বিনা যুদ্ধে, একটা বুলেট খরচ না করে এমনকি বিনা চেষ্টাতেই ভারত দখল করে ফেলছে বাংলাদেশের শত শত একর ভূমি। ঢাকায় রাজপথে পলিটিক্যাল বাচালরা নিয়মিত হুংকার দেয় “এক ইঞ্চি জমি ভারতকে দেব না।“ বর্ষাকালে ছয় শব্দের লাইনটা উচ্চারণ করতে যত সময় লাগে, তত সময়ে এক ইঞ্চি নয় অন্তত এক একর জমি বাংলাদেশকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় ভারতের বুকে। নীরবে বদলে যাচ্ছে দেশের মানচিত্র। সবই ঘটছে চোখের সামনে, প্রকাশ্যে। কারো কোনো বিকার নেই।
সিলেটের জকিগঞ্জ। এখানে ভারত ও বাংলাদেশকে আলাদা করেছে খরস্রোতা কুশিয়ারা নদী। বর্ষায় এই নদী প্রচুর পরিমাণে ভাঙ্গে। দুঃখের ব্যাপার, ভাঙ্গে শুধু একপাশে, বাংলাদেশের দিকে। আমার নিজের গ্রাম নদীর পাড়ে। শৈশবে আমি যে গ্রাম দেখেছি, এখন সেটা আর নেই। বাড়িঘর, ফসলি জমি, কবরস্থান নাই হয়ে গেছে। ডাইকের রাস্তা ভেঙ্গে চলে যায়। সেই রাস্তা বসতবাড়ির ভেতর দিয়ে নতুন করে দিতে হয়। নতুন রাস্তাও বেশিদিন টিকে না। আবার পড়ে ভাঙ্গনের কবলে। এভাবে কতবার যে রাস্তা বদল হয়েছে স্থানীয়রাও বোধহয় গুনে বলতে পারবে না।
নদী ভাঙ্গন সারাদেশেই হয়। কিন্তু অন্য ভাঙ্গনের সঙ্গে এটার পার্থক্য হলো, এখানে দেশের মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। গুগল ম্যাপ খেয়াল করে দেখলে ভয়াবহতা বুঝতে পারবেন। বাংলাদেশের পাশে নদীর সাথে লাগোয়া বাড়িঘর। ভারতের দিকে নদীর পাশে বিস্তীর্ণ জমি। তার অনেক দূরে বসতভিটা। জকিগঞ্জ লাগোয়া ভারতের জেলা করিমগঞ্জ। আসামের ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র অঞ্চল। তারা কেন এত জমি খালি রেখে দিয়েছে বলেন তো?
কারণ এই জমির মালিক স্থানীয় কেউ নয়। এগুলো বাংলাদেশ থেকে পাওয়া দান। নদীর বুকে নিজের বসতভিটা, জমি, গাছপালা ও পূর্বপুরুষের স্মৃতি চলে যাওয়া অসহনীয় অভিজ্ঞতা। তারপর যদি কেউ দেখে তার জমিটুকু চলে গেছে অন্য দেশে, অন্য দেশের সিপাই বন্দুক হাতে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেই ভূমিতে তার দাঁড়ানোর অধিকার পর্যন্ত নেই…যে অসহ্য জ্বালা হয় তখন এর তুলনা নেই। এই জ্বালা ,অপমান কুশিয়ারা পাড়ের লোকজনের নিয়মিত অভিজ্ঞতা।
গত বছরের ১৪ অক্টোবর ইত্তেফাকের একটা রিপোর্টের শিরোনাম ছিল “বদলে যাচ্ছে জকিগঞ্জের মানচিত্র।“ সেখানে বলা হয়, কুশিয়ারা দ্বারা বিভক্ত ২২ কিমি সীমান্ত জুড়ে গড়ে ১-২ কিলোমিটার করে ভূমি ভারতে ইতোমধ্যে চলে গেছে। কী বিশাল জায়গা ভাবেন! একই রিপোর্টে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে বলা হয়, ১০ টি স্থানে আরো ৪.৬০ কিমি জমি ভারতে চলে যাবে যখন তখন।
এই যুগে এক ইঞ্চি জমির জন্য যেখানে সত্যি সত্যিই যুদ্ধ হয়, ইউক্রেনের এক কিলো জমি দখল করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে গড়ে ১৭ রাশিয়ান সেনা সেখানে আমাদের দেশের একটা অঞ্চল একদম মাগনা ও মুফতে তুলে দেয়া হচ্ছে ভারতের হাতে। হ্যাঁ, এটাকে তুলে দেয়াই বলব। কারণ চাইলেই সমস্যাটার সমাধান করা যেত।
কুশিয়ারা খরস্রোতা হলেও তেমন প্রশস্ত নদী নয়। একটু টেকসই বাঁধ করলেই ভাঙ্গনটা ঠেকানো সম্ভব ছিল। ভুঁইয়ার মোড়া নামে একটা পয়েন্ট আছে যেখানে এক সময় সবচেয়ে বেশি নদী ভাঙ্গন হয়েছে। সোজা নদী ‘ইউ’ শেইপে এসে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের দিকে। সেখানে ঠিকঠাক বাঁধ দেবার পর আর এক ইঞ্চি জমিও ভাঙ্গে না। তাহলে বাকি জায়গাগুলোতে কেন হচ্ছে না বাঁধের কাজ?
