চীনে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক ও গুজব।
এসব গুজব নিয়ে কথা বলতে গতরাতে ফেসবুক লাইভে আসেন চিকিৎসক ও বিশিষ্ট টিভি ব্যাক্তিত্ব ডাক্তার আব্দুন নূর তুষার।
তিনি বলেনঃ-
উহানে যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে তার নাম হচ্ছে “নভেল করোনা ভাইরাস”। “নভেল” শব্দটির অর্থ হচ্ছে নতুন। নভেল আসলে এটির নাম নয়। সবাই এটিকে এই নামে ডাকছে তার কারণ হল ২০১৯ সালে করোনা ভাইরাসের এই প্রজাতিটি চীনে আবিস্কৃত হয়েছে বা ধরা পড়েছে।
ধারনা করা হচ্ছে চীনের কোন সী-ফুড মার্কেট বা সামুদ্রিক খাবারের বাজার হতে এটি ছড়িয়েছে তবে এটি কোন প্রমানীত সত্য নয়। মূল তথ্য হল পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ সামুদ্রিক খাবার চীনের মানুষ ভক্ষন করেন। ইতপূর্বে চীনের মানুষ শুকর খেতে পছন্দ করত কিন্তু অতি সাম্প্রতিক কালে চীনের মানুষ সামুদ্রিক খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এবং সামুদ্রিক মাছের এইসব বাজার গুলোতে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি বাদুড়, সাপ, ইল এর মত বিভিন্ন প্রানী বিক্রি হয়ে থাকে।
যেহেতু করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের প্রায় ৭০ ভাগ জানিয়েছেন তারা এধরনের সামুদ্রিক প্রানীর বাজার গুলোতে গিয়েছেন সেহেতু এটি একটি ধারণা প্রসূত তথ্য সামুদ্রিক প্রানীর বাজার হতে এই ভাইরাসটি এসেছে।
কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যম ইতমধ্যে সংবাদ প্রকাশ করেছে সামুদ্রিক প্রানীর বাজার হতেই এটি এসেছে এবং কিছু কিছু গণমাধ্যমে বাদুড়ের ছবি সহ সংবাদটি প্রচার করা হয়েছে কিন্তু এটি কোন প্রমানীত তথ্য নয়।
এছাড়াও একটি গুজব ছড়িয়েছে সাড়ে ৬ কোটি মানুষ এই ভাইরাসটিতে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু করোনার চেয়েও কঠিন প্রজাতির দুটি ভাইরাস ছিল মার্স ও সার্স যাতে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ কিন্তু তার পরেও ২০০২ সালে এসব ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ মত।
করোনা ভাইরাসে সাড়ে ৬ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে যে গুজব ছড়াচ্ছে তার পেছনের তথ্যটি হল করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার শতকরা ২ শতাংশ। এবং এই ২ শতাংশ হারে সাড়ে ৬ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে হলে কমপক্ষে ৩২৫ কোটি মানুষকে করোনায় আক্রান্ত হতে হবে এবং প্রতিদিন যদি এক লক্ষ করেও আক্রান্ত হয় তার পরেও ৩২৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার জন্য সময় প্রয়োজন হবে ৯০ বছর। অর্থাৎ এটি সম্পূর্ণ একটি জল্পনা-কল্পনা এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম এটি প্রচার করছে বিশেষ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও কিছু পত্র-পত্রিকা এধরনের গুজব ছড়াচ্ছে।
এছাড়াও আরেকটি গুজব ছড়িয়েছে চীন মাত্র দুই বা সাত দিনে দিনে হাজার হাজার মানুষের জন্য হাসপাতাল তৈরী করে ফেলছে। এই তথ্যটিও সম্পূর্ণ ভুল। চীনে হাসপাতাল তৈরী হচ্ছে তবে তার লক্ষ হচ্ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের অন্যদের হতে আলাদা করে রাখা। এবং যে কোন সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রনে এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যেহেতু চীনের জনসংখ্যা বেশি সেহেতু সংক্রামনের হারও বেশি তাই অধিক জনসংখ্যার স্থানে সংক্রামিত রোগে আক্রান্তদের আলাদা করে রাখা জরুরী।
তবে যেভাবে বলা হচ্ছে সাত দিনের মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে চীন হাসপাতালে নিয়ে আসবে তা সত্য নয়। ২৮শে জানুয়ারি “সাউথ চায়না মর্নিং পোষ্ট” এ প্রকাশিত একটি ভিডিওতে বলা হয়েছে একটি হাসপাতাল তৈরী হচ্ছে তবে এটি সাত দিনের মধ্যে তৈরী হয়ে যাবে এটি সম্ভব নয় এবং এটি একটি অস্থায়ী হাসপাতাল।
এ থেকে বোঝা যায় আমরা নিজেরা আপন মনে বিভিন্ন গালগল্প বলে সাধারন মানুষ কে আতঙ্কিত করছি।
