ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমার জীবনের প্রায় একটি বছর ঘরে বসে কেটেছে। ২০০৫ এ ঢুকেছিলাম ছাত্র হিসেবে; এরপর নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। অনেকদিন ঘরে বসে থেকে ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু হওয়ার পরও খাপ খাওয়ানো অনেক কঠিন হয়ে যেতো। এর মধ্যে আবার ছাত্র রাজনীতির এইসব তাণ্ডবের বিরুদ্ধে কিছু বলা যেতো না, বিপদের আশংকা থাকতো। ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশে ছাত্ররা জীবনের মূল্যবান অনেকগুলো বছর সেশনজটে নষ্ট করেছে। এতে আয় বৈষম্য বেড়েছে; অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং খাবারে ছাত্রদের পরবর্তী জীবনের বুনিয়াদও নষ্ট করা হয়েছে। অথচ এ নিয়ে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ সম্পূর্ণই নিশ্চুপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে দেশের বাইরে পড়তে এসে দেখলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। ক্যাম্পাসে ছাত্ররা অধিকার সম্পর্কে সচেতন, সারা বিশ্বের খবর রাখছে, তর্ক করছে। এত রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করলেও ক্যাম্পাসে রাজনীতির নাম মাত্র নেই। ছাত্ররা করছে যা ছাত্রদের করা উচিত -পড়াশোনা, নিজেকে তৈরি করা। শিক্ষকেরা করছেন যা তাদের করা উচিত – গবেষণা, শিক্ষকতা। এর অনেক আলোচনাই রাজনীতি কেন্দ্রিক হলেও গুণ্ডামির কোনো স্থান নেই। সিস্টেম চলছে একটা সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে যা কোনভাবেই কাউকেই অসচেতন করছে না নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে। বাংলাদেশের সাথে বহির্বিশ্বের শিক্ষা ব্যাবস্থার তফাতের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে ক্যাম্পাসে শিক্ষক এবং ছাত্রের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। বৃহৎ জায়গায় আবরার খুনের মত নৃশংস ঘটনা এবং নিত্যমৈমিত্তিক আকারে বছরের পর বছর রাজনৈতিক কর্মীদের সিট নষ্ট করা – সবই এর মধ্যে পড়বে।
আর্টিকেলের শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, আমি ক্যাম্পাসে ছাত্র এবং শিক্ষকের দলীয় রাজনীতি, বাম-ডান-মধ্য, এর বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক সচেতনতার জন্য দলীয় রাজনীতির দরকার নেই। এবং, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়ে মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় নিজের সিট ধরে রেখে বছরের পর বছর সময় নষ্ট করাকে রীতিমত অপরাধ হিসেবে দেখা প্রয়োজন বলে আমার বিশ্বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিটের পেছনে ট্যাক্সদাতা মানুষের অনেক টাকা বরাদ্দ থাকে, সেই সিট “রাজনীতি”র নামে নষ্ট করা গ্রহণযোগ্য না। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে মোটামুটিভাবে প্রথম থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠানকেই রাজনৈতিক আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকতে দেখা যায়। ক্যাম্পাসে এই রাজনৈতিক আন্দোলন আমরা ৪৭-পূর্ব ভারত থেকেই পেয়েছি।
তখনকার বাস্তবতায় কলোনিয়াল শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এর পর ৪৭ এর পরেই বাংলা ভাষা আন্দোলন ছাত্রদের আবার টেনে নিয়ে যায়। তবে ৬৯, ৭১, ৯০ পেরোনোর পর গত ত্রিশ বছরে ছাত্র রাজনীতি আমাদের ছাত্রদের এবং সমাজের কি উপকারে আসছে, পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে। ছাত্র রাজনীতির টিকে থাকার পেছনে আমার অভিজ্ঞতায় কয়েকটি কারণ আছে। এক) সিনিয়র নেতাদের অত্যধিক ক্ষমতা। ২) কালচারাল কাজে সংশ্লিষ্ট না থাকা, ৩) হলের অব্যবস্থাপনা, এবং ৪) ক্যারিয়ারের প্রয়োজনীয় নেটওইয়ার্কিং না থাকা। একটি ১৮ – ১৯ বছরের শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, তার দরকার হয় গাইডেন্স, উৎসাহ, যে কোনো ক্লাস করার সামর্থ্য, লার্নিং – পড়াশোনার জন্য পরিবেশ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটাদাগে এগুলো নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান চর্চা দিয়ে ছাত্রদের আটকে রাখবে এই পরিবেশটাই নেই। তার উপর “ভর্তি করেছেন যিনি পাশ করাবেন তিনি” নীতিতে আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থার অজস্র খারাপ দিক আছে। যেমন, আমি যে শত শত পরীক্ষা দিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মিডটার্মের খাতার মুখও কোনোদিন দেখি নি।
