করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে কমবেশী আতঙ্কিত আছেন সবাই। কেউ কেউ নিজেকে এই মহামারী থেকে রক্ষার জন্য নিচ্ছেন পদক্ষেপ, আবার অনেকের পক্ষে চাইলেও কিছু সম্ভব হচ্ছে না করা। শুরু থেকেই আমরা দেখতে পেয়েছি করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল বেশ উদাসীন, আর এ কারনেই দিনকে দিন বাংলাদেশের মানুষের আক্রান্ত হবার ঝুকি বেড়েই চলেছে। তবে যেমন ভাবে খারাপের মাঝে কিছু অংশ খুব বেশী খারাপ থাকে, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের জনগনের মাঝে, কিছু মানুষ রয়েছেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সর্বোচ্চ ঝুকিতে, যাদের হয়তোবা আমরা দেখেও না দেখার ভান করছি। চলুন আপনাদের আরেকবার মনে করিয়ে দেই এই মানুষগুলো কারা। এবং তার আগে আরেকবার মনে করিয়ে দেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমন হয় কিভাবে।
কিভাবে ছড়ায় করোনা ভাইরাস?
- করোনা ভাইরাস মূলত মানুষের ফুসফুসকে সংক্রমিত করে। এরপর শ্বাসতন্ত্র এবং সেখান
থেকে নিঃসৃত তরল থেকেই এটি মূলত ছড়ায়।
তাই আক্রান্ত ব্যাক্তির হাঁচি-কাশি থেকে এ ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে দ্রুত। এবং যেখানে এই হাঁচি এবং কাশির ফোটা পড়ে সেই জায়গাটিও সংক্রমিত হয়ে পড়ে। এছাড়া, মানবদেহে বেশ কয়েকবার মিউটেশনের কারনে, এ ভাইরাস বর্তমানে বেশ শক্তিশালী। আর, সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, করোনায় আক্রান্ত হবার পর সব মানুষের মাঝে এর লক্ষণগুলো তেমন প্রকট ভাবে প্রকাশ পায় না। তাই একজন মানুষ, যাকে দিব্বি সুস্থ দেখাচ্ছে, সেও নিজের অজান্তে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারেন।
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এ পর্যন্ত দেখা গেছে কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত রোগীরা বিশেষ কোন চিকিৎসা ছাড়া সুস্থ হয়ে গেছেন। কিন্তু ঝুকি রয়েছে তাদের, যারা বৃদ্ধ, ডায়বেটিস বা কিডনিতে সমস্যা রয়েছে, হার্টে সমস্যা রয়েছে এবং আগে থেকেই শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা রয়েছে।
এবার চলুন বলি তাদের কথা যারা আমাদের দেশে এ মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি এ ভাইরাসটির সংক্রমনের ঝুকিতে রয়েছে।
১। পরিছন্নতাকর্মী এবং মেথরেরা
- একটু চোখ কান খোলা রেখে স্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায়, এ মূহুর্তে
আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সর্বোচ্চ ঝুকিতে রয়েছেন পরিচ্ছন্নতা
কর্মী এবং মেথরেরা। শুধুমাত্র বাংলাদেশের শহর-অঞ্চলগুলোতেই ৪০০,০০০ এর মত মানুষ
আবর্জনা পরিষ্কার এবং মেথরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এবং আবর্জনা
পরিষ্কারকারীদের বেশীরভাগই নারী এবং শিশু, যারা ইতোমধ্যেই ভুগছে বিভিন্নধরণের
শারীরিক সমস্যায়, তার উপর এই মানুষগুলোর কোন প্রশিক্ষণ নেই। কিন্তু এর
পরও, করোনা ভাইরাসের সংক্রমন শুরু হবার পরও এসব পরিছন্নতাকর্মীদের জন্য সরকার বা
কতৃপক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি কোন সুরক্ষাসুলভ পদক্ষেপ। রাস্তা বা ডাস্টবিনগুলো
পরিষ্কার করার জন্য তাদের দেওয়া হয় নি কোন প্রোটেকশন গিয়ার। তাই এখনো, প্রতিদিনই
তাদের করোনা ভাইরাসের জন্য কোন প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র ছাড়াই রাস্তায় নামতে হচ্ছে
সাফাইয়ের কাজে।
সুতরাং, এ থেকে আমরা বলতেই পারি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার জন্য আমাদের এই পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা বেশ অনুকূলেই রয়েছেন।
২। গার্মেন্টস কর্মী