যে কোন ভাইরাস দ্বারা আমরা আক্রান্ত হলে প্রাথমিক কাজ হচ্ছে এটি যাতে অন্যকে আক্রমন করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেয়া। আমরা প্রতিনিয়ত যে সাধারন সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হই তার কারনও কিন্তু করোনা ভাইরাস। তবে নিয়মিত যে ভাইরাসের দ্বারা আমরা আক্রান্ত হই সেটি মানুষকে মেরে ফেলে না। এধরনের ভাইরাসে মৃত্যুর হার অতি অল্প। তার পরেও সাধারন হাঁচি-কাশিতেও কিন্তু আমরা মুখ ঢাকি। মুখ ঢাকার নিয়ম হল টিশ্যু বা রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকা হাত দিয়ে নয় তবে হাত দিয়ে মুখ ঢাকলে অবশ্যই হাত সাবান দিয়ে পরিস্কার করে ধুয়ে ফেলতে হবে। এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়া যে ব্যাক্তি আক্রান্ত হন নি তার চেয়েও আক্রান্ত ব্যাক্তির জন্য বেশি জরুরী। কারন আক্রান্ত ব্যাক্তি সাধরনত হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় হাত মুখের কাছে নিয়ে যান এবং সেই হাত দিয়ে যদি কাউকে স্পর্শ করেন তবে তবে তার মাধ্যমে সংক্রামন ছড়াতে পারে।
দ্বিতীয়ত এধরনের রোগে আক্রান্ত কেউ থাকলে সেই ব্যাক্তিকে আলাদা করে ফেলতে হবে এবং তার সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না।
তৃতীয়ত ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেতে হবে, কেননা ভিটামিন সি এধরনের ভাইরাস প্রতিররোধ করে।
চতুর্থত সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
এই হচ্ছে এধরনের ভাইরাস হতে বাঁচার উপায়।
যে কোন ভাইরাসেরই প্রকৃত অর্থে কোন ঔষধ নেই। আমাদের শরীরের আভ্যন্তরীন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সেটি যেকোন ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরক্ষা দিয়ে থাকে।
সেহেতু করোনা ভাইরাসের কোন ঔষধ নেই বা এটি প্রতিরোধে কোন টিকা আবিস্কৃত হয়নি বলে আতংকিত হবার কারন নেই। কারন বেশির ভাগ ভাইরাসেরই কোন ঔষধ নেই। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে যে দেশে মানুষ বেশি সেই সব দেশে সতর্কতা বেশি নিতে হবে। যেসব দেশে মানুষ কম সেইসব দেশে এটি ছড়ানোর হারও কম হবে। সেহেতু স্বল্প জনসংখ্যার কারনে ইউরোপ আমেরিকার মত স্থানে এটি কম ছড়াবে তার তুলনায় এশিয়াতে বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে কারন এশিয়ার দেশ গুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি।
তাই কেউ যদি চীনে বেড়াতে যান বা চীন থেকে ফিরেন তবে অধিকতর সতর্ক হতে হবে। এবং শুধু চীন নয় যে সকল দেশ ইতমধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে সেই সকল দেশে আশা যাওয়ার ক্ষেত্রেও একই ভাবে সতর্ক হতে হবে।
বিদেশ হতে ফেরত কারো যদি এই ভাইরাসের লক্ষন দেখা যায় কেউ যদি জ্বর সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হন এবং শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন তবে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ডাক্তার এর নিকট যেতে হবে।
এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেই মানুষ মারা যাবে এমনটা নয় তবে যারা শিশু ও বেশি বয়স্ক তাদের ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। সাধারন যুবক যুবতীদের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা কম। সাধরনত ৫০ উর্ধ ব্যাক্তিদের ক্ষেত্রে এধরনের ঝুঁকি থাকে।
করোনা ভাইরাস কিভাবে মানুষ মারে?
এটি মুলত নিউমনিয়া তৈরী করে এবং এক্সরেতে দেখা যায় এটি গ্রাউন্ড গ্লাস ওপাসিটি অর্থাৎ ঘসা কাঁচের ন্যায় এক্সরে রিপোর্ট পাওয়া যায়। যেটি নিউমনিয়ার লক্ষন ও কনসলিডেশন এর লক্ষন অর্থাৎ ফুসফুস এতে আক্রান্ত হয় এবং ফুসফুসে পানি জমে যায় এবং সলিড হয়ে যায় যার ফলে শ্বাস নিতে না পেরে মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়াও ফুসফুস আক্রান্ত হবার কারনে অনেকের হৃদযন্ত্রেরও ক্ষতি হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন রোগেও মানুষের মৃত্যু হতে পারে।তবে গণমাধ্যমগুলো যেভাবে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তা একেবারেই ঠিক নয়। এই ভাইরাস সম্পর্কে আগে ভালোভাবে জানা দরকার। এবং জেনে তবেই কথা বলা দরকার।
না জেনে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যারা বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছেন সেটি মূলত মেধাহীনতার পরিচয়।
ভাইরাসটি সম্পর্কে জানতে গুগুল করে দেখতে পারেন।
এভাবে শেয়ারের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো বন্ধ করা উচিত।
আব্দুন নূর তুষারের ফেসবুক লাইভের লিংকঃ-
https://www.facebook.com/doctorantushar/videos/572723683312348/