গণঅভ্যুত্থান,জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার-এর যেকোন একটিকে সামনে রেখে আগাতে হবে
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একধরণের পরিবর্তনের পূর্বাবস্থা তৈরি হয়েছে। এই বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা আর বেশিদিন জারি থাকতে পারবে না। সকল রাজনৈতিক দলের মাঝে আন্দোলনের একধরণের বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। আগামী এক বছরের মাঝে যেকোন ধরণের বর আন্দোলন গড়ে ওঠার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
২০১৮ সালের শেষ অর্ধেকে এরকম আরেকটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে। কিন্তু সেটা ভেঙ্গে গিয়ে আওয়ামী লীগের অধীন জোটে চলে যায় আর বিএনপির সাথে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। তবে সেটার সাথে বর্তমান অবস্থার একটা বিশেষ পার্থক্য আছে বলে মনে করি। পার্থক্যটার মূল অংশ দুইটি। প্রথমত, যুক্তফ্রন্ট বা ঐক্যফ্রন্ট লক্ষ্যগত দিকথেকেই একটা রাজনৈতিক জোট ছিলো। এটা কোন আন্দলনের জোট ছিলো বা তাদের মধ্যে আন্দোলন করার শক্তি বা জোশ ছিলো তা বলা যাবে না। তাদের লক্ষ্যই ছিলো সংসদের আসন বাগিয়ে নেয়া্ এবং সেটা করবার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায়টাই তারা বেছে নিয়েছে বড় দুইদলের সাথে ভিড়ে গিয়ে।
দ্বিতীয়ত, সেইসময়ের জোটগুলো করা হয়েছিলো খুব তড়িঘড়ি করে, নির্বাচনকে সামনে রেখে, নির্বাচনকে উদ্দেশ্য করে। কাজেই সেটাকে নির্বাচনী ইনসেন্টিভ দিয়ে বড় দুই দল সহজেই ভেঙ্গে ফেলতে পেরেছে।আসনের লোভে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ভেঙ্গে গেছে।
এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। মানুষ এখন আওয়ামী জাহেলিয়াতের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তারা আসলেই একটা পরিবর্তন চায়। দ্রব্যমূল্য, জ্বালানী তেলের দাম, লোডশেডিং–ইত্যাদি মিলায়ে রাজনীতিতে একটা দমবন্ধকরা অবস্থার তৈরি হয়েছে। সাধারণ জনগণের মাঝে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি পরিবর্তনের কিছু মৌলিক পূর্বশর্তও পূর্ণ হয়েছে। এরকম অবস্থায় আওয়ামী লীগ চাইলেই নির্বাচনী যেকোন জোটকে ভেঙ্গে দিতে পারবে না কারণ সুষ্ঠু নির্বাচনে এই নতুন রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য তৈরি হলে সেটা আসলেই আওয়ামী লীগের একটা বিকল্প হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাজনৈতিক বিকল্পহীনতার পরিস্থিতিকে আমরা অনেকটাই পার হয়ে এসেছি। নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মাঝে থেকে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করবার মতন ফিগার তৈরি হয়েছে। ২০১৮ এর ঐক্যফ্রন্টে কেবল কামাল হোসেন সাহেব ছাড়া তেমন নেতৃত্ব দেবার মতন কেউ ছিলেন না। তিনিও ছিলেন বয়োবৃদ্ধ এবং একটি ভিডিও ছাড়া তেমনভাবে শক্তিশালী প্রচারণা বা রাজনপথে শক্তি প্রদর্শনের কাজটা তারা করতে পারেনাই।
