বুয়েটের ছাত্র আবরারকে ছয়/সাত ঘণ্টা ধরে, ঠান্ডা মাথায়, সমবেতভাবে অত্যাচার করতে করতে মেরে ফেলাটা আদৌ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একেবারেই নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদেরকে হলের বিভিন্ন রুমে ডেকে নিয়ে অত্যাচার করাটা অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং নিয়মিত ঘটনা। এটাই ছাত্রলীগের সিস্টেম। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ক্যাম্পাসে গোটা ছাত্রলীগ এই সিস্টেমেই চলে।
সিস্টেমটা হচ্ছে পুরো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সিস্টেম। এই সিস্টেম বর্তমান সরকার-প্রণালী এবং রাষ্ট্র-প্রণালীর (অর্থাৎ সামগ্রিক সিস্টেমের) অংশ। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, তার সহযোগী অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসন, হল-প্রশাসন এবং বিভিন্ন ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের আশেপাশে কর্তব্যরত পুলিশ প্রশাসনসহ রাজনৈতিক ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট সকলেই এই সিস্টেমের অংশ।উপরন্তু, এই সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ-সিস্টেম শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নয়, সারা বাংলাদেশেই নানান রকম চেহারা নিয়ে জারি আছে। এটা আজকের একচেটিয়া ও একদলীয় বাংলাদেশের সর্বাত্মক শাসন-সিস্টেম। এই সিস্টেমের মূল পদ্ধতি হলো অনুগ্রহ এবং নিগ্রহ। অনুগ্রহ মানে শত কোটি হাজার টাকার দুর্নীতি, আর নিগ্রহ মানে হামলা অথবা মামলা। হামলার মধ্যে আছে বৈধ পুলিশের পাশাপাশি এবং অবৈধ পুলিশের (অর্থাৎ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ইত্যাদি) আক্রমণ।
কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সময় আমরা এই সিস্টেমের বিপুল প্রকাশ্য প্রয়োগ দেখেছি। আমরা হাতুড়ি দেখেছি, হেলমেট দেখেছি, মিথ্যা মামলা দিয়ে সাংবাদিক শহিদুল আলম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলামকে জেল খাটাতে দেখেছি। প্রকাশ্য রাস্তায় দলবদ্ধভাবে একজন সাধারণ নিরস্ত্র শিক্ষার্থীকে হাতুড়ি দিয়ে, লোহার রড দিয়ে মেরে মেরে হাড়গোড় ভেঙে ফেলে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া পর্যন্ত এই সিস্টেমটা ছাত্রলীগের জন্য জায়েজ।
আবরারের বেলায় সিস্টেমের যে ব্যতিক্রমটুকু ঘটেছে সেটা হলো তাঁর মৃত্যু। ছাত্রলীগের সর্বাত্মক ক্যাম্পাস-নিয়ন্ত্রণ-সিস্টেমের অলিখিত ম্যানুয়ালের মধ্যে — সাধারণত — প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড ঘটানোর ‘নিয়ম’ নাই। এই সিস্টেমে যেকোনো মাত্রার অত্যাচার জায়েজ, কিন্তু হত্যাকাণ্ড জায়েজ নয়। কোনরকমে আবরারের শুধু প্রাণটুকু যদি টিকে যেত, তাহলে তার অত্যাচারকারীরা সরকারি পার্টির ভেতরে আরো বেশি বুক ফুলিয়ে চলতে পারত, ‘গৌরব’ করতে পারত। এই জাতীয় ‘গৌরব’ দিয়েই নিজেদের সংগঠনের অভ্যন্তরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মাঠ পর্যায়ের র্যাংকিং নির্ধারিত হয়। আনন্দ-উত্তেজনাময় অত্যাচারে ক্রমাগতভাবে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় বুয়েট-ছাত্রলীগের অত্যাচারীরা সম্ভবত বোঝে নি যে, আবরার সত্যিই মরে গেছেন। বুঝলে তারা অন্য পদ্ধতিতে যেত। লাশটা গুম করে দিতে পারলে, নিদেন-পক্ষে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসতে পারলে, সিস্টেমটা ব্যতিক্রমহীন হয়ে থেকে যেতে পারত।
