“আমার কাছে আলস্য নারীর চাইতেও প্রিয়”, একজন স্বনামধন্য কবির এই উক্তিটি পড়ে, আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, সেই উক্তিটি আবার বড় বড় অক্ষরে ছেপেছে বাংলাদেশের একটি অন্যতম মুখ্য পত্রিকা। চিন্তা করে দেখলাম, নারী আর আপনার আলস্য এক? মানে নারী আলস্যর মতোই উপভোগ্য?
নারীর প্রতি অনাচার, অবিচার নিয়ে আমরা অনেক কিছুই লিখি বা শুনি। “ভাষা” নারীর প্রতি কতটা অবিচার করেছে সেটা জানলে আপনি আঁতকে উঠবেন! ইংরেজিতে অথবা বাংলায়, নিত্যদিন আমরা যেই গালি গুলো শুনে থাকি, সেই গালি গুলো আসলে কাকে দেওয়া হচ্ছে একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। গালিটি যাকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া হয় সেটা আসলে তাকে নয় তার ‘মা’ কে দেওয়া হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘তোমার মায়ের চরিত্র খারাপ, তার পাপের ফসল তুমি’ অথবা ‘তোমার মায়ের সাথে তোমার অবৈধ সম্পর্ক আছে’। যেমন ধরুন ‘শালা’ খুব সাবলীল ভাবে আমরা যেই গালিটি দিয়ে থাকি, এর অর্থ দাঁড়ায়, ‘তুমি যেহেতু আমার শালা, তাই তোমার বোনকে আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি।’ তাহলে বোঝা যাচ্ছে এটাও নারী কেন্দ্রিক।
এই তো গেলো সাধারণ মানুষের কথোপকথন। বাংলা ভাষার অভিধানে ‘নারী’ শব্দের যেসব সমার্থ (synonymys) শব্দ পাওয়া যায়, তার অর্থ গুলো জানলে ব্যাকরণবিদ ও কিছু কবি সাহিত্যিক যারা অবলীলায়, জেনে বুঝে নারীর প্রতি এই ধরণের ভাষা ব্যবহার করেন তাঁদের প্রতি ঘেন্না ধরে যাবে।
কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক:
রমণী: যে রমণের (sex) যোগ্য।
ললনা: যাকে দেখে লালায়িত হওয়া যায়।
কামিনী: যাকে দেখে কাম ভাব জাগে / কামার্ত নারী।
বিনোদিনী: যার দ্বারা বিনোদন উপভোগ করা যায়। ইত্যাদি
নারীকে ভোগ্য পণ্য বানানোর জন্য শুধু আজকের মিডিয়াই দাই নয়, ভাষাবিদ আর কবি সাহিত্যিকদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে এর পিছে।
গৃহে থাকা নারীকে যেমন বলা হয় গৃহিণী, মহলে থাকা নারীকে বলা হয় মহিলা, আবার ভদ্র নারী যিনি গৃহে থাকেন তাকে বলা হয় বণিতা। কিন্তু নারী যখন বহির্মুখী হন তখনই তিনি হয়ে যান ‘বারবণিতা’, যার অর্থ দাঁড়ায় নারী ঘর থেকে বাহির হলেই হয়ে যান পতিতা! নারীকে যখন বলা হয় ‘অবলা’ এর অর্থ দাঁড়ায়, নারীর কোন বল নেই বা যার কিছু বলার নেই বা কিছু বলে না তিনিই অবলা।
বাংলা ব্যাকরণে পুরুষের ক্ষেত্রে আমরা পড়েছি পুং লিঙ্গ আর নারীর ক্ষেত্রে আমরা পড়েছি স্ত্রী লিঙ্গ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কার স্ত্রী? সব নারীই তো স্ত্রী নন, তবে এটাই বোঝা যায় নারীর ক্ষেত্রে বাংলা ব্যাকরণে স্বতন্ত্র শব্দ নেই।
