত্যাধুনিক অস্ত্র, গোয়েন্দা প্রযুক্তি ও যুদ্ধ কৌশলে ভারত নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে।
খ. রাজনৈতিক পুঁজি: জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু তুলে ধরে সরকার জনগণের মাঝে শক্ত অবস্থান তৈরি করে, যা আসন্ন নির্বাচনে তাদের সুবিধা দিতে পারে।
গ. আন্তর্জাতিক অবস্থান: যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশ ভারতের পক্ষে সুর তোলে, যদিও সাবধানতা অবলম্বন করে।
ঘ. সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানে জনসমর্থন: অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ থাকলেও এই হামলা জনগণের মাঝে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
পাকিস্তানের অর্জন
পাকিস্তান যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি লাভবান না হলেও কিছু কৌশলগত ও কূটনৈতিক দিক থেকে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়:
ক. যুদ্ধ এড়ানো: কোনো বড় পাল্টা আক্রমণে না গিয়ে, পাকিস্তান সংঘাতকে সীমিত রাখে, যা অর্থনৈতিক ও মানবিক দিক থেকে তাদের জন্য লাভজনক।
খ. আন্তর্জাতিক সহানুভূতি: মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মাঝে পাকিস্তান ভারতকে “আগ্রাসী শক্তি” হিসেবে উপস্থাপন করে কিছুটা সহানুভূতি আদায় করতে সক্ষম হয়।
২০২৫ সালের ভারত-পাকিস্তান ‘সীমিত’ সংঘাত একটি পরিবর্তিত বাস্তবতা সামনে এনেছে। এটি প্রমাণ করেছে যে, যুদ্ধ আর কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ব্যাপক সৈন্য মোতায়েন বা বিমান হামলার মতো চিত্রে সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক যুদ্ধ হতে পারে ক্ষণস্থায়ী, প্রযুক্তিনির্ভর, এবং রাজনৈতিক বার্তায় পূর্ণ।
গ. চীনের অবস্থান: চীন ভারতের হামলাকে “উদ্বেগজনক” বলে অভিহিত করে, পাকিস্তানের প্রতি কৌশলগত সমর্থন অব্যাহত রাখে।
বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রকাশ্যে উভয় দেশকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানায়, তবে ভারতের ‘সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিক্রিয়া’কে একপ্রকার বৈধতা দেয়।
চীন, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে ভারতের এই আগ্রাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এই হামলার নিন্দা করে।
জাতিসংঘ সাধারণভাবে উভয় পক্ষকে সংযত থাকার বার্তা দেয়।
সার্বিকভাবে, ২০২৫ সালের ভারত-পাকিস্তান ‘সীমিত’ সংঘাত একটি পরিবর্তিত বাস্তবতা সামনে এনেছে। এটি প্রমাণ করেছে যে, যুদ্ধ আর কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ব্যাপক সৈন্য মোতায়েন বা বিমান হামলার মতো চিত্রে সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক যুদ্ধ হতে পারে ক্ষণস্থায়ী, প্রযুক্তিনির্ভর, এবং রাজনৈতিক বার্তায় পূর্ণ।
ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল একটি নির্ধারিত, দ্রুত ও প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ। পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল একটি কৌশলগত ধাক্কা, যার পরও তারা যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হয়েছে।
এই সংঘাত ভবিষ্যতের দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে—যেখানে সামরিক শক্তি, কূটনৈতিক কৌশল ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি একসঙ্গে সংযুক্ত হয়।
এখন দেখার বিষয়– এই ঘটনার পর দুই দেশ সংলাপ ও শান্তির পথে এগিয়ে যেতে চায় কিনা; নাকি শুরু হবে আরেকটি সংঘাতের প্রহর গোনা।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন