যে কোনো দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল উপাদানগুলির মধ্যে প্রধান তিনটি উপাদান হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক গতিশীলতা ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। আমাদের দেশে তিনটির একটিও নেই।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা:
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে একটি প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক শ্বাসন ব্যবস্থা। এই শ্বাসন ব্যবস্থা আমাদের দেশে কখনোই ছিলো না। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত মোটামোটি সুষ্ঠ নির্বাচন তো ঠিকই হয়েছিল, কিন্তু এই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শ্বাসন কখনোই গণতান্ত্রিক ছিলো না। প্রতি নির্বাচনে আমরা নতুন এক শ্বৈরশাসককে নির্বাচিত করেছি। এই কারনেই দেখা যায় নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই পুরান সরকারের সব প্রকল্প বাতিল অথবা স্থগিত করে দেয়। তাদের জন্য এটা খুব সহজ হয় কেননা আমাদের সরকার ব্যবস্থাটাই এমন যে ক্ষমতাশীল দল চাইলে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। কোনো জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। এইরকম এক শ্বাসন ব্যবস্থা যে কোনো দেশকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়। ইতিহাসে আপনি এর অনেক নজির খুঁজে পাবেন এবং এর সব চেয়ে বড় উদাহরন হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট।
১৭৭৬ সালে যখন তারা স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়, তখন তারা অর্থৈনৈতিক ভাবে ইউরোপীয় বেশিরভাগ দেশের থেকেই অনেক পিছিয়ে ছিলো। কিন্তু আগামী দেড়শো বছর ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই যেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, রাজ পরিবার গুলোর মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ ও যুদ্ধ লেগে ছিলো, সেখানে গণতন্ত্রের কারনে দেড়শো বছরের ১৪৬ বছরই যুক্তরাষ্টের রাজনীতি ছিলো স্থিতিশীল। তাদের স্বাধীনতার ঘোষনার প্রায় আড়াইশো বছর পর আজ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সামনে কোনো দেশের অর্থনীতিই কিছুই না। ইতিহাসের সব চেয়ে বড় অর্থনীতির দাবিদার তারা। গণত্রান্ত্রিক একটি দেশে হয় সরকার বদলের নির্বাচন, স্বৈরশাসিত দেশে হয় সরকার বদলের আন্দোলন এবং যে কোন আন্দোলন থামিয়ে দেয় ওই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা। ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ছোট বড় মিলে আমাদের দেশে মোট বিশটিরও বেশি আন্দোলন হয়েছে। যত দিন যাবে, ততই ভয়াবহ হয়ে উঠবে এই আন্দোলনগুলো, ততই অস্থিতিশীল হবে আমাদের দেশের অর্থনীতি।
সামাজিক গতিশীলতা:
স্বৈরশাসনের আর একটা সমস্যা হলো এই শ্বাসন ব্যবস্থার অধীনে সামাজিক গতিশীলতা থাকে না বললেই চলে। আমাদের দেশে যারা একবার ভুলক্রমে নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়ে ফেলে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শত মেধা, ইচ্ছা ও চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও নিম্নবিত্ত হিসেবেই মৃত্যুবরন করে। যে কোনো স্বৈরশাসকের তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা দালালদের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে দিতে হয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের কোনো যুবকের জন্য চাঁদাবাজির কারনে উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হওয়া হয়ে পরে অসম্ভব। নিম্নমধ্যবিত্ত এক যুবকের জন্য শত মেধা থাকা সত্ত্বেও সুপারিশ করতে না পারায় পাওয়া হয় না তার পছন্দের চাকরিটা। এক পর্যায়ে যেয়ে এই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা হারিয়ে ফেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার অনুপ্রেরনা। ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে অনেকে পায় না শিক্ষার আলোটুকু। অনেক ছোট বয়স থেকে কাজে লেগে যেতে বাধ্য হয় তারা। যে কোনো শ্বৈরশাসনের অধীনে সব চেয়ে বড় ভুক্তভুগি হয় এই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠরাই। এই কারনেই স্বৈরশাসিত যে কোনো দেশে ক্রমেই গরিব আরো গরিব হতে থাকে আর কিছু অল্পসংখক চাটুকারেরা হয়ে ওঠে আরো বিত্তবান, আরো ক্ষমতাশীল। কাগজে কলমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও তার লভ্যাংশের সিংহভাগই পায় এই চাটুকারেরাই।
মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা:
অতীতে, যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রগতির মাপকাঠি ছিলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা। ৫০০ বছর আগে তা ছিলো কৃষি উৎপাদন। আপনি যত বেশি কৃষি উৎপাদন করতে পারবেন আপনি ততই বেশি জনসংখ্যা ধারন করতে পারবেন, আপনি ততই বেশি যোদ্ধা প্রশিক্ষন দিতে পারবেন, আপনি ততই বেশি রাষ্ট্র দখল দিতে পারবেন, আপনি ততই বেশি জমি পাবেন, আপনি ততই বেশি কৃষি উৎপাদন করতে পারবেন। প্রায় দুইশো থেকে আড়াইশো বছর আগে এই মাপকাঠির আবার পরিবর্তন হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাপকাঠি হয়ে ওঠে শিল্পকারখানার উৎপাদন। কৃষি উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির কারনেই খাদ্যের বাইরেও মানুষের গতানুগতিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত হয় শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্য। ক্রমেই এইসব পণ্যের চাহিদা যত বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভরশীল হয়ে পরে শিল্পকারখানার উৎপাদনের উপর। কিন্তু, আধুনিক যুগের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল নয়, এখন এটি নির্ভরশীল চাহিদার উপর। কোন দেশের জনগন কতটুকু পণ্য ক্রয় করে তার উপর। বর্তমান বিশ্বে সব চেয়ে উৎপাদনশীল দেশ চীন, কিন্তু, সব চেয়ে বড় অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের। আপনি যদি সরকারের কাছ থেকে আপনার সব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা পান, আপনার যদি এই বিষয়ে চিন্তা না করা লাগে যে আপনি অথবা আপনার পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার খরচ কে বহন করবে, আপনার যদি এই চিন্তা না করা লাগে যে আপনার বৃদ্ধবয়সে আপনার আয়রোজগারের ব্যবস্থা কিভাবে হবে, তখন কিন্তু নির্বিঘ্নে, নির্দ্বিধায়, নিশ্চিন্তে আপনি পণ্য ক্রয় করবেন। এতে করে উদ্যোক্তা এমনকি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরও লাভ হবে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমাদের সরকার চাইলে যে এই মৌলিক অধিকার গুলোর নিশ্চয়তা দিতে পারে না তা কিন্তু না, যেখানে একজন এসপি হারুনের বিদেশী ব্যাংক একাউন্টেই পাওয়া যায় ১,৫০০ কোটি টাকা, সেখানে সরকার চাইলেই এগুলির নিশচয়তা দিতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জবাবদিহিতার অভাবের কারনে এগুলো কখনোই হয়ে ওঠে না। যে কোনো অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী সরকারের বৈশিষ্টই হচ্ছে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জবাবদিহিতার অভাব।
আমরা যদি তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের আর্থিক উন্নয়ন চাই তাহলে সবার আগে একটি প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতাসম্পূর্ণ সরকার ব্যবস্থা অবশ্যক।
শামস্ ইশতিয়াক রহমান, সম্পাদক মুক্তিফোরাম।