তার তুলনায় যদি আমরা বর্তমান রাজনৈতিক আবহাওয়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখবো ছোট দলগুলোও শত থেকে হাজার মানুষ নিয়ে মিছিল দিচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক দল গণঅধিকারের মিছিলে হাজার মানুষ আর বিএনপির র্যা লিতে লক্ষ মানুষের সমাগম হচ্ছে। এদের সবাইকে কি বিরিয়ানী খাইয়ে আনা হচ্ছে? অবস্থা সেরকম আসলে নয়। সাধারণ মানুষই অতিষ্ঠ হয়ে তাদের কাতারে যোগ দিচ্ছে।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বর্তমান আন্দোলনের অভিমুখ। আঠারো সালের জোটের রাজনৈতিক অভিমুখ ছিলো ছয় মাসের মাথায় নির্বাচন করে সংসদের আসন জিতে পাশার দান উলটে দেয়া, যেটা অনেকটা কঠিন–কেননা নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকে আওয়ামী লীগের হাতে। অপরদিকে, বর্তমান বিরোধী শক্তির রাজনৈতিক অভিমুখ নির্বাচন থেকে পরিবর্তিত হয়ে গণআন্দোলনের অভিমুখে রূপ নিয়েছে। যে বামদলগুলো দীর্ঘদিন বিএনপিকে অচ্ছুৎ মনে করেছে, তারাও এখন আন্দোলনের স্বার্থে তাদের সাথে সংলাপ করছে। এর থেকে মনে হয় যে যুগপৎ যে আন্দোলনের কথা আমরা শুনে আসছি, তা আদৌ পুরোপুরি অসম্ভব নয়। নির্বাচনী জোটের কথা আসলে আসন ভাগাভাগির যে জটিলতা তৈরি হয়, আন্দোলনের জোটে সেই জটিলতা থাকেনা। কাজেই এক ধরণের কাজের বোঝাপড়ায় আসা সহজতর হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা ঠিক এখানে। আন্দোলনই ভবিষ্যত, আন্দোলনই একমাত্র রাস্তা। নির্বাচনে গিয়ে এই সরকারের অধীনে এই সরকার উলটে দেয়া যাবে, এই অর্বাচীন চিন্তা থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরে এসেছে। এমনই সরকারী জোটের দলগুলোর সাথেও আওয়ামী লীগের দূরত্ব তৈরি হয়েহে। আওয়ামী লীগের এতোই অহমিকা হয়েছে যে তারা শরিকদেরও দূরে ঠেলে দিতে বা বিরোধী শক্তিতে ঠেলে দিতে দ্বিধা করছেনা। এর থেকে বিরোধী শক্তিতে আওয়ামী শরিকদের চলে আসার ব্যাপারটাও সম্পূর্ণ অকল্পনীয় কোন ব্যাপার নয়।
অবস্থার যদি পরিবর্তন না আসে, মূলত দ্রব্যমূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, বেকার সমস্যা, বিদ্যুৎ সংকট এবং আওয়ামী লীগের ইমেজ সংকট ইত্যাদি যদি সরকার সফলভাবে সমাধা করতে না পারে–তবে এক ধরণের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে আওয়ামী লীগকে আগাতে হবে। একচেটিয়াভভাবে ক্ষমতায় টিকে থেকে বিরোধীদের পিষে ফেলে সে আর বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। তাকে বিরোধীদেরকে কিছু একটা দিতেই হবে। এক ধরণের পাওয়ার শেয়ারিং বা ক্ষমতা ভাগাভাগির পরিস্থিতির দিকে তাদের যেতে হবে। সেটার একটা মডেল উঠে এসেছে, যেটা হলো জাতীয় সরকার। এই জাতীয় সরকারে আওয়ামী লীগ থাকতে চাইবে এবং নিজেদের আধিপত্য বজায়ে রেখে বিরোধীদের কিছুটা অংশগ্রহণ দিয়ে তাদেরকে ঠান্ডা করবার চেষ্টা করবে। এর অধীনে নতুন নির্বাচন হতে পারে। এবং নিজেদের আধিপত্যের গুনে আওয়ামী লীগ তাতে জয়ীও হতে পারে।
তার বাইরে দ্বিতীয় সমাধান হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত আনা। এটি আওয়ামী লীগে জন্য সবচেয়ে অসুবিধাজনক সমাধান। কারণ নির্দলীয় “নিরপেক্ষ” তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরাজয় অকল্পনীয় নয়। আর এইকারণেই এ সমাধানটি হবে বিরোধী দলের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয়। যদি তারা একটা শক্ত গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, তবে এই পথটিই হবে তাদের জন্য সবচেয়ে পছন্দনীয়।