সীমান্তের মানুষকে নিয়ে ইদানীং কিছুটা রোমান্টিসিজম তৈরি হয়েছে শহুরে এলিটদের মধ্যে। এরা দা নিয়ে বিজিবির পাশে দাঁড়ায়, লাঠি দিয়ে বিএসএফকে তাড়া করে, আঙুল কেটে নেয়…বাহ বাহ কী সাহস! এগুলো রোমান্টিসিজম বা সাহসের ঠেলায় মানুষ করে নাই ভাই। এসব সাহস দেখাতে বাধ্য হয় টিকে থাকার প্রয়োজনে। আমাদের গ্রামের কথাই যদি বলি, সন্ধ্যার পর ওপাশ থেকে উজ্জ্বল আলোয় এপাশে চোখ ধাধিয়ে যায়। নদীতে জেলেরা মাছ ধরতে গেলে বিএসএফ স্পিডবোটে তাড়া করে। প্রায়ই চলে আসে নদীর এই পাড়ে। সীমান্তের এদিকে একটা বাঁশ পুততে গেলেও তারা আপত্তি জানায়। এসব সহ্য ও প্রতিরোধ করেই বর্ডারের মানুষ টিকে আছে।
কিন্তু সাহস দিয়ে তো আর ভাঙ্গনের কবলে থাকা জমি রক্ষা হয় না। বর্ষা আসলেই নদী পাড়ের মানুষের আত্মা কাঁপে। একেকটা ঢেউয়ের তালে তালে বাড়ে হার্টবিট। একটু একটু করে মাটি ক্ষয় হয়। যে উঠানের ধূলাবালি গায়ে মেখে একজন বড়ো হয়েছে, দেখা যায় সেই উঠান আর নেই। নেই তো নেই, একেবারে বাংলাদেশেই নেই। ভিন্ন দেশের ইউনিফর্ম পরা সৈনিকের পাহারায় সেখানে চাষাবাদ করছে ভিন্ন দেশের লোক। এই যন্ত্রণার কোনো তুলনা হয় না।
বর্ষা আবার চলে এসেছে। সিলেটে বর্ষা সময়ের আগে আসে এবং দীর্ঘ সময় থাকে। একেক বর্ষাকাল মানেই নতুন করে কয়েক শত একর জমি ভারতকে দিয়ে দেয়া।
পরশুদিন বিজিবির এক সৈনিক বজ্রপাতে মারা গেলেন। তীব্র ঝড় বাদলেও লোকটা ডিউটিতে ছিল। পাহাড়ের কিছু ভিডিও দেখি যেখানে বিজিবির জওয়ানরা মাইলের পর মাইল হেঁটে পানি সংগ্রহ করেন। দেশের সীমান্ত রক্ষার কী আপ্রাণ চেষ্টা। আহারে, তারা কি জানে, দেশের প্রশাসন ও রাজনীতিবীদররা সীমান্ত নিয়ে থোড়াই কেয়ার করে? জানলে জানের ওপর বাজি রাখতো?
বর্ষা আবার চলে এসেছে। সিলেটে বর্ষা সময়ের আগে আসে এবং দীর্ঘ সময় থাকে। একেক বর্ষাকাল মানেই নতুন করে কয়েক শত একর জমি ভারতকে দিয়ে দেয়া। কয়েকদিন আগে আমাদের গ্রামের শখানেক লোক ভাঙ্গন কবলিত নদীর পাড়ে গিয়ে সরকার ও প্রশাসনকে এলোপাথাড়ি গালিগালাজ করে ভিডিও করেছে। দুর্বলের একমাত্র অস্ত্র গালি, আর করবেই বা কী? আমি তখন বাড়িতে, আমাকেও ডেকেছিল গালাগালিতে যোগ দেবার জন্য। আমি যাইনি। আমি গালি ভালো জানি না। লিখতে পারি, কথা দিয়েছিলাম লিখব।
এই তো লিখলাম। আমি জানি এই লেখায় কিছুই হবে না। প্রশাসন অব্দি যাওয়া দূরে থাক, তেমন কেউ পড়বেই না। মানুষের মনে ভারতবিদ্বেষ যতটুকু আছে, বাংলাদেশ প্রেম তার অর্ধেক থাকলেও দেশের সীমান্ত বা সীমান্তের ভেতর নিয়ে ভাবতে হতো না।
সরকার আসবে, সরকার যাবে। সরকার ভারতপ্রেমী হবে, ভারতবিরোধী হবে। তাতে আমার আমার গ্রাম, আমার জকিগঞ্জের কোনো পরিবর্তন হবে না। ধীরে ধীরে আমাদের সব জমি চলে যাবে ভারতে। কেউ এসে দেখবে না, কেউ কিছু বলবে না। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব আমাদের শৈশবের স্মৃতিতে উড়ছে লাল সবুজের বদলে তেরাংগা পতাকা। আমাদের বুকে চাপা কষ্ট হবে, অভিমান কাজ করবে। অভিমান রাগে পরিণত হলে আমরা বর্ডারে গিয়ে গালাগাল দেব।
আর এদিকে ঢাকায় নানা রঙ্গের বাটপাররা ঘন ঘন হুংকার দিয়ে বলবে, ভারতকে এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দেয়া হবে না। এই তো আমাদের জীবন, এই তো আমাদের দেশ। এটাই আমাদের বাস্তবতা।
জয়নাল আবেদীন, লেখক ও গবেষক