ছাত্রলীগের সভাপতি সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন “ব্যাক্তির অপরাধের দায় সংগঠন নেবে না”
এক.
ব্যাক্তির দায় সংগঠন কি নিতে হবে কি হবে না সেটা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলাপ আছে। এই বিষয় ভালো বোঝা যাবে আন্তর্জাতিক অপরাধী জাপানি জেনারেল ‘তময়উকি ইয়ামাশিতা’র মৃত্যুদণ্ডের রায়ের দিকে তাকালে।
১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর। ফিলিপাইন। ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের এক রায় অনুসারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় জাপানি জেনারেল ‘তময়উকি ইয়ামাশিতা’-র ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয় এই দিনে। তার উপর আনিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিলো ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবলিটি’ অথবা ‘কম্যান্ডার রেস্পন্সিবলিটি’। ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ ম্যানিলার এক আদালতে জেনারেল তময়উকি ইয়ামাশিতার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে ছিলো ম্যানিলা গনহত্যা সংগঠনে ভূমিকা, সিংগাপুর এবং ফিলিপাইনে নিরীহ মানুষদের হত্যার অভিযোগ।
জেনারেল ইয়ামাশিতার বিরুদ্ধে আনিত অনেক সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভেতর যেই অভিযোগের কারণে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল তা হচ্ছেঃ জাপানি সেনাবাহিনীর একজন কম্যান্ডার হিসেবে সে তার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেনি। জাপানি সৈন্যরা যখন গণহত্যা চালাচ্ছিলো তখন জেনারেল ইয়ামাশিতা নৈতিকতার জায়গা থেকে তাদের এরকম কর্মকাণ্ড করতে বাধা দেননি। জেনারেল ইয়ামাশিতার আইনজীবীরা জাপানি বাহিনীর হাতে গণহত্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে যুক্তি দেখায় যে যুদ্ধের ভেতর যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো এবং জাপানি সেনাদের ভেতর চেইন অফ কম্যান্ড পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আর তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও জেনারেল ইয়ামাশিতা তার সৈন্যদের হত্যা, ধর্ষণ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।
সেই বিচারে কেবল মাত্র সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ব্যর্থতার কারণে জেনারেল ইয়ামাশিতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত, সেই রায় আপিল কোর্টের পর রাষ্ট্রপতির ক্ষমা বঞ্চিত হয়ে ১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয়।
দুই.
“কাকে হত্যার দায়ে জনাব আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো??” মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ ট্রাইব্যুনাল থেকে আসার পর আপীল ডিভিশনে আসামিপক্ষের প্রথম প্রশ্ন ছিল এটাই।
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ- ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রেসিডেন্ট, পদাধিকার বলে কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদরের কমান্ডার। তার নেতৃত্বে এই দেশের শত শত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।
এই মামলার রায় পড়লে দেখা যায় ডিফেন্স মানে মুজাহিদের আইনজীবী এই মামলার বেলায় সরকারপক্ষের তোলা প্রায় সব অভিযোগই মেনে নিতে বাধ্য হয়। তারা মেনে নিয়েছে ১৯৭১ সালে মুজাহিদ পুরো পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রেসিডেন্ট ছিলো। তারা মেনে নিয়েছে যে ১৯৭১ সালে আলবদর নামের একটা সংগঠন বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলো। তারা মেনে নিয়েছে যে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আলবদর হেড কোয়ার্টার ছিলো এবং সেখানে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে অত্যাচার করা হতো, হত্যা করা হতো। তারা এটাও মেনে নিয়েছে যে মুজাহিদ মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে নিয়মিত যাতায়ত করতো।
কিন্তু তারা মানতে নারাজ যে আলবদর প্রধান মুজাহিদ একজন খুনি। এবং তাদের একটাই কথা যে আদালত রায়ে উল্লেখ করেনি মুজাহিদ আসলে কাকে হত্যা করেছে?
আপীল বিভাগে তখন রাষ্ট্রপক্ষ সারা পৃথিবীর অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুলো থেকে “সুপেরিয়র রেস্পন্সিবলিটি”র শতশত উদাহরণ এনে প্রমাণ করে যে খুনে সংগঠন আলবদরের নেতা আলী আহসান মুজাহিদের নেতৃত্বেই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তাই সে অপরাধস্থলে না থেকেও অপরাধী। আপীল বিভাগেও মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। মুজাহিদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়।
তিন.
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদ সহ নানা যুদ্ধাপরাধীদের রায়, নুরেমবার্গ ট্রায়ালের রায়, ম্যানিলার ট্রায়ালের রায়, রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রায়ালের রায় সবাই এই কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে সংগঠনের আদর্শ রক্ষার নামে, সংগঠনের সম্মান রক্ষার নামে যেই অপরাধ করা হয় সেই বেলায় “ব্যাক্তির অপরাধের দায় সংগঠনকে নিতেই হবে”। বুয়েটে আবরারকে হত্যাকান্ড বুয়েট ছাত্রলীগের সম্মিলিত কীর্তি, এই দায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নিতেই হবে।
লেখাঃ উদ্ভটাপন্ন মরহুম