একটা দেশের সবচে ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান তার রাষ্ট্র। সরকার সেই রাষ্ট্রের সাময়িক প্রতিনিধি। নাগরিকরাই তাকে ক্ষমতাচর্চার অধিকার দেয়।
দুনিয়ার কোনো কোনো দেশে সরকারের ক্ষমতা সীমিত। সংবিধান/লোকাচার কর্তৃক সীমিত। সরকার যা খুশী তাই করতে পারে না।
সেখানে ক্ষমতার ক্ষেত্রে একটা চেক এন্ড ব্যালেন্স থাকে। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, আর বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা পরিকল্পিতভাবে বিতরণ করে দেয়া থাকে। একটা আরেকটাকে চেক দেয় বলে সরকার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতে পারে না।
বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবেই সব ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে। প্রধানমন্ত্রী এই নির্বাহী বিভাগের প্রধান, আবার বিজয়ী দলের প্রধানই যেহেতু সংসদ নেতা, ফলে তিনি আইন বিভাগেরও প্রধান। বিচার বিভাগের বিষয়টা নিয়ে একটু জটিলতা আছে, কিন্তু সেটার নিয়ন্ত্রণও আসলে প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
ফলে, ফাংশনালি, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
এই রাষ্ট্রে কোনো চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নাই। এখানে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ। বায়াত্তরের সংবিধান এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে বিধিবদ্ধ করেছে।
এটা হচ্ছে এই দেশে স্বৈরতন্ত্রের আইনী ভিত্তি।
এই ব্যবস্থায় যেই দলই রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকুক না কেনো, তার ছাত্র সংগঠনই, ক্যাম্পাসগুলোতে পিশাচের মতো আচরণ করবে।
কারণ সে জানে সে সরকারি ছাত্র সংগঠন। রাষ্ট্র-সরকার-প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে তাকে দায়মুক্তি দেয়া আছে, পুলিশ ও প্রশাসন তার পাশে আছে। তাই সে এতো বেপরোয়া, আর এতো মারমুখী।
এই দায়মুক্তি দেয়ার পেছনেও রাষ্ট্র-সরকার-প্রধানমন্ত্রীর স্বার্থ আছে। সেটা সহজ ও দৃশ্যমানঃ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। যে কারণেই হোক, দক্ষিণ এশিয়ায় স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই শুরু হয়, তাই শিক্ষার্থীদেরকে সার্বক্ষণিক সন্ত্রাসের মধ্যে রাখাটা জরুরী।
সম্পর্কটা এখানে একমুখী নয় একেবারেই, পারস্পরিক বটে।
এটা কোনো বাম ডান আদর্শবাদের বিষয় না। এটা হচ্ছে ক্ষমতার বিষয়, রাষ্ট্রের চরিত্রের বিষয়। সাম্পর্কিক স্বৈরতান্ত্রিকতার বিষয়।
অনেকে যেটাকে ছাত্র রাজনীতির সমস্যা ভাবছেন, সেটা আসলে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্র-সরকার-প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতানির্ভর সরকারি ছাত্র সংগঠনের সমস্যা।
এই রাষ্ট্রের চরিত্র আপনি যতোক্ষণ না বদলাচ্ছেন, যতোক্ষণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ব্যবস্থা করে সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত না করছেন, ততোদিন কিছুই মৌলিকভাবে পাল্টাবে না।
নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাধীনতা থাকবে, স্বৈরতন্ত্রের সমুদ্রের মাঝখানে এগুলো হবে গণতন্ত্রের দ্বীপপুঞ্জ, এই প্রত্যাশাটা অবাস্তব।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গণতন্ত্রায়নের জন্য দরকার আত্মনির্ভরশীল ছাত্র সংগঠন। কোনো ছাত্র সংগঠন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাবে না, দায়মুক্তি পাবে না, সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের মদত পাবে না। এই দাবি তুললেই রাষ্ট্র মেনে নেবে না, কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হাতে রাখতে এখানে স্বৈরতান্ত্রিক সম্পর্কটা জিইয়ে রাখা দরকার।
কিন্তু শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, খোদ রাষ্ট্রকেও গণতন্ত্রায়িত করতে, এই দাবি তোলার দরকার আছে। কারণ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজমান স্বৈরতান্ত্রিক সম্পর্ক নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্র-সরকার-প্রধানমন্ত্রী্র একমাত্র না হলেও অন্যতম বড়ো একটা স্তম্ভ। এই স্তম্ভটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারলে, অন্য স্তম্ভগুলোতে ধাক্কা দেয়ার তাড়না তৈরি হবে, সেই তাড়নাটা জরুরী।
1 Comment
On the point.