‘ইতিহাস সাক্ষী, কোন দেশের জনসাধারণ কোন কালেই ভুল করেনি। যারা বলেন যে, নিরক্ষরতা বা অজ্ঞতার জন্য জনসাধারণ ভুল করতে পারে, সুতরাং জনসাধারণের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না, তাদের সঙ্গে জনসাধারণের কোন পরিচয় নেই। সমবেতভাবে জনসাধারণ যদি ভুলই করত, তবে তারা পাকিস্তান আনতে পারত না। পূর্ব বাংলার বিগত সাধারণ নির্বাচনে জনতা যে অপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছে, তার তুলনা নেই।’
কাগমারী সম্মেলনের ভাষণেই মওলানা এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই উক্তি দিয়ে নুরুল কবির তাঁর ‘রেড মওলানা’ বইটা শুরু করেছিলেন এবং ধাপে ধাপে মওলানা ভাসানীর ‘এভার অপোজিশনাল’ চেতনার স্বরূপ উদঘাটন করেছিলেন। উপরের কথাটার মধ্যেই ভাসানীর রাজনৈতিক চেতনার একটা সংক্ষিপ্তরূপের সন্ধান পাওয়া যায়; এমনকি যদি বলি যে, ভাসানীর চেতনার ভিত্তিমূলের পরিচয়ও পাওয়া যায় তাতেও মনে হয় না খুব একটা বড়ো ভুল হবে। তাঁর রাজনীতির ভরকেন্দ্রই হচ্ছে জনসাধারণ। তাদের উপর তাঁর পূর্ণ আস্থা রয়েছে এবং তাঁর রাজনীতির মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছে সেই আস্থা। জনসাধারণ অজ্ঞ ও নিরক্ষর হলেও, তাদের উপর আস্থা রাখাটাকেই ভাসানী যৌক্তিক মনে করেন। এবং যেসব নেতা ভাবেন জনসাধারণ ভুল করতে পারে, তাদের তিনি কটাক্ষ করেন। জনগণ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন মনে করেন। সমবেতভাবে জনসাধারণ ভুল করে না – এই উক্তি গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতি তাঁর আস্থারও বহিঃপ্রকাশ।
মওলানা ভাসানীর এই উক্তি কিছুদিন পূর্বে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করেছিলাম; লক্ষ করলাম যে বন্ধু এবং বড়ভাইদের অনেকেই এই উক্তির বিরোধিতা করছেন; তাদের বিরোধিতার জায়গা হচ্ছে মূলত দুটো। এক, সমবেত জনসাধারণের ভুল করা বা না করা প্রসঙ্গে এবং দুই, জনসাধারণের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা প্রসঙ্গে। তাই, কারো কারো মন্তব্য হচ্ছে, ভাসানীর এই কথা শুনতে শ্রুতিমধুর হলেও এতে কোনো বাস্তবতা নেই এবং এটা একেবারেই ফালতু কথা। মূলত, ভাসানীর উক্তির বিপরীতে আমার বন্ধুদের প্রদত্ত মতামতের প্রেক্ষিতেই একটু আলাপের দরকার আছে বলে মনে হলো। তাই ছোটখাটো আলাপটা যতটা ভাসানীকে নিয়ে তাঁর চেয়ে বেশি ভাসানীর ঐ বিশেষ ‘উক্তি’কে নিয়েই। অবশ্যই আমার কথা শেষ কথা না, আমার যুক্তির বিপরীতেও যুক্তি থাকতে পারে। আলোচনার পূর্বে এটা স্মরণ করে নেয়া মঙ্গলজনক যে, আমরা যে সময়ে বসবাস করছি, সেখানে ব্যক্তি বা জনসাধারণ বা আমজনতাকে ক্রিমিনালাইজ করার প্রবণতা খুব স্বাভাবিক একটা প্রবণতা হিসেবে হাজির হয়েছে। তা ডানপন্থী রাজনীতি হোক, বা প্রচলিত বামপন্থী রাজনীতি হোক দুই পন্থার রাজনীতিতেই এই প্রবণতা স্পষ্ট।
পূর্বেই বলেছি, আমার মনে হয় বা হচ্ছে, উপরোক্ত উক্তির মূল বিষয় হচ্ছে ‘জনগণের উপর পূর্ণ আস্থা রাখা’। দেশের সমবেত জনসাধারণ ভুল করতে পারেনা – এমন সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে তাঁর উক্তির মধ্যেই মওলানা সাহেব দুটো প্রমাণ হাজির করেছেন। এক, পাকিস্তান আন্দোলন এবং দুই, যুক্তফ্রন্টের সাধারণ নির্বাচন। তিনি বলেন, ‘সমবেতভাবে জনসাধারণ যদি ভুলই করত, তবে তারা পাকিস্তান আনতে পারত না। পূর্ব বাংলার বিগত সাধারণ নির্বাচনে জনতা যে অপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণ দিয়েছে, তার তুলনা নেই।’ সমবেতভাবে নেয়া এই সিদ্ধান্তসমূহকে কি ভুল বলা যায়? এমনকি ব্রিটিশ আমলেও জনসাধারণ – যারা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে ‘অজ্ঞ’ ও ‘অশিক্ষিত’ হিসেবে পরিচিত – ক্রমাগত আন্দোলন করেছে, প্রতিরোধ প্রতিবাদ করে গিয়েছে। সমবেত জনসাধারণের এই সিদ্ধান্তসমূহকে কি কোনোভাবে খারিজ করা সম্ভব? যে দেশের মানুষ সমবেতভাবে আন্দোলন করে পাকিস্তান স্বপ্ন সত্যি করলো সেই মানুষই আবার পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী দলকে কয়েকবছরের মধ্যেই অস্বীকার করলো। আবার, যে পাকিস্তানের জন্যে লড়লো, মাত্র ২৫ বছরের মাথায় সেই পাকিস্তানকেই ভেঙে বাংলাদেশ তৈরি করলো। তাহলে কি জনসাধারণের পাকিস্তান আন্দোলন ভুল ছিল? দেশের জনসাধারণের এই যে সিদ্ধান্ত নেয়া বা সিদ্ধান্তের পরিবর্তন তার গোঁড়া সমাজের পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক জমিনে প্রথিত থাকে। একাত্তরে দাড়িয়ে কি এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব যে, পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেয়া জনসাধারণের ভুল ছিল? এই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখে পড়েছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ। নিজেই নিজেকে এই প্রশ্ন করেছিলেন। কামরুদ্দিন আহমদ যেমন পাকিস্তান আন্দোলনের সাক্ষী তেমনি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনেরও সাক্ষী। