২৬ এপ্রিল ২০২০।
লেখক— জায়েদ বিন নাসের
মিরপুর ডিওএইচএস, ঢাকা
(“লেখাটি পুরনো তবে এতটা পুরনো নয় যে আমাদের দায়িত্ববোধ ও ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর এতবড় একটা ভিত্তির নিশ্চুপ থাকাকে ভাবতে পারবে না। লেখাটি এখনো প্রাসঙ্গিক আজকের বিচার বিভাগ ঠিক করছে টা কি তা আমরা এই দুইদিনের দিদারুল, কিশোর সহ আরো অনেকজনের বিরুদ্ধে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলায় ডিজিটাল সিকিউরিটির মামলার মাধ্যমে বুঝতে পারি। তবুও কি আর করা, বলে যাওয়া আরকি। অন্তত আমাদের তো দায়বোধ আছে, এটা থেকে পালাতে পারবো না”— নাঈমুম সাকিব)
ইংরেজি সাল ২০২০। সারা পৃথিবীতে ‘নভেল করোনা’ নামক ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি দেশ বাদে সব দেশেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। সেসব দেশের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে যে সেখানে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেও তথ্য গোপন করা হয়েছে। পৃথিবীতে তেলের দাম শুন্যেরও নিচে নেমে গেছে, এমনকি বিশেষ প্রণোদনা দিয়েও বিক্রেতাদের কাছে তেল বিক্রি করা যাচ্ছে না। বিশ্বের ইতিহাসে এরকম ঘটনা এটিই প্রথম। যেই তেল নিয়ে এতো যুদ্ধ আর ভূ-রাজনীতিতে এতো উত্তেজনা, যেই তেলের জন্য সারা দুনিয়ায় চরম উৎকন্ঠা; অথচ আজ সেই তেলই তেল উৎপাদনকারীদের জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। এমনকি পবিত্র হারাম শরীফ (মক্কা নগরী) ও মসজিদে নববীতেও (মদিনা নগরী) একসাথে সালাত আদায় সীমিত ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে এবং এ রোগে মৃত্যুও ঘটেছে। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মৃত ব্যক্তিদের শহীদের সম্মান দিন- এটাই দু’আ। বাংলাদেশেও বিভিন্ন কাজ-কর্ম স্থগিত ও সাময়িক বন্ধ বা সীমিত রাখা হয়েছে। যাঁরা দিন আনেন দিন খান (নিম্নবিত্ত) এবং মাস আনেন মাস খান (নিম্ন মধ্যবিত্ত) তাঁরা খাদ্য সঙ্কটে পড়েছেন। এই অবস্থায় বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে অনৈতিক সরকার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকায় তারা জনবিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই আছে। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা স্তরে এখন দায়িত্বে থাকা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত না হওয়ায় তাদেরও জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা নেই। অত্যন্ত লজ্জা ও অপমানের বিষয় এই যে শতাব্দীর ভয়াবহ দুর্যোগকালীন সময়েও গরীব জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণসামগ্রী বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও দায়িত্বরত লোকদের চুরি, মজুদ ও কালোবাজারি করার প্রমাণ মিলেছে। অনৈতিক সংসদের অনির্বাচিত সাংসদকে দেখা গিয়েছে এদের কারও দালালী করতে। সাংসদ অবশ্য মূলত ফিরতিটাই দিয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য করোনা মহামারির মধ্যেই ১৮ এপ্রিল সংসদের অধিবেশন বসেছিলো। কিন্তু বিচার বিভাগের এই সময়ে নেই তেমন কোনো ভূমিকা; বরং উচ্চ আদালত, নিম্ন আদালত- সব আদালতের কার্যক্রম বন্ধের সময়সীমা দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। জরুরী প্রয়োজনে প্রতিটি জেলায় কেবল একটি করে ম্যাজিস্ট্রেসি আদালত খোলা রাখার নির্দেশনা জারি হয়েছে। এটা নিম্ন আদালতের অন্তর্ভুক্ত, যা কার্যত আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কিন্তু উচ্চ আদালত এই সঙ্কটে পুরোপুরি নীরব। মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ হলেও প্রতিকারের জায়গা নেই। আদালত বন্ধ থাকায় সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে প্রতিটি মূহুর্তে, প্রতিটি সেকেন্ডে। ত্রাণ চোর, গরীবের অধিকার লুটকারীদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ কারাদণ্ড, কারাগারে