একটি ছাত্রকে আপনি তার খাতা ফেরত না দিলে সে জানবে কিভাবে তার ভুলগুলো? আবার, যেখানে শিক্ষক- ছাত্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বলতে কিছুই নেই, জানার জন্য রিসোর্স নেই, লাইব্রেরি নেই, ডিপার্টমেন্টে সেমিনার নেই; এত নেই নেই এর মধ্যে ঘাড় গুজে কয়েকজন পড়ার অভ্যাসের জন্যই পড়তে থাকে। আর বাকিদের হয় হতে হয় লক্ষ্যহীন। এই লক্ষ্যহীন তরুণদেরই চুম্বকের মত টানে রাজনৈতিক দলগুলো। আমার মতে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি অক্ষমতা ছাত্র রাজনীতি টিকিয়ে রাখছে। প্রথমতঃ ছাত্রদের আবাসিক এবং ভৌত অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা। গণরুমের নোংরামি নিয়ে সবসময় কথা হয় কিন্তু মেটানোর কথা শোনা যায় না। যতজন ছাত্র রাখা সম্ভব তার বাইরে ভর্তি করার বদঅভ্যাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বের হতে পারে না। ছাত্রদের ডিমান্ড – সাপ্লাই এর এই ভিন্নতাটা ছাত্র রাজনীতি ব্যবহার করে। দ্বিতীয়তঃ ইনটেলেকচুয়াল কিউরিওসিটি – ছাত্রদের প্রয়োজন প্যাশনের সাথে কিছুতে লেগে থাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সট্রা কারিকুলার কাজের সংখ্যা নগণ্য, প্রচণ্ড অব্যবস্থাপনা এবং তার উপর নেই ডিপার্ট্মেন্টাল সেমিনার যার মাধ্যমে ছাত্ররা বেড়ে উঠতে পারবে। রেগুলার সেমিনার, কনফারেন্স আয়োজন করলে অনেক ছাত্রই বাইরে নিজের জন্য রিসোর্স খুঁজতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করতো না। তৃতীয়ত: ছাত্রদের দরকার একটা টার্গেট – কিছু করার তাগিদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা রাজনীতি করছে, এই ছাত্ররা কোন বিভাগে পড়ছে – এগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে জব মার্কেটে ভ্যালু কম এমন বিষয় থেকে আসা ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতির টান বেশি। কারণ আমাদের অনেক ছাত্রদের সামনে কিভাবে কি করবে তার নির্দেশনা নেই। ক্যারিয়ার ফেয়ার বলতে কিছু নেই ক্যাম্পাসে, গাইডেন্স নেই। এই তিনটি ব্যাপারকে বিশ্ববিদ্যালয় যদি ইন্টারনালাইজ করতে পারে, তাহলে কার্যত ছাত্রদের কাছে দলীয় রাজনীতি করার দরকার পড়বে না। এর মধ্যে স্টেপগুলো হোলোঃ ১) যত ছাত্র নেওয়া হয়েছে তাদের জন্য আবাসিক, স্বাস্থ্য, খাদ্য সমস্যার সমাধান।
বাংলাদেশে এখন যত বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তার প্রেক্ষিতে এই কাজ অসম্ভব নয়। ২) বিভিন্ন ক্লাব, বিতর্ক এইগুলোতে জোর দেওয়া। ভলান্টিয়ারিং কাজ থাকা যাতে ছাত্ররা নিজেদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাকে তৈরি করতে পারে। ৩) প্রতিটি বিভাগে এবং ফ্যাকাল্টিতে রেগুলার সেমিনার, কনফারেন্স আয়োজন করা।৪) ক্যারিয়ার নির্দেশনা থাকার দরকার প্রথম থেকেই। ক্যারিয়ার ফেয়ার হতে পারে একটি সুন্দর সমাধান। কোনও ছাত্র বছর গ্যাপ দিলে তাকে মেন্টরিং করানো, নিয়মিত ছাত্রদের খোঁজ নেয়ার জন্য এডভাইজিং কমিটি রাখা। এর বাইরে আরেকটি যা প্রয়োজন তা হোল ছাত্রদের নিজস্ব ইউনিয়ন থাকা যা দলীয় রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হবে না। লেবার ইউনিয়নের আদলে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য উন্নত বিশ্বে আছে স্টুডেন্ট কাউন্সিল। ছাত্রদের যে কোনো অসুবিধার প্রেক্ষিতে কাউন্সিল এডমিনিস্ট্রেশনের সাথে ডিল করে। এমন একটি কাঠামো থাকলে ছাত্রদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে। আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি আইন করে বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে হয় না। ভাংচুর করে সেই আইন বাতিল করা হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি, কলেজগুলো নিজেরা পদক্ষেপ নিলে ছাত্ররা চটকদার রাজনৈতিক হাতছানি উপেক্ষা করতে পারবে। পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে ছাত্ররা ছাত্রদের যা কর্তব্য তাতেই মন দিতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।
অপর্ণা হাওলাদার যুক্ত্ররাষ্ট্রের চ্যাথাম ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষক