লেখক নাওমি ক্লেইনের মতে, “জাতিগত কোন বিপর্যয়, যেমন, যুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান, জঙ্গি হামলা অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জনগণের অধিকার হরণের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের সুবিধা অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন করাকেই “শক ডকট্রিন” বলা হয়।” সরকার এবং ব্যবসায়ীরা গত শতাব্দীতে নিজেদের মুনাফা বাড়াতে বহুবার এ ধরণের নীতি হাতে নিয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ চিলিতে সামরিক ক্যুপ, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক হামলা, ২০০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দা প্রমুখ।
করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে শক ডকট্রিনকে করোনাভাইরাস পুঁজিবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কারণ, করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে কর্পোরেশনের সুবিধা অনুযায়ী নীতি প্রণয়নের পাঁয়তারা সারা বিশ্বেই চলছে। এই লেখায় সারা বিশ্ব এবং বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পুঁজিবাদের প্রভাব তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
বিশ্বের প্রেক্ষাপটে করোনাভাইরাস পুঁজিবাদঃ
সারা বিশ্বে ইতোমধ্যে করোনা সংকটকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি প্রণয়নের চল শুরু হয়ে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এনভায়েরনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি ইতোমধ্যে পরিবেশ বিষয়ক আইন শিথিল করেছে, চায়নার ইকোলজিকাল এন্ড এনভায়েরনমেন্টাল এনফোর্সমেন্ট ব্যুরো কারখানার পরিবেশগত নজরদারির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুই দশমিক দুই ট্রিলিয়ন ডলারের করোনাভাইরাস প্রণোদনা প্যাকেজের ৫০০ বিলিয়ন কর্পোরেশনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। ২০০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দাকালীন বেইল আউট প্যাকেজের মতই এবারের প্যাকেজও মূলত ব্যবসায়ীদের জন্য কোন বাধ্যবাধকতা ছাড়াই প্রণীত হয়েছে। এছাড়াও, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যে এই তহবিল তদারকি করার জন্য নিযুক্ত ইন্সপেক্টর জেনারেল গ্লেন ফাইনকে অপসারিত করেছেন। ফলে, ট্রাম্প এবং তাঁর মিত্রদের জন্য এই তহবিলের অর্থের অপব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করা সহজ হয়ে গেল।
কর্পোরেশনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের মাঝে ৪৬ বিলিয়ন ডলার সরাসরি আর্থিক সহায়তা প্রদানে ব্যবহৃত হবে। ব্যবসায়ীরা এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের জন্য সুবিধাজনক চুক্তি আদায় করে নিয়েছে। যেমন, বিমান খাতের জন্য এই সহায়তা সরাসরি প্রদান না করে স্বল্প সুদে ঋণ হিসেবে দেয়ার কথা আলোচনায় আসলে বিমান খাতের প্রতিনিধিরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পুঁজিবাদ
বাংলাদেশ সরকারও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সর্বমোট ৯৫,৬১৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সব রকমের পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু এই প্যাকেজের মাধ্যমে কি বাংলার জনসাধারণের যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, ব্যাংকিং খাত এবং কৃষি খাতের জন্য এই প্রণোদনা প্যাকেজের ফলাফল কী হতে পারে, সেটির একটি বিশ্লেষণ করার প্রচেষ্টা এখন করবো।
রপ্তানি খাতের মুনাফাকেন্দ্রিক হঠকারী পদক্ষেপ
প্রাথমিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে রপ্তানীমুখী খাতের কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদানের জন্য ২% সুদে ৫,০০০ কোটি টাকার ঋণ ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার পরও অন্তত ১০,০০০ গার্মেন্টস শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। এই মহামারির ফলে মালিকপক্ষ দ্বারা শ্রমিকরা আবার বঞ্চিত হচ্ছেন। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান খাতের মত বাংলাদেশের কিছু গার্মেন্টস মালিক সরকারকে ঋণের পরিবর্তে সরাসরি আর্থিক সহায়তা প্রদান করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে গত ৫ এপ্রিল গার্মেন্টস চালু করার ঘোষণা দেন। ফলশ্রুতিতে, সারা দেশ থেকে শ্রমিকেরা করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নিরুপায় হয়ে পায়ে হেঁটে ঢাকা আসতে শুরু করেন। তুমুল সমালোচনার মুখে মালিকরা ঢাকায় শ্রমিকরা পৌঁছে যাওয়ার পর গার্মেন্টস বন্ধ করার ঘোষণা দেন। তবে বিজিএমইএ আবার ঘোষণা দেয় যে ২৬ এপ্রিল থেকে গার্মেন্টস খুলে দেয়া হবে। তাঁরা দাবি করেন যে গার্মেন্টস না খুললে তাঁরা টিকে থাকতে পারবেন না। এবারও তুমুল সমালোচনার মুখে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন।
তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এখনো তৈরি পোশাকশিল্পসহ রপ্তানি খাত যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুনরায় চালু করার জন্য আলোচনা চলছে, অচিরেই হয়তো খুলে দেয়ার নির্দেশনা আসতে পারে। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে যে অনির্দিষ্টকালের জন্য রপ্তানিখাত বন্ধ থাকলে আমাদের অর্থনীতির জন্য সেটি ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই কথার সাথে দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই যে আমাদের অর্থনীতি এক উভয় সংকটের মুখোমুখি। উৎপাদন বন্ধ থাকলে দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা।
