দেশ যার দোষ তার, এইরকম চিন্তা ভাবনা করতে আমাদের প্রথম প্ররোচিত করে ব্রিটিশরা। তারা যেই দেশেই যেত ওই দেশের মানুষকে আগে বোঝানোর চেষ্টা করতো যে তাদের সংস্কৃতি বর্বর আর ব্রিটিশ সংস্কৃতি হচ্ছে সভ্য। তাদের যুক্তি ছিল এই যে একবার যদি কোনো জাতি মনে প্রানে মেনে বসে যে ব্রিটিশরা আসলেই সভ্য আর তারা নিজেরা আসলেই বর্বর, তাহলে তারা স্বেচ্ছায় ব্রিটিশদের শ্বাসন মেনে নিবে। শুধু তাই না, শ্বাসনরত অবস্থায় দেশের কোনো সমস্যার জন্য সে দোষ শ্বাসক অথবা সিস্টেমকে দিবে না, সে দোষ দিবে নিজেকে আর তার নিজ জাতির অন্যান্য লোকদেরকে। এই ধরণের চিন্তাভাবনার প্রচার করার জন্য ব্রিটিশরা অনেক এলিটিস্ট সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপ্রশকতা করতো। এই কারনেই বাঙালি আত্মঘৃনার অন্যতম প্ররোচক ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই মন মানষিকতা আমাদের অনেকের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে। বিশেষ করে বিত্তবান এলিটিস্টদের মধ্যে এর প্রবনতা অনেক বেশি। তাদের অনেকের মতেই আমাদের দেশে যা সমস্যা তা সরকার বা সিস্টেমের কারনে না, দোষ সব বাঙালি জাতির। তাদের ধারনা নিম্নবিত্তরা যদি বাসে ওঠার সময় ধাক্কাধাক্কি না করে সুন্দর মতন লাইন ধরে বাসে উঠতো, তাহলেই দেশের সব সমস্যা অটোমেটিক সমাধান হয়ে যাইতো। তাহলেই অটোমেটিক নির্বাচনের নামে ভোট ডাকাতি বন্ধ হয়ে যাইতো, তাহলেই অটোমেটিক সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ উঠে যাইতো, তাহলেই অটোমেটিক মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে মেধা যাচাইয়ের চর্চা বন্ধ হয়ে যাইতো, তাহলেই বিচার বিভাগ অটোমেটিক স্বাধীন হয়ে যাইতো, তাহলেই সবাই সরকার থেকে অটোমেটিক বিনামূল্য চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ পেত, তাহলেই চাষিরা অটোমেটিক তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পেত, তাহলেই অটোমেটিক শ্রমিকরা ন্যায্য বেতন পেত।
আচ্ছা বলেন তো, আপনারা যাদের কামলা বলে সম্বোধন করেন, যারা ধাক্কাধাক্কি করে বাসে ওঠে, দোষ যদি আসলেই সিস্টেম ও সরকারের না হয়ে তাদের হয়ে থাকে, তাহলে এই একই মানুষরা যখন হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যায় তখন কেন তারা সুন্দর করে সিরিয়ালে ডাক্তার দেখায়? তখন কেন তারা বাসের মতন ধাক্কাধাক্কি করে না? যেই পুলিশ পারলে এখন একদম একজন হতদরিদ্রদের কাছ থেকেও পাঁচ টাকা ঘুষ খায়, সেই একই পুলিশ কেন ২০০৭ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘুষ দিলেও নিত না? নাকি এখন বলবেন যে ওই আমলে ইউরোপ আমেরিকা থেকে পুলিশ ভাড়া করে আনা হয়েছিল?
আসলে দোষটা মানুষের না, দোষটা সিস্টেমের, দোষটা সরকারের। মানুষকে দোষ দেওয়াটা সরকারের দেশ মেরামত করার দ্বায়িত্ত এড়ায়ে যাওয়ার একটা ধান্দা। দেশের যত সমস্যা এই সব সমস্যা কোনো ভাবেই একটা রিকশাওয়ালা ভাইয়ের ঠিক করার দ্বায়িত্ত না। দ্বায়িত্ত তার যাকে সে তার জীবিকা নির্বাহের কাজ বাদ দিয়ে সেন্টারে যেয়ে ভোট দিয়ে আসছে।
উন্নয়নের দিক থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোই এখন এগিয়ে। বিশেষ করে নর্ডিক দেশগুলো। তারাই কিন্তু এক সময় ভাইকিং ছিলো যারা কিনা জাতি হিসাবে এক সময় খুব মারমূখী ছিল। এমনকি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও উন্নয়নের দিক থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে নর্ডিক দেশগুলো পিছের কাতারেই ছিল। এই একশ বছরে তাদের সংস্কৃতি কিন্তু বদলে যায়নি। বদলেছে তাদের সিস্টেম, তাদের শ্বাসনব্যাবস্থা, তাদের সরকার। এক সময় সভ্যতার তুঙ্গে ছিল ফার্সিরা। তাদের সংস্কৃতি আর পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির মধ্যে কিন্তু তফাৎটা অনেক বেশি ও দৃশ্যম্যান। তখন কিন্তু ফার্সিদের দেখাদেখি ইউরোপীয়রা মাথায় পাগড়ি পরে ঘুরে বেড়াতো না। আসলে এসবের সাথে উন্নয়নের কোনো সম্পর্কই নেই। পুরো বিশ্বের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির জাতিরা উন্নয়নের তুঙ্গে পৌঁছেছে। আবার ওই একই সংস্কৃতির লোকেরা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসও হয়ে গেছে।
ইউরোপীয়রা আমাদের থেকে অনেক উন্নত। কিন্তু সেটা এই কারনে না যে তারা লুঙ্গির বদলে প্যান্ট পরে, অথবা এই কারনেও না যে তারা হাত দিয়ে খাবার না খেয়ে চামচ দিয়ে খায়। তারা উন্নত তাদের সরকার ব্যবস্থার কারনে, তাদের গণতন্ত্রের কারণে, তাদের গুড গভর্নেন্সের কারনে।
শামস ইশতিয়াক রহমান, সম্পাদক মুক্তিফোরাম।