পাঠানো বা আটক রাখার বিষয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দরকার ছিলো ‘দ্রুত গতিসম্পন্ন’ বিচার বিভাগ। কিন্তু ব্রিটিশ-পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক আমলের ভাবধারায় পরিচালিত আইন-আদালত দিয়ে তা সম্ভব নয়। আর এভাবেই শতাব্দীর ভয়াবহ সঙ্কট আমাদের বুঝিয়ে দিলো রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের হাল-চাল। এক অঙ্গ সমানে ক্ষমতার প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম; আরেক অঙ্গ যেখানে সবকিছুর উপরে স্থান পাবার কথা সেখানে সে অঙ্গ কার্যত প্রথম অঙ্গের হাতের ইশারাতেই পরিচালিত (এর কারণ ৭২ এর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ এখনো টিকে থাকা। আর তাছাড়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ইতিহাস বলে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান, সরকার প্রধান, সংসদ নেতা একই ব্যক্তি থাকেন।); অন্য একটি অঙ্গের কোনো ধরণের কার্যক্রমের প্রয়োজনও বোধ করে না হর্তা-কর্তারা। বৈশ্বিক মহামারির এই সময়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এক দিনের সংক্ষিপ্ত অধিবেশন বসলেও কার্যত আইনপ্রণেতারা নীরব! বলে রাখা ভালো বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থা ত্রাণের জন্য তহবিল গঠন করলেও এখনো বর্তমান ক্ষমতাসীন মন্ত্রী, আমলা, সাংসদ, বিচারকদের তাদের বেতনের একটি অংশ দিয়ে তহবিল গঠন বা এরকম কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায় নি। তাদের বেতন কর্তনের হিম্মত জনতার নেই অথবা যেহেতু তারা জনতার চাকর সেহেতু দয়া করে জনতা না হয় বেতন নাই কাটলেন। কে জানে হয়তো তাদের তরফে এর চাইতেও মানবিক কোনো কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হতে পারে ভবিষ্যতে। মহামারির সময়, খুব বিপদের সময় দ্রুত গতিসম্পন্ন’ বিচার বিভাগ না থাকায় মাসদার হোসেন মামলার রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শাসন করছে যারা বিচারও করছে তারা। কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার করা অথবা বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ জরুরী। রাষ্ট্রের যে অঙ্গের বিচারিক ক্ষমতা থাকার কথা সে অঙ্গ ঔপনিবেশিক ধারায় পরিচালিত বলে ক্ষমতাটাও নেই আর তাছাড়া সে অঙ্গটি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সংবিধান বাতিল বা স্থগিত এখন সাংবিধানিক অপরাধ। সংবিধান অনুযায়ী দেশে জরুরী অবস্থা জারি ছাড়া আর অন্য কোনো সময়েই মানুষের মৌলিক অধিকার কর্তন করা যায় না। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের মাথায় আঁটে যে জরুরী অবস্থা ছাড়া মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত ও অব্যাহত রাখার জন্য সবসময় সংবিধানের অভিভাবক মৌলিক অধিকার বলবৎ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানেে জনগণের অধিগম্যতা নিশ্চিত করা না গেলে সংবিধানের লঙ্ঘন হয়। আর যে অঙ্গটা দিন-রাত ক্ষমতা দিয়ে শাসন বা শোষণ করে যাচ্ছে সে অঙ্গটাই বিচারিক ক্ষমতার চর্চা করছে সংবিধানের উপর পা রেখে। আর দিন-রাত সার্বক্ষণিক ক্ষমতার চর্চা করা অঙ্গটিও স্বাধীন দেশের উপযোগী ও একাত্তরের মূল্যবোধের আলোকে প্রশাসন কাঠামো গড়ে না তোলায় এবং ঔপনিবেশবাদের সিনসিলা অব্যাহত রাখায় ঠিকঠাক বিচারটা পাওয়া যাচ্ছে না। আদালতটা সীমিত আকারে খোলা রাখলে কী অনেক বেশী ক্ষতি হয়ে যেতো কারো? কে জানে। নভেল করোনা ভাইরাসের বদৌলতে আমাদের বিবেক জাগ্রত হউক- আল্লাহ্ তা’য়ালার কাছে এই দু’আর দরখাস্ত। এখন যদি না বুঝি যে এমন একটা বিচার বিভাগের দরকার যেটা সর্ব্বোচ্চ সঙ্কটকালেও সকলের উপরে প্রাধান্যপ্রাপ্ত জনগণের আশ্রয় হিসেবে সদ্ব্যবহার করা যায়, তবে মনে হয় না কিয়ামত পর্যন্ত আর আমাদের বুঝার ক্ষমতা হবে। পরিশেষে স্রষ্টার কাছে অসহায়ের নিবেদন এই যে স্রষ্টা আমাদের স্বাধীনতা বুঝার এবং উপভোগ করার ক্ষমতা দিন