- আওয়ামী লীগ ভোটচোর, ভোটডাকাত। তা বিএনপির চেয়ে কম চোর না বেশি ডাকাত সেই কুতর্ক অবান্তর। উভয়েরই লক্ষ্য শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা। মাগুরা অথবা ১৫ই ফেব্রুয়ারি বা ২০০৭ এর ভুয়া ভোটার তালিকা বেশি খারাপ, নাকি গত ডিসেম্বরের নৈশ ভোট বা বর্তমানের ডিজিটাল এসিস্টেন্স ভিত্তিক ইভিএম খেলাধুলা এইসব আলাপও অবান্তর। চুরির প্রকরণ আর কৌশলের সফলতার ভিত্তিতে কে সফল চোর আর কে ব্যর্থ চোর তার মূল্যায়ন চলতে পারে, কিন্ত কাউকে চোর আর কাউকে ‘সুফি ঘরানার কিন্ত চরিত্রের একটু দোষ আছে’ এমন আলাপ ফালতু আলাপ। উভয়ের লক্ষ্যই এক- জনগণের সম্পদ চুরি, আর সেইজন্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা…
- সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আওয়ামী লীগ নিয়ে কী ভাবছে, নাকি তারা প্রচ্ছন্ন বিএনপির পক্ষে, কিন্ত রায় দেবার সুযোগ পাচ্ছে না, অথবা মানুষ বিরাজমান রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, তাদের কিছু যায় আসে না- এইসব অনুসিদ্ধান্তের পেছনে আমাদের হাতে কোন ক্রেডিবল ডেটা নাই। আমরা নিজ নিজ ইকো চেম্বারে বসে নিজের ভাবনার অনুরণন এইসব আলাপে তুলি। দেশে সর্বশেষ মোটামুটি মানের নির্বাচন হয়েছিল ২০১৩ তে, পাঁচ সিটি কর্পোরেশনে। সেখানে বড় শহরগুলোর মানুষ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরপর মানুষের পারসেপশনের আর কোন সায়েন্টিফিক এভিডেন্স আমাদের হাতে নাই, যদিও শুধু ভোটই অনেক সময় পাবলিক অপিনিয়ন এর জাস্টিফায়েড এভিডেন্স না। আমরা জানি না ৩০০ আসনের জনতা কী ভাবছে, গ্রামের ভাবনা আর শহরের ভাবনা, শিক্ষিতের ভাবনা আর সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিতের ভাবনার মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক থাকতে পারে। সুতরাং এইসব ডেটাবিহীন গা জোয়ারি যুক্তির আগে আমাদের এভিডেন্স পাওয়া জরুরি।
আওয়ামী লীগের হাতেই এই ব্যাপারে দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে করানো সবচেয়ে আনবায়াসড পারসেপশন সার্ভে রেজাল্ট আছে। সেই ফলাফলের কারণেই তারা ভোট মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে ভরসা পায় না আর। সুতরাং নতুন রাজনীতির ধারা তৈরি করতে হলে, অথবা পালটা প্রতিরোধ করতে হইলে প্রথমে এই পাবলিক পারসেপশন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে কর্মকৌশল রচনা করতে হবে।
- জন্মের সময় গণতান্ত্রিক দল হইলেও এখন আওয়ামী লীগ একটি পারিবারিক রাজতন্ত্র, যা আধুনিক সামন্ততান্ত্রিক বিভিন্ন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান- যারা দেশের কলম ও বন্দুকের ক্ষমতা এবং সিংহভাগ সম্পদের সঞ্চালন ধারণ করে- প্রশাসন, পুলিশ, ব্যবসায়ী এলিট গোষ্ঠী, সশস্ত্র বাহিনী- এদের সাথে সম্পদ ভোগের সুযোগ ভাগাভাগি করে শাসন চালাচ্ছে। আর সাথে নিজ পার্টির তৃণমূল মাফিয়া কর্মীবাহিনী। ঠিক তিন-চারশো বছর আগের রাজতন্ত্রের মত, যেখানে সম্রাট সুবাদার, মনসবদার, জায়গীরদারদের দিয়ে নিজের ক্ষমতা কাঠামো গড়ে তুলতেন, টিকিয়ে রাখতেন। এই কাঠামোতে জনমানুষের একমাত্র কাজ খাজনা দেয়া…বাংলাদেশের মানুষও এখন সেই রোল প্লে করছে, করতে থাকবে…ভোট, নির্বাচন ও বাকি সব আলাপ এখানে নাটকের অংশ মাত্র…
- আমাদের কিছু ভুল আলাপ আছে ১৯৭৫ বা ২০০৭ এ ‘অগণতান্ত্রিক শক্তি’র ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে। যেন খুব সুন্দর গণতন্ত্র চলছিল, তখন উর্দি পরিহিত কিছু শয়তান এসে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। ভেবে দেখলাম পুরোটাই ভুল। উর্দিওয়ালাদের দখলের আগে বিকশিত হচ্ছিলো ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী, যাদের উদ্দেশ্যও ছিল একই, শক্তির জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকা, নানা ছলাকলায়, ১৯৭৪-৭৫ এ বাকশালের নামে, ২০০৬-০৭ এ ভুয়া নির্বাচনের ডাকাতির চেষ্টার মাধ্যমে। দুইটিই ছিল বিকাশমান অগণতান্ত্রিক শক্তি, পার্থক্য শুধু তাদের উর্দি ছিল না। সুযোগ পেয়ে উর্দিওয়ালারা এসে সময়ে তাদের হঠিয়ে দিয়েছে। এখানে পুরোটাই শক্তির লড়াই, গণতন্ত্র বনাম উর্দির শাসন টাইপ যেসব গতানুগতিক মেরুকরণ আমাদের বুদ্ধিজীবিরা এই ট্রানজিশনগুলোর তকমা দিতে ব্যবহার করেছেন তা ভ্রান্ত…বিভ্রান্তিকর…
- আওয়ামী লীগ যেহেতু গণতন্ত্রে নাই, শক্তিতে আছে, তাই তার বিদায়ও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী পালটা অধিক মাত্রার কোন শক্তি দ্বারা হবে। ভোট কোন শক্তি না এই গেইমে, ভোট তখনই শক্তি হয় যখন বন্দুক মাঠের বাইরে রেখে এসে দুই পক্ষ নিজের গ্রহণযোগ্যতার স্কিল নিয়ে খেলতে নামে। সুতরাং যেদিন কোন ‘অগণতান্ত্রিক’ শক্তি বেশি শক্তিশালী হয়ে বিরাজমান আওয়ামী রাজতন্ত্র ও এলিট সামন্ততন্ত্রকে রিপ্লেইস করবে, সেদিন যেন আমরা আবার ‘গণতন্ত্র’ নির্বাসিত হয়েছে এই ধরনের ভুল আলাপ শুরু না করি…
গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজিম