পরিবেশবাদী বা পরিবেশের সুস্থতাকে নির্দেশ করে এমন কোনো চিহ্নের কথা বললেই আমাদের সবার মাথায় একটা ত্রি-চক্রাকার সবুজ আইকন দেখা দেবে। পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত আইকনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই তিনটি দিকচিহ্নযুক্ত আইকনটি। যেটি পরিচিত রিসাইকেল আইকন হিসেবে। পরিবেশের জন্য কল্যাণকর কোনো কিছু বোঝাতে এই আইকনটি সারা পৃথিবী জুড়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি এর বিভিন্ন সংস্করণও ব্যবহৃত হয়।
১৯৭০ সালে গ্যারি এন্ডারসন নামের এক ২৩ বছর বয়সী শিক্ষার্থী রিসাইক্লিং-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ইউনিভার্সাল এই লোগোটি ডিজাইন করেন। উনি একটি রিসাইকেল্ড পেপারের সিম্বল ডিজাইন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী হিসেবে এই আইকনটি ডিজাইন করে জমা দেন। ডিজাইনটি সৃজনশীলতা ও অর্থবোধকতার দিক থেকে অত্যন্ত চমৎকার ডিজাইন। গ্যারি এন্ডারসন প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে প্রায় দুই হাজার ডলার পুরস্কার পান। পরিবেশের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতাটি Container Corporation of America নামক একটি সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত হয়েছিল। আইকনটি তৈরির প্রেক্ষাপটে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই একটি ইতিবাচক দৃশ্য। ব্যক্তি সচেতনতা বৃদ্ধি, রিসাইকেলকে গুরুত্ব দেওয়া— সব মিলিয়ে পরিবেশের প্রতি বেশ ইতিবাচক একটি দৃশ্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আইকনটির এই ধরণের ব্যবহার অতটা ইতিবাচক হয়নি।
প্রত্যেক ডিজাইন, ক্যাম্পেইনেরই কিছু না কিছু বক্তব্য বা ন্যারেটিভ বা বয়ান থাকে। রিসাইক্লিঙের ত্রি-চক্রাকার ইউনিভার্সাল আইকনটির ন্যারেটিভ কী ছিলো ভাবা যাক। এই আইকনটির ব্যবহারের ন্যারেটিভ হলো এই যে— কোনো প্রোডাক্টের উৎপাদনকে না কমিয়ে প্রোডাক্টটি ব্যবহার করে আবার তা দিয়ে নতুন প্রোডাক্ট তৈরি করলেই পরিবেশগত ভারসাম্য তৈরি হবে। এই প্রোডাক্টগুলো মূলত প্লাস্টিক কিংবা প্লাস্টিকজাত প্রোডাক্ট। যখন প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করার কথা, কিংবা কমানোর কথা, তখন রিসাক্লিঙের ন্যারেটিভকে সামনে এনে এবং ভোক্তাকে রিসাইক্লিঙের প্রতি সচেতন হতে বলে প্লাস্টিক উৎপাদনকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, এতে করে প্লাস্টিক ব্যবসায়ীদের মুনাফা পেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে হচ্ছে না। রিসাইকেলের ধারণাকে জনপ্রিয় করে এবং জনতা বা ভোক্তাকে অসচেতনতার দোষ দিয়ে তারা দায় এড়াচ্ছেন, প্রচুর বিজ্ঞাপন বানাচ্ছেন। বিজ্ঞাপন পণ্য বিক্রি ছাড়াও মানুষের মগজ ধোলাইয়ে খুব ভালো কাজ করে। ব্যাপারটা খুবই আইরোনি যে, সারা পৃথিবীতেই যত পরিবেশ দূষণ নিয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, অনুষ্ঠান ইত্যাদি হয়েছে তার বেশিরভাগই বড় বড় দূষণকারী কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে করা। মূলত এই ব্যাপারটার কারণ অনুসন্ধানে গেলেই তাদের দ্বিমুখীতা ও সচেতনতামূলক বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের অন্তঃসারশূন্যতা চোখের সামনে এসে পড়ে।
পরিবেশবাদীদের একসময়কার মূখ্য স্লোগান ছিলো – রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকেল। দুঃখজনকভাবে আজকাল রিসাইকেলের আগের দুইটির কথা দেখা যায় না। সবজায়গাতেই রিসাইকেলের আলোচনাটিই জনপ্রিয়। কেননা এর জনপ্রিয়করণে প্রচুর অর্থ, শ্রম, মেধা ব্যবহার করেছে পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানিগুলো। প্লাস্টিকজাত পণ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে বলে তারা, ডাস্টবিনে জনতা ময়লা ফেলে না তা দেখিয়ে সেলফ ব্লেইমের বিজ্ঞাপন বানায় তারা। কিন্তু প্লাস্টিকজাত আবর্জনা তৈরি বন্ধের আলোচনায় নেই। বরঞ্চ প্লাস্টিকবিরোধী পলিসি বানাতে গেলে তারা বিরোধীতা করে। আর তাদের সাথে যোগ দেয় সরকারও। অকার্যকর, ব্যর্থ সরকার যখন তার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে করতে পারে না, তখন তার দোষ দেয় জনতার ব্যক্তিগত কাজের প্রতি। যেই কাজটি কিনা মূলত অব্যবস্থাপনা কিংবা খারাপ ব্যবস্থাপনারই প্রতিফলন।
