এইতো কদিন আগেও সিলেটের সাবেক মেয়র বদরুদ্দীন কামরান নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরেই সিলেট শহরে জনসভা করে বেড়ালেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ৩৭ জনকে সাথে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স করলেন। সাহসী কোন সাংবাদিকের প্রশ্নে ইতস্ততও করলেন। এইতো ২১ মার্চ শত নিষেধেও ভোটযজ্ঞ সাধন করলো সরকার। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে হওয়া আতশবাজির কথা নাইবা তুললাম। সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করার পর সরকারের সিভিল সার্জন যখন বিয়ের অনুষ্ঠান করে কয়েকশো মানুষ দাওয়াত দেন। উচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, সব জেনে বুঝে শুধু জাহিরী করবার প্রবণতার কোন খেসারত অবশ্য তাকে দিতে হয় নাই।
আমাদের ডাক্তারদের সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) সংকট, দ্রব্যমূল্যের আগুন, গ্রামমুখী মানসিকতা সব মিলিয়ে সরকারি ছুটিও চলে এলো। শুধুই সরকারী ছুটি। লকডাউন, কার্ফিউ বা ১৪৪ ধারা নয়। একটা সরকারী ছুটি। সবাইকে নিজ গৃহে অন্তরীন হবার দাওয়াত দেয়া হলো। উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তরা গৃহপ্রাঙ্গণেই খু&জে নিলো প্রেরণা। নিম্নবিত্তরা নগর ছেড়ে নিজঘরে। সেখানে অন্তত শাকভাত মিলবে এই আশায়। এরমধ্যেই শহরে ঘরবন্দী মানুষ। ধীরলয়ে অলস হয় বিভাগ,জেলা, উপজেলা, থানা, ওয়ার্ড সব। রাস্তায় নামে পুলিশ আর মিলিটারি। দেশের খালি সড়কও হয়ে যায় মানুষের পাকস্থলী।
অফিস ,আদালত পাততাড়ি গোটায়। ব্যবসায়ের শাটারও নামে ঝপাঝপ।
এতোকিছুর মাঝেও গনগনে হয়ে থাকে বুভুক্ষুর পেট। ক্ষিধে বড্ড ভয়ঙ্কর জিনিস। কখনো মহামারীর চাইতেও। খালিপেটে থাকবার ভয় মানুষকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে সেই প্রাচীণ যুগ থেকে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সিনেমা সবতাতেই ক্ষুধার অবস্থান শীর্ষে। মানুষের একদম প্রাথমিক মৌলিক চাহিদা। এর কাছে সাদাকালো, চেতনা, মহামারী, সচেতন, অচেতন কিছুরই দাম নেই। কবি রফিক আজাদও তাই বলেছিলেন_ ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাবো।’
রাষ্ট্রীয়ভাবে করোনাকে দূর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয় নাই। তাই সরকারের তরফ থেকে গণত্রাণ বিতরণের কোন পদক্ষেপও দেখা যায় নাই। উপরন্তু নাগরিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয়ও বন্ধ। এই অবস্থায় কোন ক্ষুধিত মানবই বসে থাকবে না। তাছাড়া সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী নিত্যপণ্য ও ফার্মেসি খোলা রাখবার বিষয়ে কোন নিষেধ আছে বলে মনে হয়নি। দোকানীরা দোকান খুললেও পুলিশ লাঠিপেটা করছে। কোন নির্দেশনায় এমনটা করা হচ্ছে সেটাও এক প্রশ্ন। মাস্ক না দেখলে কান ধরে উঠবস করাচ্ছে। রিকশাওলাকে রাস্তায় গড়িয়ে যাবার শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কান ধরে আইল্যান্ডে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে বিষয়টা নির্যাতনের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। যেন মশা মারতে কামান দাগছে। কলকাতার হাওড়ায় পুলিশের লাঠির আঘাতে এক যুবক নিহতও হয়েছে।
এভাবে চলতে থাকলে এমন ঘটনা আমাদের এখানেও ঘটতে সময় লাগবে না। জীবন বাঁচানোর জন্য কেউ যখন রাস্তায় বের হন, গায়ে খেটে কিছু কাজ করে ঘরে খাবার নিয়ে যাওয়া যার একমাত্র উপায় এটা তাঁর অপরাধ নয়, এটা তাঁর বিপদ। তাঁকে সাহায্য করাই সরকারী কর্মকর্তাদের কাজ। বেশকিছুক্ষণ আগে থেকেই এক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তার ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। যশোর মণিরামপুরের সহকারী কমিশনার(ভূমি) সাইয়েমা হাসান কানধরিয়ে ছবি তুলছেন বৃদ্ধ, প্রান্তিক মুটেমজুর বা বাজারী বিক্রেতার। দোষ ছিলো তাদের মাস্ক, গ্লাভস কিছু নেই। যাদের একবেলার আয়ে একবেলার আহার হয়। যে ব্যক্তির জীবন দুর্ভিক্ষসম, সে মহামারীর ভয়ে ভীত হবার সুযোগ পায় না। অথচ এই ক্ষমতাধর আমলারা নিজেরাও পারতেন এসব মানুষের জন্যে ত্রাণ, মাস্ক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করতে।
সবশেষে বলা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুলোতে প্রবলহারে এসব পুলিশি হয়রানীকে সমর্থন যোগানো হচ্ছে। অপমানজনক ভিডিও বা ছবি দিয়ে মিমও তৈরী করা হচ্ছে। ঠিক যেন কলোসিয়ামে বসে আমরা উপভোগ করছি দাস গ্ল্যাডিয়েটরের জীবন বাঁচানো যুদ্ধ। এই জাতীয় মানুষের কারণেই দেখা যায় রাষ্ট্র তার করা ‘ভুল’ কে বৈধ করাবার প্রয়াস পায়। পুলিশ যাদের মারছে বা এসিল্যান্ড যাদের কান ধরায় তারা প্রান্তিকের চাইতেও প্রান্তিক । বিপদাপন্নের চাইতেও বিপদাপন্ন। আর এমন বিপদাপন্ন ব্যক্তিদের অপমান করা, কান ধরে উঠবস করানো, গায়ে হাত তোলা গুরুতর অপরাধ।
‘লকডাউন’, ‘কোয়ারেন্টাইন’, ‘আইসোলেশন’ ইত্যাদি করা হচ্ছে জনগণের জীবন নিরাপদ করার জন্য, তাদের হয়রানি বা বিপদাপন্ন করার জন্য নয়। রাষ্ট্র তার অব্যবস্থাপনা দিয়ে যেচে করোনা এনেছে। এরপর প্রপার কোয়ারেন্টাইন না করে তাকে ছড়িয়েছে। এখন পাইক পেয়াদা বরকন্দাজ নামিয়ে জাহির করছে, করোনার বিরুদ্ধে ‘জাতীয় যুদ্ধ’ !