নারীর প্রতি ব্যবহৃত কিছু শব্দের কোন প্রতি শব্দ নেই। যেমন, ‘সতী’ ‘অসতী’, অর্থাৎ সতীত্ব বজায় রাখতে হবে শুধু নারীকেই, আর যারা তথাকথিত ভাবে তাকে ‘অসতী’ করেছেন তারা যেন একেবারে শুদ্ধ! ‘পতিতা/ বেশ্যা’, যেহেতু এই শব্দের কোন প্রতিশব্দ নেই, তাহলে বোঝা যায় যিনি পতিতালয়ে যান তিনি একদম দুধে ধোয়া তুলসী পাতা আর যেই নারী পতিতা হয়েছেন তিনি একা একা নিজের যোগ্যতায় পতিতা/ বেশ্যা হয়েছেন! আরও কিছু শব্দ, যেমন, ‘লক্ষ্মী’, ‘অলক্ষ্মী’, ‘বিধবা’, ‘সধবা’ এই শব্দ গুলোর কোন প্রতিশব্দ নেই।
প্রবাদবাক্য (proverb) বিশ্লেষণেও দেখা গেছে নারীকে ‘subject’ নয় ‘object’ হিসেবে দেখা হয়েছে। যেমন, নারী বিয়ে বসে আর পুরুষ বিয়ে করে, ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ কখনো শুনেছেন, চোরের বাপের বড় গলা? ‘ভাগ্যবানের বউ মরে অভাগার গরু মরে’, অর্থাৎ বউ মরলে আর একটা বিয়ে করা যাবে তাই সে ভাগ্যবান আর গরু মরলে অর্থ খরচ করে গরু কিনতে হবে তাই সে অভাগা, তাই বউ (নারী) আর গরু মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এক! ‘পুরুষের জিদে বাদশা/ নারীর জিদে বেশ্যা’, ভগিনীগণ সাবধান, জিদ করবেন না একেবারে মাটির সাথে মিশে থাকবেন নাহলে আপনি বেশ্যা হয়ে যাবেন!
অতএব, নারীকে কেন্দ্র করে প্রবাদবাক্য বা সমার্থ শব্দ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অসম্মানজনক, অশ্লীল ও ভোগ্য পণ্য হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে, কোন শব্দেই প্রকাশ হয়নি নারীর মেধা, গুণ, ব্যক্তিত্ব বা স্বকীয়তা।
তাছাড়া পত্রিকা, খবর, সিনেমা, নাটকে আমরা প্রতিনিয়ত শুনি বা পড়ি, ‘ধর্ষিতা’ ‘নষ্টা’, ‘সম্ভ্রম-হারা নারী’ ‘ইজ্জত লুটে নিয়ে গেছে’ নারী ধর্ষিতা হন না, ধর্ষণের শিকার হন, ইজ্জত/ সম্ভ্রম কেউ কখনো হারায় না এবং সেটা লুটেও নেওয়া যায় না, কোন দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার অর্থ এই নয় যে একজন নারী নষ্টা হয়ে গেলেন বা ইজ্জত/ সম্ভ্রম হারিয়ে ফেললেন। নারীকে মৌখিক আক্রমণ করার জন্য যখন কিছুই খুঁজে না পান দয়া করে তার চরিত্র বিশ্লেষণ করবেন না, এটি একটি অপরাধ এবং ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই অপরাধের কঠোর শাস্তি নির্ধারিত আছে।
নারীর প্রতি শব্দচয়নের ক্ষেত্রে সকলের সতর্ক হওয়া উচিত, অন্তত পক্ষে শিক্ষিত ও বিবেক সম্পন্ন মানুষ সচেতন হবেন আশা করা যায়। এতে আপনার সম্মান কমবে না বরং বাড়বে। যে কোন মানুষ, সে নারী হোক আর পুরুষই হোক সকলের প্রতি সম্মান সূচক শব্দ ব্যবহার করা উচিত।
নুরেন নির্ভানা বৃষ্টি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একজন শিক্ষক