বাজারে প্লাস্টিকজাত পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ভোক্তাকে প্লাস্টিক ব্যবহার করতে পরোক্ষভাবে বাধ্য করা হয়। আর বলা হয়, রিসাইকেল করতে হবে তাহলেই পরিবেশ ঠিক থাকবে। কিন্তু রিসাইকেলের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, রিসাইকেল করা সহজ কাজ নয়। রিসাইকেলে অতিরিক্ত অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় হয়। আবার আছে পণ্য উৎপাদনকালীন দূষণ। নতুন পণ্য উৎপাদনে যে দূষণ হয়, রিসাইকেলের ক্ষেত্রেও সেই দূষণটা হয়। আর সবকিছুই রিসাইকেলে আনা যায় না। সব প্লাস্টিক দিয়ে সবকিছু রিসাইকেল করে বানানো যায় না। যেগুলো যায় সেগুলোও একটা সময় নন-রিসাইকেলেবল হয়ে দাঁড়ায়। আর বর্তমানে প্লাস্টিকের পরিমাণ এতই বেড়ে গেছে যে সবগুলো রিসাইকেলের মাধ্যমে আনার পর আবার নতুন উৎপাদিত পণ্যকে রিসাইকেলের মধ্যে আনাটাও অসম্ভব ব্যাপার। অথচ রিডিউস আর রিইউজই পারে প্লাস্টিক উৎপাদনকে কমাতে। রিসাইকেলের ন্যারেটিভটা সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বা ন্যারেটিভের সাথে মিলে একটা লুপের মতন কাজ করে। যেই লুপটা আসলে দূষণকে বাড়ায়। যেমন, কোম্পানিগুলো একদিকে মানুষকে বলছে, এখানে ময়লা ফেলো, ওখানে ময়লা ফেলো, পরিবেশ দূষণ কমাও ইত্যাদি ইত্যাদি। খুবই কানে সুন্দর শোনায় ধরণের কথা। কিন্তু অন্যদিকে এই কোম্পানিগুলোই দূষণের জন্য দায়ী পদার্থ উৎপাদন করে ব্যবসা করছে। তাই রিডিউস আর রিইউজের ব্যাপার দুটি রিসাইকেলের ক্যাম্পেইনের কারণে চাপা পড়ে যায়। নিজেকে অর্থাৎ বিশাল জনগোষ্ঠীকে অনির্দিষ্টভাবে দোষ দিয়ে আমাদের মনে সাময়িক আনন্দ আসে, আমাদের মনে হয় অল্প হলেও ভালো কাজ তো করেছি। আমাদের মোরাল হায়ারার্কিটা আরেকটু উঁচুতে যায়। কিন্তু আমরা যা ভালো মনে করছি, তা কি আসলেই ভালো? পুঁজিবাদ ও কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার একসাথে মিলে তাদের লাভের জন্য বাকি বৃহত্তর জনতাকে ভালোর কথা বলে খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, দূষণ কমছে না। কারণ মানুষ কোন কাঠামোর সাথে কী আচরণ করবে বা কীভাবে কাজ করবে সেটা সেই কাঠামো বা ব্যবস্থার ডিজাইনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু সেরকম উদ্যোগ নেওয়া হলে সরকার ও মুনাফাখোর বড় বড় কোম্পানির অর্থপ্রাপ্তিতে টান পড়বে। তাই দূষণ কমাতে কার্যকরী ব্যবস্থা (যেটা কিনা অন্যায্য মুনাফার সাথে সাংঘর্ষিক) যেন না নেওয়া লাগে তাই দোষ দেওয়া হচ্ছে জনতাকে, ভোক্তাকে। বলা হচ্ছে, “বদলে যাও, বদলে দাও” কিংবা, “দেশ আমার, দোষ আমার”। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশ বা রাষ্ট্র বা সিস্টেমটা কি সত্যিই জনতার? জনতার মতের বা জনতার নিজেরই এই সিস্টেমের মধ্যে কোনো দাম আছে? কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জনতাকে জিজ্ঞেস করা হয়? রাষ্ট্রটাই তো জনতার না, রাষ্ট্রের কোনো পলিসিতে অংশগ্রহণের সুযোগ জনতার নেই। তাহলে দোষ কী করে জনতার?
এই মুহূর্তে আমরা যদি সত্যিই একটি বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের পলিসি নিয়ে ভাবতে হবে, সিস্টেম নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কী চাই? আমরা কি রোগ হবার পর রোগ প্রতিরোধ করবো একটা একটা করে? নাকি রোগ হবার আগেই তা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিবো? নীতিমালা প্রণয়নে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না পাওয়া জনতাকে ব্যক্তিগতভাবে দোষ দিয়ে বিজ্ঞাপন বানাবো? নাকি সরকারকে তার কাজের ব্যপারে বলপ্রয়োগ করবো? আমরা কার পক্ষ নিবো? নিজেদের বা জনতার? নাকি সরকার, সরকারি জবরদস্তিমূলক আইন এবং দূষণকারী বড় বড় কোম্পানির পক্ষ? আমরা কি সত্যিকারের আলোর দিকে যাবো? নাকি আলোর মরীচিকায় সীমাহীন অন্ধকারের দিকে?
সুবিনয় মুস্তফী ইরন মুক্তিফোরামের একজন সম্পাদক