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানের হাতে বন্দি তখন নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, তবে কি পাকিস্তান আন্দোলন ভুল ছিল? তাঁর সিদ্ধান্ত হচ্ছে এটা ভুল সঠিকের বিষয় না। ইতিহাসের প্রয়োজনে পাকিস্তান এসেছিল, ইতিহাসের প্রয়োজনেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ছেন। কামরুদ্দিন আহমদ যাকে ‘ইতিহাসের প্রয়োজন’ বলছেন, তাকেই আমরা বলছি ‘সময়ের প্রয়োজন’।
তাহলে কি সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সঠিকতার মানদণ্ড? না তাও না। গণতন্ত্রকে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতার মাপে বোঝা বিপদের। গণতন্ত্র যতটা না সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতার প্রশ্ন তাঁর চেয়ে বেশি ভিন্নমতকে আমার মতের পাশে জায়গা দেয়ার প্রশ্ন, ভিন্নমতকে আমার মতের মতো স্পষ্টভাবে বলতে দেয়ার চর্চা। গণতন্ত্র শুধু কোনো ঘটনা না, বরং প্রসেস। এটাকে চর্চা করতে হয়, প্রতিটা জমিনে, প্রতিটা ক্ষেত্রে। এর নিয়মিত চর্চা ভুলের চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্মই বেশি দেয়। রাষ্ট্রীয় পরিসরে গণতন্ত্র চর্চার সবচেয়ে বড় জায়গা হচ্ছে সংসদ, বা পার্লামেন্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ ধারা সেই গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যক্ষ করি কদাচিৎ। যার ফলে আমাদের রাষ্ট্রীয়-জীবনে গণতন্ত্র ‘চর্চা’র বিষয় হয়ে উঠতে পারে নাই, বরং হয়েছে ‘ঘটনা’মাত্র। কিছুকিছু নির্দিষ্ট দিনে সেটা ঘটে থাকে। তাই, ‘জনগণের উপর ভরসা রাখা’ এবং ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সঠিকতার মানদণ্ড নয়’ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
এখানে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মওলানা সাহেবের যে চিন্তপ্রবণতা – জনগণের উপর আস্থা রাখা – তাঁর বিরুদ্ধচিন্তাপ্রবণতা বরঞ্চ আরো ভয়াবহ এবং ক্ষতিকর। অশিক্ষিত ও অজ্ঞ জনগণ যেহেতু ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাই তাদেরকে সঠিক পথে রাখতে তাদেরকে শাসনের বিকল্প নেই। তাদের যেহেতু যোগ্যতা নেই, এবং যেহেতু আমরা শিক্ষিত [এলিট] সেহেতু তাদের উচিৎ আমাদের কথা শোনা। আমাদেরও উচিৎ তাদের শাসন করা। তাদেরকে শাসন করবো, তাদেরই মঙ্গলের জন্যে, তাদেরই ভালোর জন্যে। একদিকে এই চিন্তাধারা উপনিবেশিক; অন্যদিকে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই চিন্তাপ্রবণতাই ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়, ফ্যাসিবাদের সহযোগী করে তোলে, ফ্যাসিবাদের সরব/নীরব সমর্থক করে তোলে। এখানেই তাই চলে আসে ভাসানীর উক্তিটার দ্বিতীয় প্রসঙ্গ – সমবেতের ভুল করার ‘ভয়’!
‘ভুল করার’ ভয় যদি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় তাহলে আমাদের যাবতীয় স্বাধীনতাই হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এখানে আমি আমার কথা না বলা তিনজন মহান ব্যক্তির উক্তি দিয়েই এই আলাপের ইতি টানবো। মহামতি লেনিন নাকি বলেছেন যে, ভুল করার সুযোগের নামই স্বাধীনতা। এবং, যে ভুল করে না সে আসলে কিছুই করে না। আবার, মহান আত্মা গান্ধীজীও বলেছেন যে, তিনি ভুল করার স্বাধীনতা চান, ভুল শোধরানোর স্বাধীনতা চান, ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্বাধীনতা চান, হোঁচট খেয়ে পড়ারও স্বাধীনতা চান। অর্থাৎ স্বাধীনতা মানে ভুল করার স্বাধীনতাও। এখানে সবচেয়ে দুর্দান্ত বক্তব্য দিয়েছেন রোজা লুক্সেমবার্গ। তিনি বলছেন যে, ‘সবচেয়ে চালাক একটি কেন্দ্রীয় কমিটির অভ্রান্ততার তুলনায় সত্যিকারের একটি বৈপ্লবিক আন্দোলনের করা ভুলভ্রান্তি সীমাহীন রকমের অধিক কাজের।’
দোহাই ১) কাগমারী সম্মেলন - সৈয়দ আবুল মকসুদ ২) বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ - কামরুদ্দিন আহমদ ৩) নয়া মানবতাবাদ ও নৈরাজ্য - সেলিম রেজা নিউটন