নিজেদের উদ্ভাবিত কিট ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে দিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন জানিয়ে রোববার ঢাকার ধানমণ্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “দুর্ভাগ্য হল, এই ঔষধ প্রশাসন এমন লোকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, যারা না ফার্মাসিস্ট, না ফার্মাকোলজিস্ট, না ফিজিশিয়ান ।” । “যার ফলে এই জিনিসের (উদ্ভাবিত কিট) গুরুত্বটা উনারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছেন না। উনারা সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন। তারা পাবলিক স্বার্থের চেয়ে প্রাইভেট ইন্টারেস্ট বেশি করে দেখছে।” বাংলাদেশে নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর শনাক্তকরণ কিট সঙ্কটের বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তা তৈরিতে হাত দেয়, এর নেতৃত্ব দেন গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিটিক্যালসের প্রধান বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল।
ঘুরে ফিরে অনেক প্রশ্নই মনের মাঝে জেগে উঠে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, পড়াশুনার ক্ষেত্র ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং। চিকিৎসা বিজ্ঞান বা গবেষণার কোন পণ্ডিত বা গবেষক নই। এই কিটের ভাল মন্দ কোন কিছুই সম্পর্কে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের কৌতূহল প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক তবে যাচাই করার মত অবস্থা নেই যাদের আছে কাজটি তাদেরই করা উচিত। আমাদের মত সাধারণ মানুষের এখানে আবেগের বসে মন্তব্য করা যুক্তিযুক্ত নয়।
তবে অতীত অভিজ্ঞতার কিছু মতামত দিতে পারি। তার আগে কিছু মানুষের নাম বলে যাই – আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু , ড.কুদরাত-এ-খুদা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, আব্দুস সাত্তার খান, ফজলুর রহমান খান, ডাক্তার শাহ এম ফারুক, ড. মাকসুদুল আলম আজকের দিনে হয়ত দু একটি নাম কারো জানাশোনা থাকতে পারে কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই জানেন না এই গুণী মানুষগুলোর নাম, কীর্তি। প্রয়োজন পড়লে গুগল করে জেনে নিতে পারেন তাদের সম্পর্কে কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিলেন এই গুণীজনেরা।
গত তিন দিন ধরে আমাদের অনেকের ফেসবুক এ আমরা শেয়ার করতে দেখছি “অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুটিবসন্তের টীকা আবিস্কার হয়েছে, ইবোলার টীকাও আবিস্কার হয়েছে। আবিস্কার করেছেন প্রফেসর সারাহ্ গিলবার্ট, করোনার টীকার পরীক্ষামূলক মূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে সারাহ্ গিলবার্টের গবেষণায়।” আর আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কি হয় আমরা জানি! যদি এর পরও কেউ গবেষনা করে কিছু বের করে সেটার ফল ভালোর চাইতে খারাপ হয়! দুধে ভেজাল পাওয়ার পর কি হয়েছিল হয়ত আমরা ভুলে গেছি! এই ত সেদিন গতবছরের কথা ‘পাস্তুরিত দুধে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক, ডিটারজেন্ট ও ফরমালিন পাওয়া গেছে’, গবেষণায় এমনটি প্রমাণিত হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক এবিএম ফারুককে হয়রানি করতে শুরু হয় অ্যাঁতে ঘা লাগা বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের যোগসাযোগে মামলা মকদ্দমার। তৎকালীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ‘নিরাপদ তরল দুধ উৎপাদন’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিন বলেছিলেন – “গবেষণা প্রটোকল না মানায় তার (অধ্যাপক ফারুক) বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নেওয়া হবে।”।
সোনালী ব্যাগের কথা মনে আছে ? বিশ্ব যখন পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারে বদ্ধপরিকর, তখন পাটের সেলুলোজ দিয়ে তৈরি সোনালী ব্যাগ ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় চমক। সোনালী ব্যাগ হলো পাট থেকে উদ্ভাবিত এক ধরনের পলিথিন ব্যাগ। পাট থেকে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনের এই প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান। এটি একটি সেলুলোজ-ভিত্তিক বায়োডিগ্রেডেবল বায়োপ্লাস্টিক, যা প্লাস্টিক ব্যাগের একটি বিকল্প। পাট থেকে এই সেলুলোজকে সংগ্রহ করা হয়, যেখানে পাট হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান আঁশ শস্য। সম্ভাবনাময় সোনালী ব্যাগও হোঁচট খেয়েছিল অনুমোদন আর আর্থিক বরাদ্দ সংকটে।
আমরা দেখেছি কিভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যাকাথন প্রতিযোগিতা নাসার ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে’ অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে প্রথম মূল ক্যাটাগরিতে শীর্ষ চারে জায়গা করে নেওয়ার পর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো শাবির দল ‘সাস্ট অলিক’। ভিসা জটিলতায় তাদের সেই পুরস্কার আনতে যাওয়া হয়নি প্রতিযোগীদের, কিন্তু ধন্যবাদ জানাতে গিয়েছিলেন সরকারী প্রথিনিধিরা! নাসার এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক ভাবে জনপ্রতি ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা করে বাজেট দেয়া হয়েছিল। অগ্রিম এয়ার টিকিট, হোটেল ভাড়া করা হয়েছিল!