- এরপর চলে আসে গার্মেন্টসকর্মীদের কথা। বাংলাদেশে প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে এবং এদের ৮০ শতাংশেরও বেশী কর্মী হচ্ছেন নারী। এদের জীবন যাত্রা একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, এসব মেয়েরা ছোট একটা রুম ভাড়া করে এক রুমে প্রায় ৮-১০ জন মেয়ে গাদাগাদি করে থাকে। তাই চাইলেও এদের আইসোলেশন বা কোয়ান্টেরেশনের কোন সুযোগ নেই। তার উপর মাসিক চলাকালীন সময়ে মেয়েদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায়, মেয়েদের এ সময় সংক্রমিত হবার ঝুকি বেশী থাকে। কিন্তু এসবের পরও আমাদের দেশে এখন পর্জন্ত গার্মেন্টস সহ অন্যান্য কোন কলকারখান বন্ধ করার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয় নি।
৩। বস্তিতে বসবাসকারীরা এবং গৃহহীন মানুষ
- এরপর চলে আসি যারা আমাদের দেশে গৃহহীনভাবে রয়েছে এবং বস্তিতে বসবাস করে তাদের কথায়। পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশে বর্তমানে বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা হচ্ছে ২.২৩ মিলিয়ন এবং গৃহহীন মানুষ রয়েছে প্রায় ৫ মিলিয়ন। যাদের বসবাসের পরিবেশ আমরা কমবেশী সবাই জানি। তাদের থাকার জায়গার, খাবারের ঠিক নেই, বস্তিগুলোতে ঠিকমত পানি পাওয়া যায় না, সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার তো সেখানে বিলাসিতারই নাম। করোনার এই দুর্দিনে এই মানুষগুলো কিভাবে নিজেদের পরিছন্ন রাখবে এবং রক্ষা করবে তা আমি অন্তত এই পর্যন্ত ভেবে পাইনি।
৪। রিকশাওয়ালা
- বাংলাদেশে শুধু মাত্র ঢাকাতেই রিকশাওয়ালার সংখ্যা আছে ২.২ মিলিয়ন। এবং এদের প্রত্যেকের পরিবার তাদের আয়ের উপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে। একবেলা কাজে বের না হলে এই মানুষগুলোর সেদিন না খেয়ে দিন কাঁটাতে হয়। আমরা তাই চাইলে ঘরে থাকতে পারলেও, এই মানুষগুলোর ঘরে থাকার কোন সুযোগ নেই। তার উপর অতিরিক্ত সিগারেট এবং তামাক সেবনের ফলে ৯০ শতাংশের মতো রিকশাওয়ালারা রয়েছেন স্বাস্থ্য ঝুকিতে।
৫। সাংবাদিক এবং নিরাপত্তা রক্ষীরা
- এইতো গেল আমাদের নিম্ন আয়ের বা দরিদ্র মানুষদের কথা। কিন্তু যারা হয়তোবা এদের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছেন তাদের মধ্যের সকলে কি নিরাপদে আছেন? প্রতিদিনই বিভিন্ন খবরে এবং টিভিতে দেখছি সাংবাদিকরা বিভিন্ন যায়গায় খবর সংগ্রহ করছেন এবং পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের কাজ করছেন। কারোরই একমাত্র মাস্ক ছাড়া আর কোন প্রোটেকশন গিয়ার নেই। কিন্তু তারা সকলেই কাজ করছেন বিভিন্ন ঝুকিপূর্ন যায়গায় এবং বিভিন্ন জনসমাগমে, প্রতিদিন বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে তাদের আসতে হচ্ছে। তারা যে কতটা ঝুকিতে আছেন তারা কি জানেন না ?
৬। ডাক্তার এবং হাসপাতালের কর্মীরা
- সবশেষে বলছি আমাদের ডাক্তার এবং হাসপাতালের কথা। কারণ তারা যে কতটা ঝুকি নিয়ে নিজের প্রানকে বাজি রেখে প্রতিদিন হাসপাতালে যাচ্ছেন আমাদের সেবা দিতে তা না বললেও আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এই ডাক্তার এবং কর্মীদের কি আমরা নিরাপত্তা দিতে পারছি কি? কোন হাসপাতালেই কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত রোগীকে সেবা দেওয়ায়র জন্য পর্যাপ্ত প্রোটেকশন গিয়ার দেওয়া হয় নি। সেবা দিতে গিয়ে ৪জন ডাক্তারকেই কোয়ারেন্টেশনে পাঠাতে হয়েছে। যাদের আমাদের রক্ষা করার কথা ছিল, আমাদের এই অব্যাবস্থাপনার জন্য যদি তাদেরই রক্ষা করতে না পারি এর থেকে বেশী দুঃখের আর কিছু আমাদের থাকবে না।
তথ্যসূত্রঃ
১) https://www.thedailystar.net/star-weekend/labour-rights/news/pulling-the-weight-the-world-1698940
৩) https://www.dhakatribune.com/bangladesh/dhaka/2017/11/27/garbage-collecting-children-sdgs
৪) https://en.prothomalo.com/bangladesh/5m-homeless-74-pc-of-the-population-live-in-mud