আর তৃতীয় রাস্তাটি সবচেয়ে প্রলয়ঙ্কারী এবং বিরোধী দলের জন্য সবচেয়ে কঠিন এবং একই সাথে সুবিধাজনক। সেটি হলো একটি সর্বাত্মক গণআন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে গদি থেকে হঠানো। এটি করতে পারলে নতুন অনির্বাচিত বা নির্বাচিত সরকারে আওয়ামী লীগ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়তে পারে কারণ আন্দোলন সর্বাত্মক গণআন্দোলনের দিকে গেলে তাদের জনুসমর্থন শূণ্যের দিকে ধাবমান হবে। এই পরিস্থিতিটি বিরোধী দলের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো হলেও এটি এখনও পর্যন্ত কিছুটা অবান্তর। যদি বিরোধী শক্তি প্রচুর পরিমানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নাগরিক সমর্থন পেতে পারে, তবেই কেবল এই পরিস্থিতি সম্ভব, নচেৎ নয়। সেটি পেতে গেলে তাদের অনেক কাজই এখনও বাকি রয়ে গেছে। নিজেদের সমর্থকদের বাইরেও সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে নামানোর কঠিক কাজটা তাদের তখন করতে হবে।
অতএব তিন ধরণের রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে আমরা ধাবমান এবং তিনটিই বিভিন্নভাবে সংঘর্ষপূর্ন হলেও তিনটিই আমাদের গণতন্ত্রের জন্য এক ধরণের সুসংবাদ বয়ে আনতে পারে। হতে পারে নতুন সরকার এলে সেটিও আওয়ামী সরকারের মতন হয়ে উঠবে, তবে ব্যবস্থা বদল, সংবিধান সংস্কার ইত্যাদি যেসব আলাপ কিছু বিরোধী শিবির থেকে উঠছে, তা যদি বাস্তবায়িত হয় তবে গণতন্ত্রায়নের পথটি অনেকটাই সুগম হবে বলে মনে করি। যে পরিস্থিতিতে আমরা বসবাস করছি তাতে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কারের কোন বিকল্প নেই এবং এই সংস্কারের আলাপটিকে সরকার বদলের আলাপের মতই কেন্দ্রস্থিত করতে হবে। তা না হলে নব্বইয়ের আন্দোলনের মতন আরেকটি বেহাত বিপ্লবের সম্ভাবনা রয়ে যাবে।
কাজেই এই তিন ধরণের বাস্তবতাকে সামনে রেখে বিরোধী শক্তিকে আগাতে হবে। কোন পথটি তাদের জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও সুবিধাজনক হবে তা তাদের বিবেচনায় আনতে হবে। যদি গণঅভ্যুত্থানই তাদের লক্ষ্য হয় তবে তাদের জাতীয় সরকার ও তত্ত্ববধায়ক সরকারের আলাপ কমিয়ে আনতে হবে। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে থাকে তবে সেটিকেই মধ্যস্থিত করে আগাতে হবে,যদিও এই সমাধানটি একটু পুরোনো ও ব্যর্থ রাজনৈতিক আন্দোলনের আভাস দেয় বলে এটি সাধারণ জনগণের কাছে ততটা আকর্ষনীয় নাও হতে পারে। যদি আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করাই তাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে সেই বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নিয়ে তাদের বাস্তবসম্মত আক্রমণ করতে হবে যেন তেমন একটি পাওয়ার শেয়ারিং ব্যবস্থায় তারা এমন একটা অবস্থানে থাকে যে আওয়ামী লীগ তাদের কোনঠাসা করতে না পারে। আর যদি আওয়ামী লীগকে বাদেই জাতীয় সরকার করতে হয়, তবে আবার প্রথম পথ তথা গণঅভ্যুত্থানের রাস্তা ধরে তাদেরকে উৎখাত করতে হবে। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনতে হয়, তাহলেও গণঅভ্যুত্থানই লাগবে কারণ গনঅভ্যুত্থান ব্যতীয় অন্য কোন রাস্তায় আওয়ামী লীগকে দিয়ে সংবিধান সংস্কার করিয়ে সেই ব্যবস্থাকে ফেরত আনা দুস্কর। যদি আওয়ামী লীগ ব্যতীত গণঅভ্যুত্থান নির্মিত জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের রাস্তায় যেতে হয়, তবে জনসম্পৃক্ততাকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
সামনের বছরটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সংঘর্ষমূলক হতে পারে। হতে পারে সেটি একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রসবকালীন সময়। আবার আওয়ামী লীগের সুকৌশলে সেটি ভেস্তেও যেতে পারে আঠারো সালের মতন। তেমন যাতে না হয় সেজন্য বিরোধী শক্তিকে সতর্ক হতে হবে।
অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিফোরামের একজন সম্পাদক