বাংলাদেশে যখন প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, সেরকম একটি পরিস্থিতিতে কি কারখানায় মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্ভব? এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, কর্মচারীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার কথা। করোনাভাইরাসের উপসর্গ প্রকাশ পেতেও সাধারণত পাঁচ দিন সময় লাগে, সেক্ষেত্রে যদি একজন কর্মচারীর মাঝে কোভিড-১৯ ভাইরাস থাকে, তাও সেটি তাপমাত্রা পরীক্ষায় প্রকাশ পাবে না, অর্থাৎ, করোনাভাইরাস কারখানাগুলোতে ছড়িয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যাবে।
রপ্তানি খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন যে বাংলাদেশ দ্রুত উৎপাদন শুরু না করলে ভিয়েতনাম, লাওস, ক্যাম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডের কাছে বাজার হারাবে। আমরা যদি আমাদের রপ্তানি বাজার তাদের কাছে হারাই, সেটি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। কিন্তু এই দেশগুলোর করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে তাদের কারো অবস্থাই বাংলাদেশের মত শোচনীয় নয়।
দেশ | মোট রোগী | মোট মৃত্যুর সংখ্যা | মোট পরীক্ষা | পরীক্ষা/১০ লক্ষ জনসংখ্যা |
ভিয়েতনাম | ২৬৮ | ০ | ২,০৬,২৫৩ | ২,১১৯ |
ক্যাম্বোডিয়া | ১২২ | ০ | ৫,৭৬৮ | ৩৪৫ |
লাওস | ১৯ | ০ | ১,৩৪৯ | ১৮৫ |
থাইল্যান্ড | ২,৮২৬ | ৪৯ | ১,৪২,৫৮৯ | ২,০৪৩ |
বাংলাদেশ | ৩,৩৮২ | ১১০ | ২৯,৫৭৮ | ১৮০ |
ওয়ার্ল্ডমিটারসের ২২ এপ্রিলের উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, লাওসে এখনো পর্যন্ত করোনাভাইরাসে কেউ মৃত্যুবরণ করেননি, থাইল্যান্ডের পরিস্থিতি এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে খারাপ। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে ভিয়েতনামের পাশাপাশি থাইল্যান্ডও জনসংখ্যার অনুপাতে প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রতিটি সম্ভাব্য কেসের পরীক্ষা করা এবং আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা সকলকে আইসোলেশনে রাখা। আমাদের দেশে প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের জন্য ১৮০ টি পরীক্ষা করা হয়েছে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলাদেশ এই করোনা সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করার ধারেকাছেও আসেনি।
এমতাবস্থায় সারা দেশ থেকে শ্রমিকদের আবার ঢাকায় এনে কাজে নিয়োজিত করা শ্রমিকদের চূড়ান্ত ঝুঁকির মাঝে ফেলার সামিল হবে। এভাবে, বারংবার শ্রমিকদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে কারখানা খুলে দেয়ার পাঁয়তারা করা মালিকদের চরম মুনাফালোভী প্রবৃত্তিকেই তুলে ধরে।
গভীর ঋণখেলাপি সংকটের মুখোমুখি ব্যাংকিং খাতঃ
সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের মাঝে অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্যাকেজটি বরাদ্দ করা হয়েছে শিল্প এবং সেবাখাতের জন্য। ৯% সুদে বরাদ্দকৃত ৩০,০০০ কোটি টাকার এই প্রণোদনা প্যাকেজের ৪.৫% সুদ সরকার পরিশোধ করবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে এই ঋণ প্রদান করবে। তবে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এতদিন যাবৎ গ্রাহকের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতেই ঋণ প্রদান করে এসেছে এবং এর ফলশ্রুতিতে দেশে অভাবনীয় এক ঋণখেলাপি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণ ৪০২ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৯৪,৩১৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে যা মোট ঋণের ৯.৩২%। এই করোনাভাইরাস সংকটের সময়েও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চারটি সরকারি ব্যাংককে নাভানা গ্রুপের ৫,২৩২ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋণখেলাপিরা এই সংকট ব্যবহার করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনের জন্য চাপ দিতে পারে। এর ফলে, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা সামনের দিনগুলোয় আরও গভীর সংকটের মুখে পড়বে।
সুদের বোঝা কৃষকের ঘাড়েঃ
১২ এপ্রিল সরকার কৃষি খাতের ফলন অব্যাহত রাখার জন্য ৫% সুদে ৫,০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এই প্যাকেজের আওতায় ১% সুদ ব্যাংককে বহন করতে হবে, অর্থাৎ, কৃষককে ৪% সুদ পরিশোধ করতে হবে।
খাত | কার্যকর সুদ (%) |
রপ্তানি খাত | ২% |
শিল্প এবং সেবা খাত | ৪.৫% |
কৃষি খাত | ৪% |
এখানে, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে গ্রামীণ কৃষককে ৪% সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে যা কিনা রপ্তানি খাতের সুদের হারের দ্বিগুণ এবং শিল্প এবং সেবা খাতের প্রায় সমান। কৃষি খাতের তুলনায় রপ্তানি এবং শিল্প খাত প্রাধান্য বেশি পেয়েছে।
এমন বহু কৃষক আছেন যাদের ব্যাংকে কোন একাউন্ট নেই, তাঁরা কার্যত এই প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে থাকবেন। তাছাড়া, পরিবহণ ও বাজার ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ায় সারা দেশে চাহিদা ও যোগান ইতোমধ্যে বিশাল ধাক্কা খেয়েছে। এমতাবস্থায়, উৎপাদন সচল রাখতে কৃষকের জন্য ঋণের বদলে সরাসরি সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন ছিল।
করোনাভাইরাস মহামারি পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীদের এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে অসৎ উপায়ে মুনাফা বৃদ্ধির এক সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে। যদি তাঁরা এবারও সফল হন, জনগণের জন্য সামনের দিনগুলোতে করোনাভাইরাসের চেয়েও বিপজ্জনক এক প্রতিপক্ষ অপেক্ষা করছে।
তানজিম উল ইসলাম