কিন্তু সিস্টেমেটিক রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক অত্যাচার সত্যিই অনেক মুশকিলজনক ব্যাপার। মেরে ফেলা যাবে না অথচ সর্বোচ্চ মাত্রায় অত্যাচার গোটা দেশে জারি রাখতে হবে— এমন একটা সুদক্ষ সিস্টেম দাঁড় করাতে গেলে যে ধরনের সুশৃঙ্খল পার্টি-সংগঠন লাগে তা এই সরকারের রাজনৈতিক মহলের নেই। উপরন্তু প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের কর্মকর্তারাও কী করা উচিত, আর কী করা থেকে বিরত থাকা উচিত, সেটা প্রায়শই বুঝে উঠতে পারেন না। আওয়ামী লীগ/ছাত্রলীগের এত বেশি মাথা আর এত বেশি মুখ যে, কাকে সন্তুষ্ট করলে সরকার সন্তুষ্ট হবে, চাকরি অক্ষত থাকবে আর কে অসন্তুষ্ট হলে ঘাড়ের উপর সমূহ বিপদ নেমে আসবে— সেটা ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারাটা তাঁদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে বর্তমান সিস্টেমে অনুগ্রহ ও নিগ্রহ (অর্থাৎ দুর্নীতি ও অত্যাচার) অতিরিক্ত ‘গণতান্ত্রিক’ হয়ে উঠেছে। অতিশয় বিকেন্দ্রায়িত হয়ে উঠেছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-মৎস্যলীগ-ফুলপাখিলতাপাতালীগ ইত্যাদি যেকোনো লীগের নাম ধারণ করতে পারলেই, জোরে জোরে “জয় বাংলা” “জয় বঙ্গবন্ধু” বলতে পারলেই এবং/অথবা বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনার নাম-জপ-স্তুতি করতে পারলেই, প্রায় যেকোনো ব্যক্তি অনুগ্রহ পাওয়ার অথবা নিগ্রহ করার অধিকারী হয়ে উঠতে পারেন। এটাই সিস্টেম।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সামগ্রিক সিস্টেম রচনার দায় এড়াতে পারেন না। তাঁর নেতৃত্বের ছায়াতেই যে এই সিস্টেমটা গড়ে উঠেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। “তাঁর হুকুমে দল চলে, রাষ্ট্র চলে, আমলাতন্ত্র চলে, পুলিশ-প্রশাসন চলে। … সর্বময়, একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি এই গোটা সিস্টেমটাকে অনুমোদন না করেন, তাহলে এই সিস্টেমটা চলে কীভাবে?” (দ্রষ্টব্য: “বাংলা” পোর্টালে সেলিম রেজা নিউটনের সাম্প্রতিক রচনা; অথবা সেলিম রেজা নিউটনের ফেসবুক-পোস্ট।) এ কথা সবাই জানে, বাংলাদেশ সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিক তিনি। সামান্য সব খুচরা খুচরা রাজা-নবাব-বাদশা-সম্রাটকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বা সংকেত লাগে লাগে। গোটা দেশের মানুষ-মিডিয়া-প্রশাসন-পুলিশ অপেক্ষা করতে থাকেন কখন বিদেশ সফরশেষে প্রধানমন্ত্রীর ফিরবেন, কেননা তিনি ফিরে আসলেই শুধু মাত্র বোঝা যাবে, ক্যাসিনো-সম্রাট ইসমাইলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে কি পারবে না। এমনকি আবরার হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী সংবাদ-সম্মেলনেও প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন যে, তিনি স্বয়ং পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আবরারের খুনি ছাত্রলীগ-নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার মানে আবরার-হত্যাকাণ্ডের মতো চরমভাবে নাড়া-দেওয়া একটা খুনের আসামিদেরকে পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে গেলে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ লাগে— পুলিশ নিজে থেকে পারে না। এই হচ্ছে অবস্থা।
