লকডাউন ১ মাসের বেশি চললে অন্তত কত লোক খাদ্য সংকটে পড়তে পারে?
খুব রক্ষণশীল একটা হিসেবে একটা হাইপোথিসিস করে দেখা যাচ্ছে যে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার প্রতিরোধের লকডাউন এক মাসের বেশি চলতে থাকলে অনাহারী মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৬ কোটি ৯৯ লক্ষতে পৌঁছাতে পারে।
অতিদরিদ্র
জনসংখ্যার ১০,৫%, ১ কোটি ৬৫ লাখ, দৈনিক আয় ১ ডলারের কম। দৈনিক পারিবারিক আয় ১ বা সর্বোচ্চ ২ ডলার, এদের সঞ্চয় নেই। ফলে দেড় কোটির বেশি মানুষ লকডাউনের ১ম সপ্তাহের মাঝখান থেকে চরম খাদ্য সংকটে পড়েছেন।
দরিদ্র
মোট জনসংখ্যার ২০,৫%, ৩ কোটি ৭৫ লাখ। দৈনিক আয় ১,৯ ডলার। ১০,৫% অতি দরিদ্র বাদ দিলে বাকি ২ কোটি ১০ লাখ জনতা এই কাতারে আছেন। গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স অনুসারে ২.৩৫ কোটি মানুষ স্বাভাবিক অবস্থাতেই ঠিক মত না খেয়ে অপুষ্টিতে ভোগেন। সোয়া দুই কোটির বেশি দরিদ্র লকডাউনের ২য় সপ্তাহ থেকেই চরম খাদ্য সংকটে পড়েছেন। দৈনিক পারিবারিক আয় ২ থেকে সর্বোচ্চ ৪ বা ৫ ডলার, এদের কাছে ৩ বা ৪ দিনের সঞ্চয় থাকতে পারে, তবে ১ সপ্তাহের বেশি নয়।
অপ্রাতিষ্ঠানিকশ্রমিক– করোনাজনিতকর্মহীনতা
সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ মতে মোট শ্রমশক্তির ৮৫,১% অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এই সংখ্যা ৫ কোটি ১৭ লক্ষ। এই শ্রেণী যে কোন ধরনের ওয়ার্ক ফ্যাসিলিটি ও কর্ম সুরক্ষা ভাতা থেকে বঞ্চিত। করোনার কারনে এদের প্রায় সবাই অন্তত (৭৫% কর্মহীন)। সোয়া পাঁচ কোটি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক জনতার অন্তত অর্ধেক সঞ্চয় শেষে ৩য় সপ্তাহ শেষে বা এক মাসের মধ্যেই সংকটে পড়তে যাচ্ছেন। এদের অর্ধেকের বেশির সঞ্চয় নেই, তবে যেনতেন হলেও একটা চাকরি ছিল বলে এরা সংকট মুহুর্তে ধার করতে পারবে ২ বা ৩ সপ্তাহের জন্য।
প্রাতিষ্ঠানিকশ্রমিক– করোনাজনিতকর্মহীনতা
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাক্কলন করে বলেছে করোনা জনিত প্রভাবে বাংলাদেশের ৯ লাখ লোক তাৎক্ষণিক ভাবে কাজ হারাবেন, প্রতিষ্ঠানিক খাতে কাজ হারানো ৯ লাখের অন্তত অর্ধেক সঞ্চয় ফুরিয়ে সংকটে পড়তে পারে। এদের কিছু সঞ্চয় আছে, তবে মধ্যবিত্তের টানাটানির মধ্যে তা ১ মাসের বেশি হবে না, সঞ্চয় না থাকলেও চাকরি ছিল বলে এরা সংকট মুহুর্তে ১ মাসের জন্য ধার করতে পারবে।
কৃষক
ফসলের অপেক্ষায় থাকা কৃষক, ঠিক ফসলের আগে যার কাজ নেই ও মৌসুম চেঞ্জ হওয়ায় অন্য কৃষি উৎপাদনও কম, এমনিকি এদিকে বাজারেও দর নেই। এই কৃষকই অনাহারের মুখে পরতে যাচ্ছে, যারা ঠিক গতবছরেই রেকর্ড ফলন ফলিয়েছেন কিন্তু ধান বা ফলনের ন্যায্য দাম পাননি। এখন সঠিক বিতরণের অভাবে উৎপাদন কারী শ্রমিক কৃষকই অনাহারে! এরা এই মুহুর্তে ঋণী, উপরন্তু ফসল হারভেস্টে শ্রম মূল্যের জন্য এদের টাকা দরকার। ফসল উঠলে তা বেঁচে ঋণ পরিশোদ করবেন, ফলে তারা এই মুহুর্তে অতিরিক্ত অর্থ ধার বা ঋণ পাবেন না, তবে সহ কৃষকের কাছ থেকে কিছু ধার দেনা করে ২-৩ সপ্তাহ চলতে পারবেন।