বছরের পর বছর ধরে ঢাকা সহ বিভাগীয় শহরগুলো নিয়ে নানা পরিকল্পনা নিতে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, সিঙ্গাপুর প্রমোদ ভ্রমন করেন আমাদের নেতাকর্মী ও সরকারী কর্মকর্তারা। পুকুর খনন, বৃক্ষরোপণ, আলু তোলা, পটল তোলার নামে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় করেন। কিন্তু দেশীয় গবেষকদের কোন মূল্য দেয়া হয় না। শিক্ষা গবেষণায় এই দেশে বিনিয়োগ হয় না, বরাদ্দ পাওয়া যায় না, উৎসাহ পাওয়া যায় না। সারা বিশ্বে যখন প্রতিটি দেশ নিজেদের অবস্থান এগিয়ে নেবার প্রতিযোগিতায় একের পর এক বিজ্ঞান গবেষণায় বরাদ্দ আর বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে আমরা সেখানে সামান্য উৎসাহ পর্যন্ত দিতে পারি না! অথচ নিজেদের বলি ডিজিটাল!
কোভিড-১৯ সনাক্তে র্যাপিড টেস্টিং কিট বেশকিছু দেশে উৎপাদন ও ব্যবহার হচ্ছে তবে এইসব কিট যে ১০০% সঠিক ফল দেয় তা নয়। তবে প্রাথমিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যে কিট তৈরি করেছে তার মধ্যে ত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নয় । আর এটি একটি পরীক্ষা কিট মাত্র কোন ভ্যাক্সিন বা কোভিড-১৯ সংক্রামিত রোগীর শরীরে প্রয়োগের ঔষধ নয় যে যেখানে মানব দেহে পরীক্ষা সহ নানা জটিলতা রয়েছে! আর এই কিট যাচাই বাছাই পরীক্ষা করতেই পারে ঔষধ প্রশাসন , প্রয়োজনে কোন ত্রুটি থাকলে এই মুহূর্তে তাদের উচিত ছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রর পাশে থাকা সর্বাত্মক সহায়তা করা। কারন বিদেশ হতে কিট আমদানি যেমন ব্যয়বহুল তেমনি বর্তমানে সময় সাপেক্ষ, কারন সব দেশই করোনা সংক্রান্ত চিকিৎসা উপাদান সংকটে ভুগছে। আমরা দেখেছি কিট সংকটে পরীক্ষা না হওয়াতে দেশে মোট কোভিড-১৯ সংক্রামিত রোগীর সঠিক সংখ্যাও আমরা জানতে পারছিনা সেই প্রথম থেকে! সেখানে গণস্বাস্থ্যের এই উদ্যোগের পাশে থাকা উচিত ছিল ঔষধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
কিন্তু বাস্তবতা হল আমরা যেখানে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করি বলে সবাইকে গলা ফাটাতে দেখি সেখানে রাজনীতির কুটতত্তে হারিয়ে যেতে চলেছে একটি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা!
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে গতকাল কোন রাখঢাক ছাড়াই কথা বললেন গবেষক দলের সদস্য নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ। সমগ্র দেশ দেখলো কতটা অসহায় হলে একজন গবেষক-শিক্ষক জনসম্মুখে নিজের রাজনৈতিক পরিচয় দিতে বাধ্য হন! তাও কিনা দেশের মানুষের উপকার হয় স্বাশ্রয় হয় এমন কিছু তৈরী করে!
যেকোন কাজে দীর্ঘসূত্রতা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সেই সাথে রাজনৈতীক যোগসূত্র মোটামুটি সব কিছু মিলে গনস্বাস্থ্যের এই কোভিড-১৯ পরীক্ষার র্যাপিড কিট নিয়ে প্রোটোকল আর রাজনীতির দেনাপাওনার হিসেব না করে অন্তত দেশের মানুষের কথা চিন্তা করুন। দেশের মানুষ এর জন্যই তো আপনারা রাজনীতি করেন তাই না? অন্তত কিট নিয়ে রাজনীতি করা থামান মানুষের স্বার্থে। আর উৎসাহ অনুপ্রেরনা দিন দেশের গবেষণায়। যাতে করে এই প্রজন্ম অন্তত বলতে পারে আমাদের দেশেও ভালো কিছু হয়।
আবু রাইহান, মুক্তিফোরাম এর একজন সম্পাদক