আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়ার পক্ষে উচ্চ আদালতের দেয়া রায় স্থগিত করে প্রধান বিচারপতি আসলে কি বুঝাতে চেয়েছেন? এ কাজের মাধ্যমে উনি কি তাহলে অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করছেন যার ফলে বিচারালয়ে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনতার ভূমিকাকে বিতর্কিত করেছেন?
একুশে বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে অবিলম্বে স্টল বরাদ্দ দিতে হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছিলেন, তা স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে বাংলা একাডেমির করা আবেদন নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ আজ বুধবার এ আদেশ দেন।
প্রধান বিচারপতি কি সাধারণ আওয়ামী লীগের লোকজনের চাইতে বড় আওয়ামী লীগ বলে নিজেকে প্রমাণ করছেন না?
প্রধান বিচারপতির এটা জানার কথা যে আওয়ামী লীগ পন্থী প্রকাশক ও বুদ্ধিজীবীদের চাপেই বাংলা একাডেমি আদর্শকে স্টল বরাদ্দ না দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। এমনকি গতবছর আদর্শকে বিশেষ বই না রাখার মৌখিক নির্দেশ সংক্রান্ত মিথ্যা বক্তব্য যাচাইয়ের উদ্যোগ নেননি প্রধান বিচারপতি। তাছাড়া, সরকারি সংস্থা হিসেবে বাংলা একাডেমির মৌখিক নির্দেশের অকার্যকরিতা ও অগ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রধান বিচারপতির কোন অব্জার্ভেশান ছিল না।
মোটকথা, প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তে বিশেষ লেখকের পাশাপাশি প্রায় ৩০০ লেখক আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যেসব লোকের হওয়ার কথা ছিল আওয়ামী লীগের নেতা, তারা হয়ে যাচ্ছেন বিচারপতি, প্রধান বিচারপতি! মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে ভদ্রলোকেদের নূন্যতম ধারণা নেই বলেই প্রতীয়মান। এনারা জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, সামাজিক ও রাজনৈতিক সনদের প্রয়োগ নিজেদের বিচারিক সিদ্ধান্তে প্রতিফলন করতে পারেন না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক উচ্চ আদালতের রায়কে বাংলা একাডেমির সরকার পন্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি নিজে এসে উল্টে দিলেন যা দেশের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষায় বিচারালয়ের ভূমিকাকে বিতর্কিত করবে।
মনে হচ্ছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী বিচারক বাঙালির মিডিওক্রেসির শুধু প্রমাণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে অজ্ঞানতার প্রমাণও দিচ্ছেন। আদালত, ফাহাম আব্দুস সালামের বইয়ের বক্তব্যের জন্য আরও কয়েকশ লেখকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করলেন এবং তাঁদের আর্থিক ক্ষতি বাড়ালেন। অথচ অপছন্দের মতের বিরুদ্ধে পাল্টা বক্তব্য তৈরি ও ফাহামের মতকে খারিজ করে পাল্টা বই লেখার আহ্বান জানানোর উদ্যোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল আলাদতের। মনে রাখতে হবে, আদালত আইন তৈরি করে না, ব্যাখ্যা ও অব্জার্ভেশন দেয় মাত্র।
সরকার পন্থীদের অবৈধ সিদ্ধান্ত ও ব্যক্তি বিচারকের জাতিবাদী অবস্থানকে বৈধতা দিতে গেলে আদালত নিজের এখতিয়ারকে ছাড়িয়ে যায় বলেই প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকবছর ধরেই প্রতিকূল সময় পার করছে। দেশের এলিট বাহিনীর বিরুদ্ধে দুটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বহাল হয়েছে। এমতাবস্থায় প্রকাশিত পুস্তকের বিরুদ্ধে হার্ড সেন্সরশীপ সরকারের জন্য বিপদের। ফলে, ডকুমেন্টস রাখবে না বলে কোন বই নিষিদ্ধ করবে না বলে মনে হচ্ছে, যাতে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই নিয়ে ফর্মালি কথা বলার সুযোগ না পায়।
কিন্তু আপিলেট ডিভিশনের সিদ্ধান্ত একই সুযোগটা দিয়ে দিল। আপিলেট ডিভিশনের পেপার ওয়ার্ক নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা গুলো ফর্মালি বক্তব্য ও বিবৃতি দিতে পারবে বলেই মনে করি। সরকার পন্থীদের বিধিনিষেধের কারণে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে পড়া প্রকাশনী আদর্শের বই সামাজিক বিপণনে ছড়িয়ে যাবে। এমনকি পরোক্ষ বাঁধায় দেশে প্রকাশিত না করতে দিলে বাইরে থেকেও প্রকাশিত হবে। প্রকাশক ও কয়েকশত লেখক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, তার সব চেষ্টাই সচল থাকবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সবার এটা মেনে নেয়া দরকার। কেননা, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করলে কোন চেষ্টাই দিন শেষে ফল দিবে না।
লেখক: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
[ Edited by Konad Sorker]