সরকারিসামাজিকসুরক্ষাভাতাভোগী
এমনকি সংকটে পড়বেন ৭৮ থেকে ৮৪ লক্ষ মানুষ যারা সরকারি সামাজিক সুরক্ষার ভাতা পান, কারণ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়া বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, শিক্ষা উপবৃত্তি, বিধবা বাকি সব ভাতাই মাসিক হিসেবে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায়। তবে স্থানীয় নেতা, প্রশাসনের লোকের ক্ষুধা মিটিয়ে বাকি যা থাকে তা দিয়ে এর চেয়েও কম, যদিও কিছু খাতের ভাতা মোবাইল পে করা হয়। তবে এতে পুরা পরিবারের সারা মাসের ক্ষুধা মিটেনা। এমনকি পুরা ৬০০ টাকার ভাতাও পুরা পরিবারের সবার ক্ষুধা মেটাতে অপ্রতুল।
দৈনিক সর্বোচ্চ ২০ টাকা হিসেবের এই ভাতায় দুঃস্থ, স্থায়ী বেকার, সরকারের মুখাপেক্ষী শ্রেণীর ক্ষুধা মিটবে না। ফিল দা নিউট্রিশান গ্যাপ বাংলাদেশ স্টাডিতে দেখা গ্যাছে, বাংলাদেশের একজন ব্যক্তিতে সম্পূর্ণ সুষম খাদ্য খেতে হলে, ১৭৪ টাকা এবং কোন মতে কিছু খেয়ে বেচে থাকতে হলে ৮০ টাকা প্রয়োজন হয়। এই শ্রেণীর অন্তত এক চতুর্থাংশ (২১ লক্ষ) থেকে অর্ধেক (৪২ লক্ষ) খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছেন সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহের মধ্যেই।
স্বচ্চল দৈনিক শ্রমিক যারা সামাজিক সুরক্ষার বাইরে
বেকার যুবক, খুব ছোট পর্যায়ের ফ্রিল্যান্সার, টিউশানি করে বাঁচা মানুষ, হকার রিক্সা শ্রমিক, পরিবহণ শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, দিনমজুর, ভাসমান শ্রমিক যারা স্বচ্চল ছিলেন, কারো কাছে হাত পাততেন না, দিনের মজুরি দিয়ে চলেন যারা সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পান না। এদের কিছু সঞ্চয় আছে, তবে মধ্যবিত্তের টানাটানির মধ্যে তা ১ মাসের বেশি হবে না, সঞ্চয় না থাকলেও উপার্যন ছিল বলে এরা সংকট মুহুর্তে ১ মাসের জন্য ধার করতে পারবেন। ভাসমান, দিনমজুর শ্রমিকের এক চতুর্থাংশ প্রায় ৫০ লক্ষ লোক মাত্র দ্বিতীয় সপ্তার পরেই চরম খাদ্য সংকটে পড়তে পারেন। ফলে খুব রক্ষণশীল হিসেবেই দেখা যাচ্ছে অন্তত ৬ কোটি ৯৯ লক্ষ লোক লকডাউন জনিত কর্মহীনতার মাত্র এক মাসের মধ্যে চরম খাদ্য সংকটে পড়বেন।
এই সমূদয় হিসেবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনসংখ্যা, শ্রমশক্তি, আয় ব্যয় খানা জরিপের হিসেবে তৈরি। অভিযোগ আছে বিবিএস তথ্য শালায় জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো আছে। বাস্তবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা সাড়ে ষোল কোটি (১৬ কোটি ৪৬ লক্ষ ৯০ হাজার) নয় বরং তার চেয়ে ঢের বেশি। এতে করে আশঙ্কা থেকে যায় যে, বাস্তবিক খাদ্য সংকটের ঝুঁকিতে থাকা জনসংখ্যার পরিমাণ সাত কোটি থেকেও কিছু বেশি হতে পারে।
ফাইজ তাইয়েব আহমেদ, লেখক ও গবেষক