এখন এই অবস্থায়, এই এক-ব্যক্তি-কেন্দ্রিক সর্বাত্মক সিস্টেমের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে তিনি যদি বলেন, গোটা বাংলাদেশের ছোট-বড় কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের এই সামগ্রিক সিস্টেম সম্পর্কে তিনি অবহিত নন, তাহলে সেটা কিন্তু তাঁর গাফিলতির মধ্যে পড়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং জোটের মধ্যে এ কথা সুবিদিত এবং বহুলকথিত যে, একমাত্র প্রধানমন্ত্রীকেই তাঁরা ঠিকঠাক মতো সৎ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর ইদানীংকার খোলামেলা কথাবার্তা এবং তীব্র বিরক্তি থেকেও এটা পরিষ্কার যে, তাঁর নিজের দলের এবং জোটের বড় বড় নেতাদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার বাড়াবাড়িতে তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। তাহলে এখন কর্তব্য হয় গত ১০ বছর ধরে সারা বাংলাদেশে ছাত্রলীগের-যুবলীগের-আওয়ামীলীগের ভয়াবহ সব সিস্টেমেটিক অত্যাচার, দুর্নীতি, অপকর্ম এবং খুনখারাবির দায় কবুল করা। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার পেছনে সবচাইতে বেশি দায় ছিল কিন্তু তাঁরই স্ব-কথিত “চাটার দল”-এর। আজ একটানা ১০ বছরের ধরে একচ্ছত্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পরও বর্তমান আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে যেভাবে একটা অতল খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে, তারপর এই দলের আর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার নৈতিক অধিকার থাকে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “এক-এগারো লাগবে না, যা করার আমিই করব।” এবার তাঁকে সেটা করতে হবে। দুই-চারটা চুনোপুঁটিকে (এমনকি বিরাট বিরাট রাঘব-বোয়ালকে) ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে এই পরিস্থিতি সামান্যও বদলাবে না। এখন প্রয়োজন খোদ এই সর্বাত্মক সিস্টেমটাকে পরিবর্তন করা। সে জন্য দরকার বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে সত্যিকারের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারপ্রবণ বর্তমান আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে জনবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে পুনর্গঠিত নতুন একটি আওয়ামী লীগ নিয়ে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা।
আবরারের হত্যাকাণ্ড নিছক একটা ফৌজদারি হত্যাকাণ্ড নয়। এটা পরিস্কার রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। সিস্টেম-বিরচিত হত্যাকাণ্ড। এটা স্রেফ থানা-পুলিশের মামলা নয়। এটা সরকার, রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দল পরিচালনার পদ্ধতিগত মামলা। গোটা বাংলাদেশকে পরিপূর্ণভাবে, নিরঙ্কুশভাবে, ভিন্নমতহীন করে ফেলার যে-রাজনৈতিক পদ্ধতি আজ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বর্তমান সরকার পরিচালনা করে আসছেন, আবরার-হত্যাকাণ্ড তারই অনিবার্য পরিণতি। আবরার-হত্যাকাণ্ড খুচরা ঘটনা নয়, সিস্টেমের পার্ট। সবার আগে এই রাজনৈতিক পদ্ধতি পরিবর্তনের কথা না-তুলে আবরারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্রেফ শব্দ-বাক্য রচনা করার খেলা খেলতে থাকাটা নিম্নস্তরের তামাশা মাত্র।
সুতরাং ভিন্নমতহীন এই রাজনৈতিক পদ্ধতি রচনার দায় আজকের বাংলাদেশের সর্বময় রাজনৈতিক ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী হিসেবে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিতে হবে। চুরিচামারি না-করার সততা প্রকৃতপক্ষে নিম্নতর পর্যায়ের সততা। উচ্চতর পর্যায়ের সততার নাম রাজনৈতিক সততা। রাজনৈতিকভাবে সৎ মানুষ যেমন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য সম্পর্কে তৃপ্তি অর্জন করেন, তেমনি ব্যর্থতার দায় কবুল করতেও পিছপা হন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা রাজনৈতিকভাবে সৎ দেখতে চাই— এমনকি সেটা একচেটিয়া রাজনৈতিক শাসন পরিচালনার ১০ বছরের মাথায় এসে হলেও।
লেখকঃ সেলিম রেজা নিউটন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক