রাষ্ট্রের আজ ভীষণ অসুখ, তরুণেরা ভাল নেই। “উন্নয়নের মহাসড়কে” করে আমরা নাকি এখন মধ্যম আয়ের দেশ, অথচ তরুণদের ভবিষ্যতের রাস্তাটি এখনো খানা-খন্দে ভরপুর। প্রতি বছর জিডিপি বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উন্নয়নের বুলি আওড়ানো। কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না, বেকারত্ব দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এই উন্নয়নের দেশে, সাবমেরিন আর স্যাটেলাইট এর দেশে তরুণেরা ভাল নেই।

আমাদের দেশে যুব বেকারত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে। জনসংখ্যার ক্রম বর্ধমান বৃদ্ধির কারণে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে প্রতি বছরই শ্রম বাজারে এক বিশাল অংশ প্রবেশ করছে, যাদের অধিকাংশই চাকুরি না পেয়ে বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত লাখ। এভাবে প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা দাড়িয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৮৫ লক্ষ। এক সময় আমরা পড়তাম, “লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে”। কিন্তু এ কথা এখন আর সত্য নয়। আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষিত লোকেদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সর্বাধিক। আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষ এবং উচ্চ শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে প্রতি ৩ জনে একজন বেকার। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ ডিগ্রিধারী লোক বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত বেকার আছেন কেবল আফগানিস্তানে, ৬৫ শতাংশ। এর বাইরে ভারতে এর হার ৩৩ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশের বেশি, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

বিশ্ব শ্রম সংস্থার এক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-উদ্যোক্তা সমাজের ৭৫ শতাংশ বলেছেন, তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ লোক পায় না, যার ফলে ভারত, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। প্রশ্ন থেকে যায়, আমাদের দেশের সরকার ও শিল্প উদ্যোক্তাদের দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য কোন পরিকল্পনা ও উদ্যোগ রয়েছে কি? দক্ষ জনশক্তির জন্য প্রয়োজন হচ্ছে গুণগত মান সম্পন্ন শিক্ষা। রাষ্ট্র পরিচালকেরা কি সকলের জন্য মান সম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন? বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর তথ্য মতে, ২০১৬ সালে ৩৮.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়েই ঝরে পড়েছে। এই ঝরে পড়া স্বল্প শিক্ষিত জনসংখ্যার শ্রম বাজারে অবস্থান কোথায়? পোশাক শিল্পের সস্তা শ্রমিক হওয়া অথবা নিদারুণ কষ্টের প্রবাসী শ্রমিকের জীবন বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প কি এই স্বল্প শিক্ষিত যুবকদের কাছে রয়েছে?

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে অভিযোগ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মান সম্পন্ন ও দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, উচ্চ শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালকদের আদৌ কি কোন পরিকল্পনা রয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কার্যক্রম খুবই অপ্রতুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এখন বিভিন্ন পরীক্ষা আর গতবাধা এসাইনমেন্ট তৈরি, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদিতেই আবদ্ধ। শ্রেণিকক্ষ সংকট, আবাসন সংকট, শিক্ষক সংকট, সেমিনার ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব, গবেষণাগার ও কম্পিউটার ল্যাব না থাকা ইত্যাদি কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একদিকে যেমন নতুন জ্ঞানের তৈরি হচ্ছে না,  অপরদিকে শিক্ষার্থীরা কোন রকম বিশেষায়িত জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন ছাড়াই শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। আমাদের শ্রম বাজারের সাথে উচ্চ শিক্ষার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বিষয়ের সাথে চাকুরির পড়াশোনার তেমন কোন মিল থাকে না। ফলে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের এই প্রক্রিয়ায় সময় ও অর্থের নিদারুণ অপচয় ঘটে। শিক্ষার্থীরাও উচ্চ শিক্ষা শেষে চাকুরির নিশ্চয়তা বা সম্ভাবনা না দেখে হতাশায় ভুগে। শিক্ষা জীবনের শত বাধা পেরিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন চাকুরির বাজারে প্রবেশ করে, তখন তাদের উপর জেকে বসে কোটার অভিশাপ। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ কোটার দখলে। আবার, চাকুরির বাজারে মামা-খালু, চাচার দৌরাত্মের কথা না বললেই নয়। দূর্নীতি এত সর্বগ্রাসী যে, এখন এটা ধরেই নেওয়া হয়েছে লবিং আর টাকা ছাড়া চাকুরি হবে না। যৌবনের যে সময় মানুষ সবচেয়ে কর্মক্ষম থাকার কথা, সেই সময় আমাদের তরুণ সমাজ সবচেয়ে হতাশায় কাটায়।

বাংলাদেশে জনতাত্তিক পরিবর্তন গঠছে খুব দ্রুত এবং বাংলাদেশে তরুণ জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। UNFPA এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৭৬ লক্ষ, যা কিনা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমপক্ষে ৫ কোটি ৬ লাখ। বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ন এর কারণে এই বিশাল তরুণ ও যুবকের বড় অংশই শিক্ষা ও চাকুরির জন্য শহরে ভীর জমাচ্ছে। যার ফলে, আমাদের শহুরে নাগরিকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের এক স্টাডি অনুযায়ী, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের শহুরে জনসংখ্যা গ্রামীণ জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে। শহুরে জীবনের নানা সংকট ও জীবন-যাপনের খরচ এই যুবকদের জীবনকে আরো দূর্বিসহ করে তুলছে। এই বিশাল তরুণ জনসংখ্যা, যাদের জীবনের কোন নিশ্চয়তা নেই, যারা কিনা ভাগ্যান্বষণে ভীড় জমাচ্ছে শহরে, এরাই কিন্তু আগামীর বাংলাদেশ। এই ভাগ্য বিড়ম্বিত হতাশ তরুণেরা কিন্তু ভাগ্যকে মেনে নিয়ে বসে থাকবে না। আগামীর বাংলাদেশ তাই যতটা হতাশার, তার চেয়েও বেশি বিদ্রোহের বার্তা জানান দিচ্ছে। শহুরে তরুণদের বিদ্রোহ আগামী বাংলাদেশের অন্যতম ভবিতব্য।

বলা হয়ে থাকে, গুণগত শিক্ষা এবং দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব নাকি বেকারত্বের অন্যতম কারণ। আমাদের দেশের নীতি-নির্ধারকেরা কি এ নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে, দক্ষ শ্রমিক হলেই বেকারত্ব থাকবে না। আজ সারা পৃথীবিব্যাপী যুব বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কিনা বর্তমানে ১৩.২ শতাশ। এমনকি উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতেও যুব বেকারত্ব প্রকট। এই যে বিশ্বব্যাপী ক্রম বর্ধ্মান যুব বেকারত্ব, এর কারণ নিহিত রয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যাবস্থার সংকটের মধ্যেই। আমাদের দেশের বেকারত্বের মূল কারণও আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যাবস্থার সাথে জড়িত, কাজেই আর্থ-সামাজিক ব্যাবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া, কেবল মাত্র কিছু সংস্কার মূলক কার্যক্রম দিয়ে বেকারত্ব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

প্রিয় সহযোদ্ধা, স্বদেশভূমির বুকে কান পেতে শুনুন, আগামী বিদ্রোহের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তরুণদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ-বিক্ষোভ এর আঁচ আমরা ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছি। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলন আমাদের এই বার্তাই দিচ্ছে। কোমলমতি শিশু ও তরুন-যুবকদের নেতৃত্বে সংঘটিত এ আন্দোলনগুলো নিছক ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন নয়, এগুলো অন্যায়, অবিচার ও ক্ষোভের স্বতস্ফূর্ত বহিপ্রকাশ। তাই দমন-পীড়ন করে এ বিদ্রোহ সাময়িক থামিয়ে দেয়া গেলেও, তা ফিনিক্স পাখির মত বারবার ফিরে আসবে। এ সকল আন্দোলনের শিক্ষা আগামী দিনের তরুণ-যুবকদের আন্দোলনকে পথ দেখাবে। বিদ্রোহ-বিপ্লব সব সময় আমাদের চেনা পথে আসে না। তাই প্রতিটি আন্দোলনের মূল সুর ধরতে পারা এবং জনগণের ভাষায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনকে অগ্রসর করাটাই আগামীদিনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আর এর উপরই নির্ভর করছে আমাদের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সফলতা-ব্যার্থতা। তরুণদের সমস্যা সমাজের সামগ্রিক সংকট থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তাই আগামীতে তরুণদের আন্দোলনকে সমাজের অন্য শ্রেণী পেশার মানুষের আন্দোলনের সাথে ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। এই দুঃসময়ে এটাই হোক আমাদের শপথ।

লেখকঃ বাপ্পী দত্ত

Share.

মুক্তিফোরাম একটি মুক্তিবাদী, বহুত্ববাদী এবং জনপন্থী সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সংগঠিত গণমঞ্চ। এর লক্ষ্য হলো নতুন ধরণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চর্চা নির্মাণ। নোংরা হিসেবে রাজনীতির যে রূপকল্প এদেশের মানুষের কাছে নির্মাণ করা হয়েছে, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় মুক্তিফোরাম। আবার যেসব একক আদর্শ (যেমন বামপন্থা-ডানপন্থা) বা পরিচয়ের রাজনীতি (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিবাদ) দিয়ে জনগণের সংহতি ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তার একটি এন্টিডোট হয়ে ওঠাও মুক্তিফোরামের প্রকল্প।

Leave A Reply